রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে তৎপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
প্রকাশিতঃ 12:00 pm | June 27, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
মানবিক কারনে মিয়ানমারের বাস্তুচুত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ ঠাঁয় দিয়েছিল। কিন্তু অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়া এসব রোহিঙ্গাদের এখনো প্রত্যাবাসন করাতে পারছে না বাংলাদেশ। সরকার সব ধরনের চেষ্টা করলেও মিয়ানমারের অসহযোগীতায় তা আর সফল হচ্ছে না।
বরং দিনের পর দিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা রোহিঙ্গারা ভয়ংকর হয়ে উঠছে। স্থানীয়দের জন্যে হুমকি হয়ে উঠা এসব রোহিঙ্গারা দেশের নিরাপত্তার জন্যেও হুমকি।
এ কারনেই দেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি নতুন পরিকল্পনার পথ ধরে হাটছে সরকার । মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা এ দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রতিশ্র্ত না রাখায় সরকার বিষয়গুলোকে বিশেষ উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক নানা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর কুটনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তাদের ফেরত পাঠানো ছাড়া আর বিকল্প সমাধানের কথা ভাবছে না সরকার।
কূটনৈতিক সুত্র জানায়, বাংলাদেশের অসহযোগিতার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হচ্ছে- মিয়ানমারের ছড়ানো এমন অপপ্রচারের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশ প্রকৃত তথ্য বিশ্বদরবারে জোরালোভাবে তুলে ধরছে। মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য সব ধরনের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে সরকার । রাখাইন রাজ্যে যথাযথ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক মহল মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে।
তবে মিয়ানমারের অসহযোগিতা সত্তেও সমস্যার সমাধানে দ্বিপক্ষীয় ও বন্ধুপক্ষীয় দুটি পথই খোলা রাখছে সরকার ।
রোহিঙ্গ৷ ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গতকাল বুধবার(২৬ জুন) সংসদে বলেন, দ্রুত ফেরত পাঠাতে না পারলে দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা অধিবাসীরা অসন্তুষ্টিতে ভুগছে। তাদের অনেক অভাব-অভিযোগ রয়েছে। তাদের প্রত্যাবাসনে সরকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’
ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকদের সম্প্রতি লেখা এক চিঠিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, “মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বান্তচ্যুত বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বোঝা অনির্দিষ্টকালের জন্য বহন করতে বাংলাদেশ সক্ষম নয়। যুগের পর সরে লিউিরিভিযর রিভিশন হলে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও ছিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে ।’
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন দেশের সরকার ও সিভিল সোসাইটিকে সংশ্লিষ্ট করতে বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন দেশের অনারারি কনসাল জেনারেল ও বিদেশে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেলদের চিঠিতে অনুরোধ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দ্বিপক্ষীয় সফর, আন্তর্জাতিক সম্মেলন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সংগঠনের সম্মেলনে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো ও বন্ধুরা্ট্রগুলোর সহযোগিতার প্রসঙ্গকে বেশি গুরত্তু দিচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আক্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে বাংলাদেশ ।
এ সংকটকে ঘিরে যাতে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি না হয়, সে সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতেও অনুরোধ করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের আর্থিক, সামাজিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়ে বিদেশিদের কাছে তুলে ধরার পরিকল্পনাও করছে সরকার ৷
এশিয়ার শক্তিশালী দুদেশ ভারত ও চীনকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পাশে চায় বাংলাদেশ । তবে বিশ্বের পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কৌশলগত গুরুতৃ তৈরির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে নানা দেশের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে সরকার ।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব পাবে। প্রতিবেশী ও সর্বোচ্চ মাত্রার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে মিয়ানমারের ওপর সব অর্থেই রয়েছে অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের ব্যাপক প্রভাব ।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে পুরো বিশ্ব যখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে, তখনো বরাবরই চীন আছে পাশে । সমান্তরালে টীন শক্ত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাখছে বাংলাদেশের সঙ্গেও । তাই প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক অনেক কিছুর প্রত্যাশা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেবকরাও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ভারতেরও আরো জোরালো ভূমিকা চায় বাংলাদেশ ।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে মোমেন তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ভারতকে বেছে নেন। গত ফেব্রুয়ারিতে তি নয়াদিল্লি সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুবমা স্বরাজের কাছে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে নতুন প্রস্তাব দেন বাংলাদেশের পক্ষে ।
প্রস্তাবে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ‘সেফ হেভেন’ বা নিরাপদ এলাকা তৈরি করে সেখানে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক । ওই এলাকায় রোহিঙ্গারা নির্ভয়ে, নিরাপদে, টেকসই জীবন নির্বাহ করতে পারছেন কি না, তা দেখভালের দায়িত্ব নিক মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো । সেই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে থাকুক ভারত, চীন ও আশিয়ান সদস্যভুক্ত দেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃতেে চলতি বছরের দায়িত্ব নেওয়ার সময়ই চিরবৈরী দুদেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চোখ তখন দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের চেয়ে ভারত ও পাকিস্তানের ‘যুদ্ধাবস্থার’ দিকে বেশি চলে যায়।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার পরিছিতি অনেকটা শান্ত হয়ে আসায় ও ভারতে লোকসভার নির্বাচনের পর রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন কৌশলে পুরো উদ্যমে কাজ করছে সরকার ।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী কয়েক মাসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসেছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ।
সবমিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়েছে। মানবিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের দেশে আশ্রয় দেন।
চরম নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে তার সরকার যুক্তিসংগতভাবে ও শীল্তিপূর্ণ কুটনৈতিক তৎপরতা এবং আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার সরকার মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও গেছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগের সুযোগও খোলা রাখে সরকার । ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের সঙ্গে সরকারের প্রত্যাবাসন সইয়ের পরও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় একজন রোহিজগও ফিরে যাননি ।
কালের আলো/এআর/এমএম