দাঁত দিয়ে চালের আদ্রতা ‘পরখ’ খাদ্যমন্ত্রীর, ছুটছেন দুর্নীতি বন্ধে!
প্রকাশিতঃ 11:11 pm | July 03, 2019
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :
গাড়ি থেকে নেমেই সোজা গুদামের দিকে ছুটলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। সেখানে প্রবেশ করেই খামাল কার্ডে চোখ বুলিয়ে বস্তায় নিজেই বুঙ্গা মারলেন। বেরিয়ে এলো চাল। সেই চাল ট্রেতে রেখেই গুদামের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। চালের আদ্রতা মাপার মেশিন আনতে বলেই এক চিমটি চাল মুখে ভরে দাঁতে চিবিয়ে হলফ করে বলে দিলেন আদ্রতা ১৩ শতাংশ।
কিন্তু ময়েশ্চার মেশিনে আদ্রতা দেখালো ১৪.৩ শতাংশ। মন্ত্রী উচ্চারণ করলেন- মেশিনে ত্রুটি আছে। পরিমরি করে আরেকটি মেশিন নিয়ে এলেন জেলা রাইসমিল মালিক সমিতির সভাপতি খলিলুর রহমান। অত:পর মেশিনে আবারো চাল ঢুকিয়ে আদ্রতা মিললো ১৩ শতাংশই! চোখ ছানাবড়া গুদামের ম্যানেজার থেকে শুরু করে অন্য কর্মকর্তাদেরও।
এ তো গেলো চালের আদ্রতা মাপতে মন্ত্রীর কৌশল। আর ধানের মান পরীক্ষা করতেও নিজের অভিজ্ঞ কৌশলেই সবাইকে অবাক করলেন। হাতের তালুতে ধান রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঢলা দিয়ে বের করলেন চাল। আবারো মুখে চাল নিয়ে আদ্রতার পরিমাণ বলার পর ‘পাকা জহুরির’ মতোই বলে দিলেন এ ধান বৃষ্টিতে ভিজেছে বেশি। পরে রোদে শুকানোর ফলে এ চাল ভেঙে যাবে।
এক রকম ঘোরের মধ্যেই পড়ে গেলেন সবাই। কৃষক পরিবারের সন্তান খাদ্যমন্ত্রী এভাবেই চমকে দিলেন ময়মনসিংহে। দিনমান নগরীর কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদামে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান দেখতে এসে গুদাম কর্মকর্তাদের ধান-চালের আদ্রতা মাপার এমন অভিনব কৌশলই দেখিয়ে দিলেন।
বুধবার (০৩ জুলাই) সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত প্রায় ১৩ ঘন্টার ময়মনসিংহ সফরে ময়মনসিংহের ত্রিশাল, সদর উপজেলা, ফুলপুর ও তারাকান্দা উপজেলার চারটি উপজেলা খাদ্যগুদাম পরিদর্শন করে এভাবেই ধান-চালের আদ্রতা পরিমাপ করে চমক তৈরি করলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মুজমদার এমপি।
এসব খাদ্য গুদাম পরিদর্শনকালে মন্ত্রী কোন প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতি না করার জন্য খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সতর্ক করে বলেছেন, খাদ্য বিভাগ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নাম মানুষের মুখে মুখে। এ দুর্নাম গুচাতে এবং সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরাতেই আমি নিজেই মাঠে নেমেছি। চলতি ধান-সংগ্রহ অভিযান দেখতে খাদ্য অধিদপ্তরের ২০ টি টিমও গোটা দেশের খাদ্যগুদামগুলোতে হানা দিচ্ছে বলেও জানালেন মন্ত্রী।
দেখা গেছে, বুধবার (০৩ জুলাই) সকাল ১০ টায় ত্রিশালের ধানীখোলা খাদ্যগুদামে উপস্থিত হয়ে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম পরিদর্শন করেন মন্ত্রী। এরপর তিনি পর্যায়ক্রমে দিনমান ময়মনসিংহ সদর উপজেলা খাদ্য গুদামে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম, ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজে খাদ্য বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সাথে বোরো সংগ্রহ কার্যক্রম বিষয়ক মতবিনিময় সভা, ময়মনসিংহ সিএসডিতে নির্মানাধীন রাইস সাইলো পরিদর্শন করে বিকেল ৫ টায় তারাকান্দা উপজেলা খাদ্যগুদামে উপস্থিত হয়ে এর কার্যক্রম পরিদর্শন করে বিকেল সোয়া ৫ টায় ফুলপুর উপজেলা খাদ্য গুদাম পরিদর্শন করেন। পরে সন্ধ্যা ৭ টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তিনি।
এসব পরিদর্শনকালে মন্ত্রীর সঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) পরিমল চন্দ্র সরকার, ঢাকার আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জামাল হোসেন, ময়মনসিংহ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি ফুড) জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
দেড়শ উপজেলায় পুষ্টি চাল
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার কালের আলোকে জানিয়েছেন, সরকার দেশের ১৪ উপজেলায় পুষ্টি চাল দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে আরো ১০০ উপজেলায় এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আরো ৫০ উপজেলায় পুষ্টি চাল দেওয়া হবে। যাদের ভিজিডি চাল দেওয়া হয় তাদের পুষ্টি চাল দেওয়া হবে।
ফুড ডিপার্টমেন্টের দুর্নীতি দূর করতেই মাঠে নেমেছি
মন্ত্রী বলেন, ভাল করলেও ফুড ডিপার্টমেন্টের দুর্নাম আছে। এটা দূর করতেই আমার মাঠে নামা। এটার ব্যত্যয় ঘটলে সর্বোচ্চ অ্যাকশনে যাবো। ধানীখোলা খাদ্য গুদামের এক কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আপনাদের চলার মতো ব্যবস্থা সরকার করে দিয়েছে। এখান থেকে সরে আসতে হবে।
জয়দেবপুরে সারপ্রাইজ ভিজিট
ময়মনসিংহে খাদ্যগুদামগুলোর ধান চাল সংগ্রহ অভিযান দেখার বিষয়টি সফরসূচিতে ছিল খাদ্যমন্ত্রীর। কিন্তু ময়মনসিংহে আসার পথেই সকাল ৯ টা ২৩ মিনিটে গাজীপুরে থামলেন তিনি। প্রবেশ করলেন জয়দেবপুর খাদ্যগুদামে।
জয়দেবপুরে এবার বোরো মৌসুমে ধানের বরাদ্দ ছিল ৯৬৮ টন। কিন্তু সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ৫১ টন। এরপর তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধানীখোলা খাদ্যগুদাম পরিদর্শন করেন। সেখানে দেখা যায়, সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার ৫৩৬ টন। কিন্তু সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১৭০ টন। ধান সংগ্রহের পরিমাণ কম হওয়ায় মন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
দুই গোডাউন সিলগালা
ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদামের দু’টি গোডাউনের চালের মান কাঙ্খিত না হাওয়ায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন মন্ত্রী। পরে তিনি গোডাউন ২টি সিলগালা করার নির্দেশ দেন
এছাড়াও খাদ্য অধিদফতরের পরিচালকের (প্রশাসন) নেতৃত্বে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেন।
রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগ পরিদর্শনে যাবেন খাদ্যমন্ত্রী
ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগসহ এ পর্যন্ত চারটি বিভাগের খাদ্যগুদামসমূহ পরিদর্শন করেছেন খাদ্যমন্ত্রী। এরপর পর্যায়ক্রমে তিনি রংপুর, খুলনা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের খাদ্যগুদামগুলোও আকস্মিক পরিদর্শনে যাবেন বলে জানিয়েছেন কালের আলোকে।
কালের আলো/এসএম/এএ