যেভাবে এলো ‘জয় বাংলা’ স্লোগান, নজরুল বন্দনায় শিক্ষামন্ত্রী

প্রকাশিতঃ 9:51 pm | May 25, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

ছাত্র জীবনে তুখোর বিতার্কিক ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি। আওয়ামী রাজনীতির পরিবার থেকে বেড়ে উঠা একজন ভাষাবীরের এ সন্তান শৈশবেই আত্মস্থ করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।

দ্রোহ, সাম্য, মানবতা ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের শক্তিশালী লেখনী থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা পেয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

আরো পড়ুন: মাদক ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে এসপি আবিদের প্রয়াস, ধন্যবাদ দীপু মনির

শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ এগিয়ে চলছে সেটি সফল হলে নজরুলের স্বপ্নও স্বার্থক হবে, মত শিক্ষামন্ত্রীর।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তিনি গবেষক না হলেও গভীর মমতায়, অসীম ধৈর্য্যে পড়েছেন আমৃত্যু মানবতার জয়গান করা এ কবিকে। আর তাইতো মন্ত্রী উচ্চারণ করেন-জীবনের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে সংগ্রামবহুল জীবন কেটেছে কবি নজরুলের।

কঠিন বাস্তবতাতেও তিনি দমে যাননি। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। যে কোন প্রতিবাদে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের নিত্যসঙ্গী।

জয় বাংলা স্লোগানের সৃষ্টি মুহুর্তের গল্পও বলে গেলেন শিক্ষামন্ত্রী। মন্ত্রী বললেন, ‘জাতীয় কবির লেখা থেকেই বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন আমাদের মুক্তির সেই অমোঘ স্লোগান- ‘জয় বাংলা’। তাঁর লেখা থেকেই তিনি (বঙ্গবন্ধু) নিয়েছিলেন আমাদের এ দেশটির নাম বাংলাদেশ।’

এ গল্পটাও ঠিক যেন এমন- বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা আর নেতৃত্বের প্রতি প্রগাঢ় আস্থা সম্পর্কে তার রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নেতাকর্মীদের উদ্দেশে প্রায়ই বলতেন, ‘মুজিবের মতো অতুলনীয়, দক্ষ সংগঠক আমি একজনও পাইনি।’

ইতিহাসের মহীয়ান সেই সত্যবাণী উচ্চারণ করে ডা: দীপু মনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু তাঁর গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে এ দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ।’

শনিবার (২৫ মে) বিকেলে ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবির বাল্য স্মৃতিবিজড়িত দরিরামপুর নজরুল একাডেমি মাঠের নজরুল মঞ্চে তিন দিনব্যাপী নজরুল জন্ম জয়ন্তীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় টুকরো টুকরো এসব গল্পই আওড়ে যান শিক্ষামন্ত্রী।

কবি নজরুল ছিলেন কৌতূহলী শ্রোতা
শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি এমপি বলেন, কবি নজরুল ১৯১৩-১৪ সালে সর্বপ্রথম ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ অঞ্চলের প্রচলিত গীতিকা, জারি, যাত্রা, কবিগান, পালাগান, পুঁথি পাঠের আসরে কবি ছিলেন কৌতূহলী শ্রোতা। রাত জেগে জেগে তিনি নানান ধরণের পরিবেশনা দেখেছেন এবং নিজস্ব অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে তিনি পেয়েছেন অফুরান শক্তি।

ত্রিশালবাসীর জন্যও গর্বের ও আনন্দের
প্রতি বছরই কবির জন্য ত্রিশালবাসীর হৃদয়গ্রোথিত আবেগের প্রশংসা করে ডা: দীপু মনি বলেন, প্রতি বছরের মতোই আমরা কবি নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে তাঁর জন্মবার্ষিকী পালন করছি। এর মাধ্যমে আমরা কবির প্রতি যেমন সম্মান দেখাচ্ছি তেমনিভাবে ত্রিশালবাসীর জন্যও বিষয়টি অত্যন্ত আনন্দ ও গর্বের।

বাংলাদেশের অনেক জায়গায় কবির পদচিহ্ন রয়েছে। তাঁর উপস্থিতি এবং তাঁর কর্ম কোলাহল এখনো স্মৃতিময় হয়ে আছে সেইসব অঞ্চলে। মাত্র ৭৭ বছর বয়সে কবি যা করেছেন তা জানলে সত্যিই বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় বলে মনে করেন শিক্ষামন্ত্রী।

মুখর কবি নজরুল বন্দনায়
অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেতনাকে হৃদয়-মনে ধারণ করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি। তিনি বলেন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আকাঙ্খার কারণে জাতীয় কবিকে ইংরেজ সরকারের জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে।

একজন কবি মানুষের অধিকার ও সাম্যের কথা বলায় ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন। ধর্ম ব্যবসায়ী ফতোয়াবাজদের মুখোশ খুলে দেওয়ায় কাফের নামেও অভিহিত হয়েছেন।

কিন্তু কোন কিছুই জাতীয় কবিকে ভীত করে দমাতে পারেনি। আমরা তাঁর কাছ থেকে লাভ করেছি সাহস, অর্জন করেছি প্রতিবাদের ভাষা। আর তাই ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং আজো আমাদের যে প্রতিবাদে নজরুল আমাদের নিত্যসঙ্গী।

নজরুলের সক্রিয় জীবনকাল ৪৩ বছর
১৯৪২ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কবি নজরুলের সক্রিয় জীবনমাল মাত্র ৪৩ বছর।

বারবার স্কুল পরিবর্তন, মক্তবে পাঠদান, লেটুর দলের, মাজারে খাদেমগিরি, সেনাদলে যোগদান করে হাবিলদার পদ লাভ, গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে পথে পথে গান করা, জেলখাটা, দাবি আদায়ে জেলে অনশন করা- কত কী না করেছেন নজরুল।

কর্মময় ৪৩ বছরের জীবনে সাহিত্য রচনার সময়কাল ১৯১৯ থেকে মাত্র ২৩ বছর। এ স্বল্প সময়ে তাঁর সাহিত্য রচনার পাল্লা কী অসাধারণ ভারী।

প্রায় ৩ হাজার গান, ২২ টি কবিতার বই, ৩ টি উপন্যাস, ৩ টি গল্পের বই, চারটি প্রবন্ধের বই, অনুবাদ, রম্য রচনা, ভাষণসহ প্রায় ৫০ টি বই রচনা করেছেন তিনি। আমরা দেখি কীভাবে তাঁর যে সময়, সেই সময় পারিপার্শ্বিকতা তাঁর সমাজ কীভাবে নজরুলকে নির্মাণ করেছে।

বঙ্গবন্ধু ও নজরুলের চিন্তা দর্শনে অসাধারণ মিল
শিক্ষামন্ত্রী জানালেন, মাত্র ২২ বছর নজরুল সাহিত্য সৃষ্টির সময় পেয়েছিলেন। কবিগুরুর সঙ্গে ছিল তাঁর মধুর সম্পর্ক। বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কবি পেয়েছিলেন প্রতিষ্ঠা। রবীন্দ্র যুগে রবির কিরণে তাঁর আলো ম্লান হয়নি। নজরুল তাঁর নিজ প্রতিভায় ছিলেন উদ্ভাসিত।

মানবমুক্তি ও মানবকল্যাণের পথে হেঁটেছেন কবি নজরুল এমন মন্তব্য করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু ও নজরুলের চিন্তা দর্শনে অসাধারণ মিল রয়েছে। বঙ্গবন্ধু নজরুল দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁর দরাজ গলায় প্রায়ই নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন।

তাঁর কন্যা, সাহিত্যের ছাত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সঙ্গেও দেখি কী অপূর্ব মিল। স্বাধীনতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্যহীনতা, নারীর অধিকার সবকিছুই তাদের চিন্তার মূলে।

জোরদার করতে হবে নজরুল গবেষণা
নজরুলের সঙ্গীত ও সাহিত্যকে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে হলে কবির ওপর আরো গবেষণা করতে হবে, এমন বার্তাও দেন শিক্ষামন্ত্রী। চাঁদপুরের এ চাঁদমুখ বলেন, নজরুল ইন্সটিটিউট অনেক গবেষণা করছে।

নজরুল সাহিত্যকে বিশ্ববাসীর সামনে পরিচিত ও আদৃত করতে আরো বেশি তাকে অনুবাদ করতে হবে। বাংলার সৃজনশীল সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করতে বিদেশী ভাষায় আমাদের সাহিত্যকে আরো অনুবাদ করা জরুরি।

জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ছিলেন যারা
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কাজী খালিদ বাবু’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. হাফেজ রুহুল আমিন মাদানী।

আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবিপৌত্রী ও কবি নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য খিলখিল কাজী। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ নজরুল স্মারক বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

কালের আলো/এমএইচএ/এএ