‘অগ্নিঝরা’ সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী, কন্ঠে ছাত্র রাজনীতির সেকাল-একাল
প্রকাশিতঃ 11:04 pm | July 31, 2019
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :
তপ্ত দুপুর। স্বচ্ছ আকাশে চড়া রোদ্দুর। এমন আবহেই সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমাপনী দিনে কলেজ অডিটোরিয়ামে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন শান্ত ও সৌম্য একজন। বরাবরই তিনি কথা বলেন শিল্প-সুন্দর ভাষায়। তাঁর বক্তব্যে থাকে নির্মোহ বাস্তবতার অমোঘ সত্য। ভেতরে যা অনুভব করেন তাই অবলীলায় বলেন ৪৮ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ এ ঝানু রাজনীতিক।
কিন্তু এদিনটিতে যেন নিজের ছাত্র রাজনীতির টগবগে সময়টাতে ফিরে গেলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাবু এমপি। জাতির দুর্যোগময়, বিপদ সঙ্কুল মুহুর্তে তিনি ছিলেন শিক্ষা নগরী ময়মনসিংহের গর্বের প্রতিষ্ঠান আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি।
নিজের ছাত্র রাজনীতির উন্মেষের ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়েই কী না ‘অগ্নিঝরা’ হয়ে উঠলো তাঁর কন্ঠ। প্রকৃতির রুদ্ররূপে তিনি উপস্থাপন করলেন ছাত্র রাজনীতির সেকাল-একাল। চলমান ছাত্র রাজনীতির নানা অসঙ্গতি বলে গেলেন, ছাত্র রাজনীতির গুণগত মান ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন। একটি কলেজে ছাত্র সংসদ কেন গুরুত্বপূর্ণ সেই তথ্য উপস্থাপন করলেন।
নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা প্রতিমন্ত্রীর ১৩ মিনিটের বক্তব্য শুনলেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। কখনো তুমুল করতালি আবার কখনো বিস্ময়ভরা চোখে নতুন মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার প্রেরণা খুঁজে পেলেন। এসব ঘটনা প্রবাহ বুধবার (৩১ জুলাই) দুপুরের।
নগরীর আনন্দমোহন কলেজে ৫ দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক সপ্তাহের সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এমন চেহারাতেই ধরা দিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ও ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনের সংসদ সদস্য কে এম খালিদ বাবু।
প্রতিমন্ত্রী কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবির প্রেক্ষিতে কলেজে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য ৫ লাখ টাকা অনুদানের ঘোষণা দেন। পাশাপাশি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সব কর্মকান্ডেই মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতার অঙ্গীকারও করেন।
শপথ নিতে পারেননি ভিপি হয়েও
১৯৭২ সালের পর শিক্ষা নগরী ময়মনসিংহের গর্বের প্রতিষ্ঠান আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের (আমোকসু) ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি। কিন্তু ফলাফল ঘোষণার পরেও শপথ নিতে পারেননি তিনি। কিন্তু কেন শপথ নিতে পারেনি সেই ঘটনা ৪৭ বছর পর আবারো উপস্থাপন করলেন।
বললেন, ‘আমি এই কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচন করেছিলাম। মাত্র সাড়ে ১৫ বছর বয়সে আমি নির্বাচন করেছিলাম। ভিপিও হয়েছিলাম কিন্তু ফলফল ঘোষনার পরও আমরা শপথ নিতে পারিনি। জিয়াউর রহমানের সেই গুন্ডাবাহিনী আমাদের চরমভাবে নির্যাতন করেছিল।
আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তখন আজিজ আহমেদ স্যার। তার গলায় গামছা বেধে তার রুম থেকে টেনে হিচড়ে কৃষ্ণচূড়া চত্বর পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল ছাত্রদলের সেই সোনার ছেলেরা! আমার ওপর আক্রমন করা হয়েছিল, গুলি করা হয়েছিল। আমি সেই কবরস্থানের সাত ফুট উঁচু দেয়াল, সেই দেয়াল এক লাফে পাড় হয়ে কবরস্থানে ওপর পড়ে জীবন রক্ষা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমার হয়তো রাজনৈতিক ইতিহাস তত উজ্জল হবে না। তারপরও রাজনীতির ইতিহাসে আমি ৪৮ বছর। একটানা রাজনীতির সাথে আছি।’
কেন ‘অপরিহার্য’ আমোকসু?
প্রায় দেড় যুগেরও বেশি সময় যাবত শিক্ষা নগরী ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের (আমোকসু) নির্বাচন না হওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রতিমন্ত্রী। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ছাত্র রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্যই শিগগির ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে চূড়ান্ত বার্তা দেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আনন্দমোহন কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সময়ের দাবি। ছাত্রদের পরিবর্তন হওয়ার জন্য যত কষ্টই হোক, একটু রিস্ক নিয়ে নির্বাচন দিন। এ নির্বাচনের অভাবেই ছাত্র রাজনীতিতে গুনগত কোন ছেলে উঠে আসছে না।’
একটি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হবে ততদিন ছাত্র রাজনীতির গুনগত কোন পরিবর্তন হবে না। একজন শিক্ষার্থী যখন সিদ্ধান্ত নেয় আমি এই কলেজের ভিপি, জিএস বা ক্রীড়া সম্পাদক হবো। তখন তাঁর আচরণের পরিবর্তন আসবে।
তখন সে চিন্তা করবে আমাকে নির্বাচন করতে হবে ভোট পেতে হবে। কৃষক শ্রমিকের সন্তান যারা এখানে পড়ে তারা প্রবল আগ্রহ কিংবা প্রতিবাদের মধ্যদিয়ে সেদিন সেই ভোটটি প্রয়োগ করবে। একটা ছাত্র যখন নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় তখন সে তার গুনগত মান নিশ্চয়ই পরিবর্তন করবে। নয়তো নির্বাচনের দিন প্রতিবাদী সেই নিরীহ ছাত্রটি ভোট দিবে তাঁর বিপক্ষে।’
প্রতিমন্ত্রীর তীক্ষ্ণ চোখে শিক্ষার্থী উপস্থিতি
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ১৯৭২ সালের পর আমি এ কলেজের ছাত্র ছিলাম। সাড়ে ১৫ বছর বয়স তখন আমার। ওই সময় কলেজের ছাত্র সংখ্যা ছিল ৪ থেকে ৫ হাজার। এখন কলেজের ছাত্র সংখ্যা ৩৭ হাজার। সেই সময়ে যখন এই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান হতো, তখন ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়ে জায়গা হত না। বসতে হতো বাইরে।
আর এখন ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী। অথচ অডিটোরিয়ামে উপস্থিতির হার খুবই বেদনাদায়ক। যারা তোমরা আছো, তোমরা অন্তত শেষ সময়টুকু পর্যন্ত থেকো। না হলে বড় দরিদ্র হয়ে যাবে আজকের এই অনুষ্ঠানটি।
তিনি বলেন, এখানে ২০৭ জন শিক্ষক, তাঁরা আছেন আর আমার ক্ষুদে বন্ধু আছে ৩ থেকে ৪ শ’। কোয়ানটিটি দিয়ে লড়াই করা যায় না, কোয়ালিটি তৈরি করতে হবে। ৩৭ হাজার স্টুডেন্ট। এর মধ্যে ১৮ হাজার মেয়ে, কোথায় তারা? এত বড় অনুষ্ঠান।
আনন্দমোহনের গৌরবময় ইতিহাস
শিক্ষা নগরী আনন্দমোহন কলেজ তৈরি করেছে অনেক গুণী মানুষ। এ বিষয়টি সম্পর্কে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, অধ্যাপক কবির চৌধুরী একসময় এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। প্রথিতযশা ব্যক্তি যিনি স্বাধীনতার পক্ষে আজীবন লড়াই করেছেন। তার ভাই শহীদ মুনির চৌধুরী। তিনি এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। সেই সময়ের অবস্থা কিভাবে হারিয়ে গেল। কিভাবে হল এই অবক্ষয়? কি হবে অট্টালিকা তৈরি করে? আমার সোনার মানুষ চাই।
কে তৈরি করেছে এ লড়াই?
প্রতিমন্ত্রীর নজরে এলো জেলা ছাত্রলীগ ও কলেজ ছাত্রলীগের দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের বিষয়টিও। কলেজ ছাত্রলীগের বাঁধার মুখে অনুষ্ঠানে প্রবেশ করতে না পেরে গেইটের বাইরেই অবস্থান নিয়ে কাঁদেন জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রকিবুল ইসলাম রকিব। তাঁর বিরুদ্ধে ইত্যাকার অভিযোগ কলেজ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের।
এ বিষয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাবু এমপি বলেন, আমার এখানে অনুষ্ঠান অথচ গেইটে লড়াই চলছে। একদল ঢুকবে, আরেকদল ঢুকতে দিবে না। কিসের লড়াই? কার জন্য এই লড়াই? এই লড়াই তৈরি করেছি আমি না হয় আপনি। আমার সামনে বসা এই তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের কোন দোষ নেই।
তারা নিরপরাধ। আমরা নিজেদের লাভবান করার জন্য, নিজেদের লাভ লোকসান হিসেব নিকেষ মিটিয়ে দিবার জন্য, পুষিয়ে নিবার জন্য আজকে লড়াই তৈরি করে দিয়েছি।
নিজের বিরুদ্ধে নিজের অভিযোগ
নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কাজী খালিদ বাবু’র। অনুষ্ঠানে নিজের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উত্থাপন করলেন তিনি। বললেন, ‘আপনারা আজ হয়তো কষ্ট পেয়েছেন আমার এসব অভিযোগের ভিত্তিতে। অভিযোগ তো আমার বিরুদ্ধেও।
সরকারের এত বড় একটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর আমি তো একদিনও এই কলেজে এসে দেখিনি আমার সোনার ছেলে-মেয়েরা কি করছে? আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মন্ডলীর অভাব-অভিযোগ কি আছে? দোষ আমারও। অপরাধ আমিও করেছি আপনাদের সাথে সাথে, দায়ভার আমারও আছে।
একদিন আপনাদের জয়গান গাইবো
অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কেন চড়া করলেন নিজের কন্ঠস্বর এমন ব্যাখ্যাও দিলেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আজকের এ খুশির দিনে আমি হয়তো বেদনার দু’টি কথা বলেছি। কিন্তু সেটি আমার প্রয়োজন ছিলো। নিজেদেরকে শোধরানোর জন্য হলেও প্রয়োজন ছিলো।
আমরা যদি আমাদের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমস্ত ভুলভ্রান্তিগুলোকে ধরে নিয়ে এটির যদি পয়েন্ট আউট করে শোধরানোর চেষ্টা করি, নিশ্চিয়ই আগামী কোনদিন এই মঞ্চে দাড়িয়ে আপনাদের জয়গান গাইবো। আমি বলবো- সেদিন যে অভিযোগ আমি তুলেছিলাম সেই অভিযোগ আমি আপনাদের সামনে থেকে প্রত্যাহার করে নিলাম। এমন একটি ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আপনারা করবেন।
কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক নারায়ন চন্দ্র ভৌমিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র মো: ইকরামুল হক টিটু, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইউসুফ খান পাঠান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি হোসাইন জিল্লুর। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক মো: নুরুল আফছার।
কালের আলো/এসআর/এএ