বামাকো শহরে সড়কে নেই বিশৃঙ্খলা, রাজত্ব ছোট যানের

প্রকাশিতঃ 12:36 pm | September 17, 2019

অ্যাক্টিং এডিটর, কালের আলো, বামাকো (মালি) ঘুরে এসে :

চোখের সামনে সড়ক বা মহাসড়ক মানেই বিশৃঙ্খলা! মোটর সাইকেল থেকে শুরু করে গণপরিবহনের নিয়ম না মানার দৃশ্য! এসব যেন একেবারেই বেমানান বামাকো নগরীর সঙ্গে। এখানে উল্টোপথে চলে না কোন যানবাহন। সড়ক বা মহাসড়কে নেই কোন অবৈধ স্থাপনা। বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোর প্রবণতাও নজরে আসে না।

আরও পড়ুন: ঢাকা থেকে আকাশযাত্রায় বিশ্বের সবুজ বিমানবন্দর ইস্তাম্বুলে

এখানে ট্রাফিক আইন মানার বহমান সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম চালক থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারীরাও। ফলে যানবাহন চালক, যাত্রী ও পথচারী সবাই সচেতন হওয়ায় শৃঙ্খলা রয়েছে সড়কে। নিয়মের শেকলে বন্দি থাকায় বামাকোর বুকে সড়ক দুর্ঘটনাই যেন অস্বাভাবিক এক ব্যাপার!

আবার এটাও ঠিক পশ্চিম আফ্রিকার মরুর দেশ মালির এ প্রধান নগরীতে কোন মোটরসাইকেল আরোহী অভ্যস্ত নন হেলমেট ব্যবহারে। এমনকি শতকরা ৯৫ ভাগ মোটরসাইকেলেরই নেই লাইসেন্স। তবে এখানকার নগর পরিবহনে সিটিং, ডাইরেক্ট বা গেটলকের নামে নজিরবিহীন নৈরাজ্যও নেই।

আরও পড়ুন: মাঝারি উড়োজাহাজে নাইজার হয়ে বামাকোতে

পরিবহন মালিক শ্রমিকরা হয়রানি করেন এমন অভিযোগও কান পাতলে শোনা যায় না। নাগরিক যন্ত্রণায় স্থবির হয়ে পড়ার যানজটের চিরায়ত দৃশ্য নেই বামাকোর ঝকঝকে তকতকে সড়কে।

মালিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন পরিদর্শনে আসা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের পথ চলতেই এসব দৃশ্য নজরে আসে। অপরূপ ছোট্ট এ শহরে নয়ন মেলে যেদিকেই তাকানো যায় সেদিকেই ছিমছাম, পরিপাটি ও অপার্থিব মুগ্ধতা ছড়ানো অস্তিত্বই হৃদয়স্পর্শ করে। এ যেন নতুনের প্রতি চিরন্তন আকর্ষণেরই এক বহি:প্রকাশ।

আরও পড়ুন: দালালে প্রতারিত হয়ে বামাকোতে, সফলতার উদাহরণ সেই সালাহ উদ্দিন (ভিডিও)

দেখা গেছে, বৈচিত্র্যময় এ নগরীতে ব্যাটারিচালিত মোটর সাইকেলের আধিপত্য দিন দিন বাড়ছে। ভালো মানের যাত্রীবাস না থাকায় লেগুনা ও ম্যাক্সির মতো গণপরিবহনের ওপর নির্ভর করতে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। ছোট যানের এমন রাজত্বের পাশাপাশি বামাকোর রাজপথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যাটারি বাইক।

যৎসামান্য দামেই এসব বাইক মেলায় প্রতি পরিবারেই রয়েছে এমন যান। নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনা-নেওয়ার কাজেও এ বাইকই ব্যবহার করেন বামাকোর মানুষজন। দুই সিটের একটি বাইকে এক ঘন্টার চার্জে চলে কয়েক ঘন্টা।

বামাকোর বাসিন্দারা এ বাইকটিকে ‘স্মার্ট বাইক’ মনে করেন। এ শহরে পেট্রোলচালিত মোটর সাইকেলের সংখ্যা খুবই কম। হাতেগুনা পেট্রোল পাম্পের সংখ্যাও।

আরও পড়ুন: বামাকোতে মিঠেকড়া রোদের পর তুচ্ছাতিতুচ্ছ বৃষ্টি!

জানা গেছে, বামাকো শহরের সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা দু’টিই রয়েছে। কোন কোন সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর জন্য রয়েছে আলাদা লেন। নগরীর কোথাও উল্টো পথে যাওয়া, একজনকে ডিঙিয়ে আগে যাওয়ার চেষ্টা বা এলোমেলোভাবে যানবাহন চালানোর বেআইনি প্রবণতা নেই।  

নিরাপদ সড়কের জন্য যে কেবল ট্রাফিক পুলিশকেই কঠোর হতে হয় বিষয়টি তেমন নয় মোটেও। এখানে বিপজ্জনক গতিতে গাড়ির ছুটে চলা, এমনকি হর্ণ দিয়ে কাউকে বিরক্ত করাটাও যেন ধাঁচে নেই তাদের। কোন চালকই গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলেন না।

স্থানীয়রা বলছেন, ঠান্ডা মাথায় চালকরা দেখেশুনে যানবাহন চালান বলেই এখানে সড়ক দুর্ঘটনা জিরোতে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। যানবাহন চালকরাও ভঙ্গ করেন না ট্রাফিক আইন। সাধারণ মানুষেরও ট্রাফিক আইন মেনে চলার অভ্যাস রয়েছে। নিজেদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই ওরা নিজেদের সড়ক নিরাপদ রেখেছে।

এক সময় ফ্রান্সের কলোনি ছিল বলেই বামাকো শহরে গাড়ির স্টিয়ারিং বাম দিকে। ফলে চালকরা ডান দিক ধরে গাড়ি চালান। ফ্রান্সে এখনো না কী বাম দিক ধরে গাড়ি চালানোর নিয়মের প্রচলন রয়েছে। ফলে বামাকোর বাসিন্দারাও সেই প্রচলিত নিয়ম ত্যাগ করতে পারেননি।

বামাকোতে আরেকটি ইতিবাচক দৃশ্য দৃষ্টি কেড়েছে সবার। অবৈধ পার্কিং নেই এ শহরে। অনেক জায়গায় সারিবদ্ধভাবে মোটরসাইকেল পার্কিং চোখে পড়ে। রাজধানী ঢাকায় অবৈধ পার্কিংয়ের নামে দিনের পর দিন নৈরাজ্য চললেও বামাকোর সড়কে পার্কিং স্পেস দখলমুক্ত!  

এখানে অবৈধভাবে পার্কিং না থাকায় অনাকাঙ্খিত যানজটও নেই। সড়কের দু’পাশের ফুটপাতে অবৈধ দোকানপাট নেই। এখানে অফিস টাইমে সামান্য যানজট হয় ঠিকই তবে সেটি কোন অবস্থাতেই দু:সহ অবস্থায় গিয়ে ঠেকে না।

ঢাকার মতো এখানে নগরবাসীর যানজটের অজুহাতে নষ্ট হয় না মুল্যবান কর্মঘন্টা। অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়ে না জনজীবন। সব মিলিয়ে শৃঙ্খলার সৌন্দর্য মহিমায় সেজে উঠা বামাকো মনের হীরক দ্যুতিতে জ্বলজ্বল করবে চিরদিন। মিস ইউ বামাকো।

কালের আলো/কেএএই/এমএএএমকে