ঈদের মাঠে রাষ্ট্রপতিকে রিসিভ করতে গিয়ে বাবাকে ‘মিস’ করেন মেয়র সাঈদ খোকন!

প্রকাশিতঃ 5:44 am | June 08, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন প্রয়াত কিংবদন্তি রাজনীতিক মোহাম্মদ হানিফ। বাবার হাত ধরেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছেলে সাঈদ খোকনের। ১৯৮৭ সালে ওয়ার্ড শাখার আইন বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যাত্রা শুরু।

প্রায় দুই যুগ যাবত সম্পৃক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। ২০১৫ সালের প্রথম দিকে বাবার কাছে পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসকে প্রায় আড়াই লাখ ভোটে হারিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর পিতা নির্বাচিত হন।

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে নগর ভবনে প্রবেশ করে মতবিনিময় সভায় বলেছিলেন, ‘নগরপিতা নয়, নগরের সন্তান হিসেবে যেন নগরবাসী আমাকে দেখেন। আমি একটি নিষ্কলুষ শহর গড়ে তুলতে চাই। ঢাকাবাসীর সমস্যা সমাধানে আমরা সবাই দলমত-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব।

আমরা এখানে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাই না। এই নগর ভবন হবে নগরবাসীর সেবাকেন্দ্র। এখানে সেবার মধ্য দিয়ে মানুষের খেদমত করতে চাই।’

প্রায় চার বছরে কতদূর কাজ করতে পেরেছেন ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলা থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষায় নিজের জীবন উৎস্বর্গ করা মোহাম্মদ হানিফের এ রক্তের উত্তরাধিকার?

তাঁর কাছে নগরবাসীর প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির যোগফল, নিজ করপোরেশনের বাসিন্দাদের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ, চাপের মধ্যে দিয়ে কাজ করার মানসিকতাসহ নানাবিধ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ডিবিসি নিউজের ঈদের বিশেষ ‘সংবাদ সম্প্রসারণ’ অনুষ্ঠানের।

‘এক শো-তে দুই মেয়র’ শিরোনামে এ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছেন শারমিন চৌধুরী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকনের পাশাপাশি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামও ছিলেন এ অনুষ্ঠানে।

গুরুত্বপূর্ণ এ অনুষ্ঠানে ডিএসসিসি’র জনপ্রিয় মেয়র সাঈদ খোকনের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো কালের আলো’র পাঠকদের জন্য।

ডিবিসি নিউজের ঈদের বিশেষ ‘সংবাদ সম্প্রসারণ’ এর ‘এক শো-তে দুই মেয়র’ অনুষ্ঠান

রাষ্ট্রপতিকে রিসিভ করি, বাবাকে অনেক মিস করি

উপস্থাপক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘অনেক চাপ নিয়ে কাজ করতে হয় আপনাদের। এর মধ্যে মেয়র হিসেবে ঈদ কেমন কাটে?’ এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘ঈদুল ফিতর ভালোভাবেই পালন করতে পারি। ঈদের প্রধান জামাত দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আয়োজন করে থাকে।

এখানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আসেন। ঈদের জামাতের পর দেখা সাক্ষাত ও সালাম বিনিময়। একসময় আমার বাবার (প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) সাথে ঈদগাহে যেতাম। তখন বাবা রাষ্ট্রপতিকে রিসিভ করতেন আমি বাবার পাশে থাকতাম। আর এখন আমি রাষ্ট্রপতিকে রিসিভ করি, তখন বাবাকে অনেক মিস করি।

গিনেস বুকে রেকর্ড

বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী ‘স্বচ্ছ ঢাকা’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিজেই মাঠে নেমেছিলেন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়তে প্রতীকী এ পরিচ্ছন্নতায় ৭ হাজার ২১ জন মানুষ অংশ নিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে ঢাকার নাম অন্তর্ভূক্ত করেছিল।

বিশ্বের বুকে ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন নগরী এবং নিজেদেরকে একটি পরিচ্ছন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে সেই সময় মেয়র নগর পরিচ্ছন্নতায় গিনেস বুকে করা স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে উৎসর্গ করেন।

পরিচ্ছন্নতায় বিশ্বরেকর্ড গড়ার লক্ষ্যে গত ১৩ এপ্রিল চৈত্র সংক্রান্তিতে ডিএসসিসি ও রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘ডেটল পরিচ্ছন্ন ঢাকা’ নামে কর্মসূচি করে, যা গিনেস বুকে স্থান করে নিয়েছে।

সেই তথ্য সেদিন উপস্থাপন করে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন যে জনগণকে সচেতন করার জন্য আমরা একটা স্বচ্ছ ঢাকা কর্মসূচি নিয়েছিলাম। যেটা গিনেজ বুকে রেকর্ড করেছে। আমরা যেখান থেকে শুরু করেছি সেখান থেকে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। জনসচেতনতার প্রসেসটা এমন না যে, এটা বন্ধ করে দিতে হবে।

বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রতিদিন হাজারো মানুষ শহরে আসে। তারা শহুরে জীবনে অভ্যস্ত নন। তাদেরকে সচেতন করে তোলা। আমরা কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছাতে পেরেছি সেটা বলবো না, তবে আমরা চেষ্টা করছি পৌঁছাতে। পরিচ্ছন্ন একটি ঢাকা শহর উপহার দিতে।

পরিচ্ছন্নতায় বিশ্বরেকর্ড গড়ার লক্ষ্যে গত ১৩ এপ্রিল চৈত্র সংক্রান্তিতে ডিএসসিসি ও রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘ডেটল পরিচ্ছন্ন ঢাকা’ নামে কর্মসূচি করে, যা গিনেস বুকে স্থান করে নিয়েছে।

গণমাধ্যমের সমালোচনাতে ইতিবাচক দৃষ্টি

গণমাধ্যমের সমালোচনায় কখনই বিরক্ত হন না মেয়র সাঈদ খোকন। বরং তিনি এ সমালোচনাকে মেনে নিয়েই কাজ করেন। এ প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, ‘গণমাধ্যমের সমালোচনা আমলে নিয়েই কাজ করি। আমার বাবা একটা কথা বলতেন সাংবাদিকরা আই ওপেনার। কোটি মানুষের শহরে একজন মেয়র অনেক কিছুই দেখতে পারে না।

কিন্তু আমাদের সংবাদমাধ্যম সেগুলো আমাদের দৃষ্টিতে আনতে পারে। এগুলো আমার জন্য ভাল। আমার চার বছরের সময়ে এগুলো আমি কখনই নেতিবাচক হিসেবে দেখিনা। পজিটিভলি নিয়েছি সব সময়।’

স্কুল আগে না টয়লেট আগে?

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে এখন অবধি কোন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন কীনা এমন বিষয় জানতে চান সঞ্চালক। এর জবাবে সাঈদ খোকন বলেন, আমি চার বছরে তেমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়িনি। এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি উদাহরণ দেন দক্ষিণের এ নগর পিতা।

তিনি বলেন, ‘জনতার মুখোমুখি জনপ্রতিনিধি নামে প্রতিটি ওয়ার্ডে আমরা একটি অনুষ্ঠান করি। সেটা ইতোমধ্যেই ২৮ থেকে ৩০ টি ওয়ার্ডে হয়ে গেছে। সেখানে আমরা সবাই যাই। সেখানে আমরা মানুষের সমস্যার কথা শুনি। বেশ ছোটখাটো সমস্যার কথাই তাঁরা বলে।

যেগুলো সম্ভব হয় তাৎক্ষণিক সমাধান করা বা সময় নিয়ে সমাধান করা হয়। সেখানে একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে এসে জোরে বলছিল ‘স্কুল আগে না টয়লেট আগে?’ বুঝতে পারছিলাম না সে কি বলতে চাচ্ছে?

সে বুঝতে পারছিল না কোনটা প্রায়োরিটি বেশি হবে? স্কুলে সামনে একটি টয়লেট নির্মাণ হচ্ছিল, সে এটা মেনে নিতে পারছিল না। আমি চেষ্টা করেছি তাকে বোঝাতে যে স্কুলের যেমন প্রয়োজন তেমন টয়লেটও লাগে। আমি তাকে বোঝাতে পেরেছি।’

দক্ষিণে ৩৭ হাজার ২০০ এলইডি বাতি, ৯০ ভাগ সড়ক ঠিক

মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমাদের পুরোনো ঢাকায় সড়ক বাতি জ্বলতো না দীর্ঘদিন। আমি মেয়র হওয়ার পর সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ সিটির পুরো লাইটিং সিস্টেম বদলে দিতে সক্ষম হয়েছি। এখন আমাদের ৩৭ হাজার ২০০ এলইডি বাতি জ্বলে। টোটাল সিস্টেমটা ডিজিটালাইড করা হয়েছে।

মোবাইল ফোনের অ্যাপসের মাধ্যমে ঘরে বসে দেখতে পারি আমার এলাকার কোন রাস্তায় বাতিগুলো জ্বলছে না।

এর ফলে অপরাধ যেমন চুরি, ছিনতাই কমেছে। নারীর নিরাপত্তা বেড়েছে। এটা আমার অনেক বড় ধরণের একটি মানসিক তৃপ্তি। আমার তৃপ্তির জায়গা হচ্ছে নাগরিকরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারছে।

‘আমার করপোরেশনের ৯০ ভাগের বেশি রাস্তা আমি ঠিক করে দিতে পেরেছি’ জানিয়ে ঢাকার মাজেদ সর্দারের নাতি সাঈদ খোকন বলেন, ‘কিছু মৌলিক সমস্যা আমি সমাধান করতে পেরেছি।

এক সময় বিলবোর্ডে আকাশও দেখা যেতো না। ঝড়ের মধ্যে বিলবোর্ডে পড়ে মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এটা অহরহ।

এ বিলবোর্ডগুলোকে ক্লিন করতে সক্ষম হয়েছি। ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড করে দিয়েছি। অর্থাৎ, ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনাটা আমরা করতে সক্ষম হয়েছি।’

একজন মেয়র হিসেবে যা করতে পেরেছেন এবং যা করতে পারেননি এ বিবেচনায় নিজেকে একশোতে কত মার্কস দিবেন উপস্থাপকের এমন প্রশ্নে সাঈদ খোকন বলেন, ‘নিজের মূল্যায়ন নিজের করাটা সমীচীন নয়। আমার জনগণ ও সম্মানিত নাগরিকরা এ মূল্যায়ন করবেন।’

নতুন রূপ পেয়েছে মাঠগুলো, ৫০ টি’র মতো মানসম্মত পাবলিক টয়লেট

নিজের চার বছরের সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে পুরান ঢাকার মাঠ ও পার্কের উন্নয়নে ‘জল সবুজে ঢাকা’ প্রকল্প বাস্তবায়নে নজির স্থাপন করেছেন মেয়র সাঈদ খোকন। সেই কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকায় অনেকগুলো কাজ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি।

আমাদের জলসবুজে ঢাকা প্রকল্প যেখানে মাঠগুলো দখল ছিল। ট্রাক স্ট্যান্ড ছিল সেগুলোকে আমরা দখলমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। পুরনো ঢাকায় এর মধ্যে কয়েকটি মাঠ উদ্বোধন করতে যাচ্ছি। আমাদের ১২ টি মাঠ ও ১৯ টি পার্ক করছি।

আমাদের শহীদ আব্দুল আলিম মাঠ যেটার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেই মাঠে আপনি গেলে মনে হবে ইউরোপের কোন মাঠে আছেন। অনেক কবরস্থান ও শশ্মানঘাট সংস্কার করা হয়েছে। সেখানে নিরাপদে দাফন করা যাচ্ছে। এখন উভয় সিটি করপোরেশনে পাবলিক টয়লেটগুলো স্ট্যান্ডার্ড।

ইতোমধ্যে আমরা ৫০ টি’র মতো মানসম্মত পাবলিক টয়লেট করতে সক্ষম হয়েছি। শান্তিনগর এলাকায় ৪০ থেকে ৫০ বছর যাবত জলাবদ্ধতা সমস্যা ছিল। বৃষ্টি হলে পানিতে তলিয়ে যেতো। আমি নিজে সেখানে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়েছি, অ্যাসেসমেন্ট করেছি।

এখন সেখানে জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর হয়েছে। নাজিম উদ্দিন রোডের জলাবদ্ধতা সমস্যা দূর করতে সক্ষম হয়েছি।

একসাথে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

গুছিয়ে কথা বলতে পারেন

উপস্থাপকের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের একটি গুণের প্রশংসা করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘তিনি (সাঈদ খোকন) খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। যতটুকু দরকার ততটুকু বলতে পারেন। আমি মনে করি এ গুণটা অনেক ভাল।’

আগামীকাল পড়ুন ডিএনসিসি’র মেয়র আতিকুল ইসলামের কথা

কালের আলো/এমআর/এএএমকে