অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৪৪

প্রকাশিতঃ 11:13 pm | October 07, 2017

আলম রায়হান|

আমার পরিচালনায় বছরপাঁচেক চলার পর অন্যরকম তৎপরতা শুরু হলো সাপ্তাহিক সুগন্ধায়। এক গ্রুপ সাংবাদিক খুবই সক্রিয় হয় উঠলেন। এরা সৈয়দ মোয়াজ্জেমকে লাগাতারভাবে বলতে লাগলেন, পত্রিকার মান আরো উন্নত করা সম্ভব। মান নিয়ে মায়াকান্না শুরু করলেন তারা। বুদ্ধিদাতাদের কেউ আবার কয়েক ধাপ এগিয়ে মোয়াজ্জেম সাহেবকে বুঝালেন, আলম রায়হান না থাকলে বছরে তার বেতন বাবদ নেট এক লাখ ৪৪ হাজার টাকা এবং অন্যান্য খরচ সেইফ হবে। পুর্নাইয়া পন্ডীত এ সাংবাদিকদের আমি বিভিন্ন মাত্রায় সুগন্ধার সঙ্গে সংযুক্ত করেছিলাম। এদের মধ্যে আজিজুল হক বান্না ছিলেন খুবই সক্রিয়। তিনি ঘনঘন মোয়াজ্জেম সাহেবের সঙ্গে মিটিং-সিটিং করতে লাগলেন। একই সঙ্গে তিনি আমার প্রতিও ভক্তি-শ্রদ্ধা-আনুগত্য বাড়িয়ে দিলেন। বান্না ভাই ভালো লিখতেন এবং সমানভাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন। সুন্দর করে কথা বলার মতো লোক বরিশাল অঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না; এ ক্ষেত্রে বান্না ভাই ছিলেন বেশ ব্যতিক্রম।

সুগন্ধায় আমার চরম ক্ষতি করা সত্ত্বেও বান্না ভাইর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম এক সময় সাপ্তাহিক ঝরণায় চাকরি পাবার সুযোগ করে দেবার কারণে; তখন আমার খুবই দুঃসময় চলছিল। অবশ্য দুঃসময় থেকে কখনই খুব একটা উঠে আসতে পেরেছি বলে মনে হয় না। সুগন্ধা পর্ব চুকেবুকে যাবার অনেক পরে ফসিল কৃতজ্ঞতার কারণে বান্না ভাইকে আমি ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সে-এ জনসংযোগ বিভাগের প্রধান হিসেবে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। এ পদের জন্য সৈয়দ মোয়াজ্জেমের প্রথম পছন্দের লোক ছিলেন মাসুদ কামাল। বিষয়টি আমি তাকে জানালে তিনি এক কথায় অস্বীকৃতি জানান। এ অবস্থায় বান্না ভাইর নাম প্রস্তাব করি। মোয়াজ্জেম সাহেব মৃগি রোগীর মতো মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘আরে সাহেব সে তো লোক ভালো না; আপনি তাকে সুগন্ধায় আনলেন আর সেই আপনার বিরুদ্ধে লাগলো!’ তিনি এমনভাবে বললেন যেনো সব দোষ কেবল আজিজুল হক বান্নার, তার নিজের যেন কোনোই দায় নেই।

আমি ওই প্রসঙ্গে না গিয়ে বললাম, এটি অনেক সাংবাদিকের মজ্জাগত স্বভাব; এ দোষ ধরতে গেলে ঠক বাছতে গাঁও উজার হবে। আর আপনার তো লোক লাগবে লেখালেখির জন্য; কোনো রকম আত্মীয়তা তো আর করবেন না। বান্না ভাইর লেখা অনেক ভালো; এ ছাড়া তার ভালো যোগাযোগ আছে। কয়েক দিন পর মোয়াজ্জম সাহেব রাজি হলেন। শুরু হলো বান্না ভাইর নতুন পেশার জীবন। তিনি প্রতিদিন আমাকে ফোন করতেন; অনুরোধ করতেন তার সঙ্গে লাঞ্চ করার জন্য। কিন্তু আমি খুব একটা যেতাম না সময়ের অভাবে। মাস কয়েক পর তার নতুন অফিসে একদিন আমার হাত চেপে ধরে বান্না ভাই বলেছিলেন, ‘আলম, আমাকে মাফ করে দিয়ো ভাই!’ এ সময় তিনি কেঁদে ছিলেন, আমার চোখেও পানি এসেছিল। কবিতার সেই চরনের মতো, ‘মিরার চোখে জল!’

আমার ধারণা, পত্রিকার মান বৃদ্ধির বায়বীয় প্রলোভন নয়; বছরে প্রায় দেড় লাখ টাকা সেইফ হবে- এই টোপ মিনি মাছের (যাকে বরিশাল অঞ্চলে বলা হয়, ভেদি মাছ) মতো পুরোটাই গিলেছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন। এ ছাড়া পুরনোর প্রতি অনুরাগ কমে যাবার সাধারণ প্রবণতা তো ছিলই। ক্রমাগত সার্কুলেশন বৃদ্ধির সঙ্গে সমান তালে সম্পৃক্ত থাকার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এক রকমের অদৃশ্য চাপ ছিল পত্রিকার উপর। প্রতি সংখ্যায় সার্কুলেশন বাড়াতে গিয়ে  প্রডাকশন খরচ বাড়তো। কিন্তু এ বাড়তি খরচ থেকে রিটার্ন আসতে সময় লাগতো অন্তত দুই মাস। এদিকে সিন্ডিকেটবাজির কারণে নিউজ প্রিন্টের দাম হঠাৎ লাগাম ছাড়া পাগলা ঘোড়া হয়ে গিয়েছিল।  ১৫-১৮ টাকা থেকে বেড়ে প্রতি কেজি নিউজপ্রিন্টের দাম দাঁড়ালো ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। সব মিলিয়ে প্রডাকশন খরচের চাপ প্রচণ্ড বেড়ে গেল। ফলে বছরের কোনো এক সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় এক লাখ টাকা রেড হতো; আবার কখনো পাঁচ/ছয় লাখ টাকা জমাও থাকতো। কিন্তু ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সুস্বাস্থ্য নয়, রুগ্ন দশাটিই বেশি করে চোখে পড়তো সৈয়দ মোয়াজ্জেমের। সন্তানের বেলায় মায়ের যে প্রবনতার কথা বলা হয়। তবে এ দুই ঘটনায় পার্থক্য হচ্ছে মৌলিক।

বছরের কোনো এক সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রেড হওয়া নিয়ে সৈয়দ মোয়াজ্জেম মৃদু অস্বস্তিত প্রকাশ করতেন। পত্রিকার অ্যাকাউন্ট ছিল পূবালী ব্যাংক-এর স্টেডিয়াম শাখায়। এ ব্যাংকের স্পন্সর ডাইরেক্টর সৈয়দ মোয়াজ্জেম ব্যাংকের কাছে খুবই ক্লিন থাকতে চাইতেন। তিনি এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হবার স্বপ্ন দেখতেন। যদিও সেই স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি, যেমন সফল হয়নি সংসদ সদস্য হবার স্বপ্ন। তিনি এখন পর্যন্ত কোনো দলের মনোনয়ন লাভ করতে পারেননি। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি বিএনপির পেছনে ঘুরেছেন। এজন্য তার অনেক শ্রম ও নগদ বিনিয়োগ আছে। এটি করতে গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের হয়রানিরও শিকার হয়েছেন। নাশকতা পরিকল্পনার হাস্যকর অভিযোগে জেলেও গিয়েছেন। কিন্তু বিএনপি কাছ থেকে তিনি কিছুই পাননি। শেষতক অনেকটা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে শওকত হোসেন হিরনের অকাল মৃত্যুর পর বরিশাল সদর আসনে উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবার উদ্যোগ নেন। কিন্তু এতেও তিনি ব্যর্থ হন। সমর্থনকারীদের তালিকায় মৃত ভোটারের নাম থাকায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়, ফলে মরহুম হিরনের স্ত্রী জেবুন্নেসা আফরোজ নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এ ঘটনায় ৫ জানুয়ারির সাজানো নির্বাচনের চেয়েও আওয়ামী লীগ সরকারের নির্লজ্জ রূপ দেখেছে বরিশালবাসী। যা হার মানিয়েছে জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের নির্জলজ্জতাকেও। তবে খালেদা সরকারের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কলংক এখনো অধরাই থেকে গেছে; এই যা সান্ত্বনা। তবে আগামী নির্বাচনে ৫ জানুয়ারি ও ১৫ ফেব্রুয়ারির কলঙ্ক ছাড়িয়ে যাবে কি না তা নিয়ে নানান ধরনের জল্পনাকল্পনা আছে সাধারণের মধ্যে।

রাজনীতির পথ চলায় চরম ব্যর্থতার প্রতীক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন বিনিয়োগকারী হিসেবে শুরু থেকেই আছেন সাফল্যের প্রথম সারিতে; এক সময় তিনি বিদ্যুৎ খাতের ব্যাবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ব্যাংক-বিমা ব্যবসার ক্ষেত্রেও তার সাফল্যও অনেকের কাছে ইর্ষণীয়। তবে ব্যর্থ হয়েছেন গার্মেন্টস ব্যবসায় অজ্ঞাত কারণে। এদিকে সাফল্যের চূড়ায় উঠেও শেষতক ব্যর্থতায় সমাপ্তি টেনেছেন পত্রিকা ব্যবসায়। অন্যসব ব্যবসা থেকে পত্রিকাকে তিনি ভিন্নভাবে দেখতেন, ব্যবসার বাইরেও পত্রিকার সঙ্গে তার অন্যরকম আবেগ জড়িত ছিল। আর পত্রিকার মালিক হিসেবে তিনি ছিলেন অন্য রকম এক উচ্চতায়।

সুগন্ধা চালাবার জন্য মোজাম্মেল ভাইর চাহিদা মতো নির্দিষ্ট একটি ফান্ড পত্রিকার অ্যাকাউন্টে দেয়া হয়েছিল। এরপরও তিনি বেতনের বিষয়ে বেশ সংবেদনশীল ছিলেন। পত্রিকা ব্রেক ইভেনে যেতে প্রায় ছয় মাস সময় লেগেছিল। এ সময় মোয়াজ্জেম সাহেবের অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলিয়ে পহেলা তারিখেই সুগন্ধার বেতন দেয়া হতো। এ ক্ষেত্রে টাকার ঘাটতি হলে লোন হিসেবে পত্রিকার অ্যাকাউন্টে টাকা দিতেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন। যা পরে ফেরত দিতে গেলে বলতেন, এখন থাক পরে নেব; যা কোনোদিনই আর নেয়া হয়নি।

নির্ধারিত দিনে বেতন দেয়া কেবল নয়, পত্রিকার অন্যান্য বিষয়ও বেশ সংবেদনশীল ছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম। একদিন আমাকে বললেন, আপনারা স্পাইট খান কেন? কোক খাবেন।

: কোক কেন?

: আরে ভাই, আমার অন্য ব্যবসার লোকজন আপনাদের পছন্দ করে না। তারা আপনাদের আন্ডার ইস্টিমেট করে। আপনারা খান স্প্রাইট; তারা মনে করে পানি! কোক খেলে কালারে বুঝতে পারবে। পরিচালক হিসেবে পাওয়া পূবালী ব্যাংকের গাড়িটি তিনি আমাকে দিয়েছিলেন উত্তরার বাসা থেকে মতিঝিলের অফিসে যাওয়া আসার জন্য। এর আগে গোড়ান এলাকা থেকে উত্তরায় বাসা বদল করার বিরোধী ছিলেন তিনি। আমাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বলেছিলেন, ‘উত্তরা গেলে বৌ রাখতে পারবেন না!’ যদিও এখনো বৌ আমার সঙ্গেই আছে। সৈয়দ মোয়াজ্জেম একবার ঈদে বললেন, ‘আলম রায়হান এক কাজ করেন, পূবালী বাংকের গাড়িটা নিয়ে বন্ধের কয়দিন ঘোরেন।’ আমি এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আরে সাহেব! বরিশালের মেয়েরা তো স্বামীদের গোনায় ধরে না; আপনাদের অবস্থা আরো খারাপ। গাড়িতে করে ঘুরলে হয়তো গুরুত্বটুরুত্ব পাবেন।’ আমি বললাম, এটা ঠিক হবে না। এতে তার অন্যরকম প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে; তখন হয়তো প্রায়ই ঘুরতে চাইবে। কিন্তু আমিতো তা অ্যাফোর্ড করতে পারবো না, তখন সে অন্যের গাড়িতে ঘুরতে চাইতে পারে। আমার বক্তব্যের পর সৈয়দ মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে আর কথা বলেননি। কয়েক দিন পর তিনি আমার বাসায় টেলিফোন দিতে চাইলেন। সে সময় টেলিফোন মানেই ছিলো টিএন্ডন্টি এবং যা ছিল অনেকটাই সোনার হরিণ। গাড়িতে ঘোরা নিয়ে তেমন আগ্রহ প্রকাশ না করলেও টেলিফোনের বিষয়য়ে খুবই আগ্রহী ছিলেন আমার স্ত্রী; সুবিধার চেয়েও হয়তো বিষয়টিকে মর্যাদার দৃষ্টিতে বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু আমি রাজি হইনি আজানের আগ থেকে রাত তিনটা পর্যান্ত মোয়াজ্জেম সাহেবেবের ফোনের আশংকায়।

কর্নেল আকবরের কাছে শুনেছি, জেনারেল জিয়াউর রহমান মন্ত্রী-গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা-ডিসি-এসপিদের ফজরের নামাজের পর থেকে শুরু করে রাত তিনটা পর্যন্ত ফোন করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় একবার রাত তিনটার দিকে প্রেসিডেন্টের ফোন পেলেন মন্ত্রী আকবর হোসেন। প্রেসিডেন্ট বললেন, আকবর কী করছো? ঘুমে ব্যাঘাত হওয়ায় বিরক্ত হয়ে আকবর হোসেন বলেছিলেন, ‘আপনি জানে না এতো রাতে মানুষ কী করে!’ জিয়াউর রহমান শান্তভাবে বলেছিলেন, ‘রাগ করো কেন! তেল পাওয়া গেছে, মোনাজাত করো।’ বিষয়টি পরে ‘তেল মোনাজাত’ হিসেবে প্রচারণা পেয়েছিল।

পত্রিকার বিষয়ে কোনো রকম হস্তক্ষেপ না করলেও বিভিন্ন বিষয়ে আইডিয়া দিতেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম। এগুলো তিনি লিখে নিয়ে আসতেন বাসা থেকে, অফিসে বসেও লিখতেন অন্য কাজের ফাঁকে। তার হাতের লেখা ছিল অদ্ভূত। যা অন্যের পক্ষে পড়া প্রায় অসম্ভব। বিষয়টি নিজেও জানতেন। ফলে তিনি নিজেই পড়ে শোনাতেন আর আমি নোট নিতাম। কখনো তিনি এগুলো লিখতেন গভীর রাতে অথবা খুব ভোরে। এ ঘটনা জানা ছিল বলেই বাসার টেলিফোন সংযোগ দেবার প্রস্তাবে রাজি হইনি। প্রসব বেদনার মতো আইডিয়া ডেলিভারি হবার তো কোনো ধরাবাধা সময় থাকে না। ফলে রাতের ঘুম হারাম করার টেলিফোনের ‘ফাঁদে’ পা দিইনি। এতে তিনি খুবই ‘মর্মাহত’ হয়েছিলেন। শুধু টেলিফোন নয়, ট্যান্সপোর্ট সুবিধা, অবসরে বিনোদনসহ আমার সকল সুবিধার বিষয়ে বেশ সংবেদনশীল ছিলেন সুগন্ধার মালিক সৈয়দ মোয়াজ্জেম। এমনকি তিনি আমাকে ব্যাংক ঋণসহ আরও অনেক সুযোগ সুবিধা দিতে চেয়েছিলেন অতি আপনজনের মতো। সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন কারণে-অকারণে প্রায়ই বলতেন, ‘আলম রায়হান পত্রিকা কিন্তু আপনার।’ কিন্তু তিনি যখন মনে করলেন, আমাকে ছাড়াই চলবে তখন নিলেন ইউটার্ন!

ছবিসৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন  আজিজুল হক বান্না

লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক; ই-মেইল: alamraihan71@gmail.com