ধর্ষণের অভিযোগ তুলে সেনাবাহিনীর ভাবমর্যাদা বিতর্কিত করার নেপথ্য রহস্য ফাঁস!

প্রকাশিতঃ 7:37 pm | October 05, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মনোভাব কঠোর করেছে সরকার। তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে ক্যাম্পগুলোর আইনশৃঙ্খলার দিকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় জোরদারের লক্ষে ক্যাম্পগুলোতে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে। আর এমন সময়েই এক সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ তোলা হয়েছে। এ নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে গুটিকয়েক রোহিঙ্গা মিডিয়া।

মূলত এর মাধ্যমেই শুরু হয়েছে নানামুখী ষড়যন্ত্র। বিশেষ করে বিশ্বপরিমন্ডলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রাখা বাহিনীটির উজ্জ্বল ভাবমূর্তি প্রশ্নবোধক অবস্থানে দাঁড় করাতে ষড়যন্ত্রকারী ওই মহলটি নিজেদের কুটকৌশল অব্যাহত রেখেছেন। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছে দেশি ও আন্তর্জাতিক নানা শক্তি।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সুকৌশলে বাঁধা সৃষ্টি করা শতাধিক দেশ-বিদেশী এনজিও নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা মাথায় রেখেই পুরনো স্টাইলেই রোহিঙ্গাদের প্ররোচিত করছে। এমন অশুভ তৎপরতার সঙ্গেই রোহিঙ্গা কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়টির কোন যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।

অন্তত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোন সদস্য এরকম অপরাধ করে থাকলেও তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তিই নিশ্চিত করা হবে। আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, ‘গত ২৯ সেপ্টেম্বর নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সেনা সদস্য কর্তৃক একজন রোহিঙ্গা কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ সেনা সদরদপ্তর অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই গ্রহণ করেছে।

এ ঘটনায় একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানা যায়, বাংলাদেশে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে। তার বড় অংশই আসে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর। এরপর জাতিসংঘসহ নানা সংস্থার নানা উদ্যোগের পর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। সে সময় রোহিঙ্গারা আট দফা দাবি তুলেছিল।

এবারও ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের একটি সম্ভাব্য তারিখ মিয়ানমারের তরফ থেকে প্রকাশের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উত্তেজনা দেখা দেয়। এবারো মিয়ানমারের অনীহায় আটকে যায় প্রত্যাবাসন। এরপর নিজেদের বাংলাদেশে দুই বছর উপলক্ষে কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পে বড় রকমের শোডাউন দেশকে অস্থির করার ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখা হয়।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনায় বিতাড়িত হওয়ায় মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পর কোন আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই এমন সমাবেশের পর নড়েচড়ে বসে সরকার। রোহিঙ্গা ও তাদের নিয়ে সক্রিয় এনজিওদের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের বিভিন্ন ধরণের বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। এতে তারা ভেতরে ভেতরে ছিলেন নাখোশ।

আবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা, সিকিউরিটি ক্যামেরা বসানো, রাতে নিরাপত্তা টহল, রোহিঙ্গাদের বাইরে রাতে ক্যাম্পে অবস্থান না করা, সমাবেশ নিষিদ্ধ করা, মোবাইল ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ, জঙ্গী, সন্ত্রাসী, ইয়াবা, মাদক পাচারকারী, নারী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, এনজিও ও দাতা সংস্থাগুলোর নিয়োগ, আয় ব্যয়সহ সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য গাইডলাইন তৈরি এসব কারণে এনজিও ও দাতাসংস্থাগুলোরও মুখ বেজার।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ প্রসঙ্গে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

সূত্র মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণের দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করার পর তাদের মাঝে নতুন করে অস্বস্তি তৈরি হয়। ওই সময় থেকেই তাদের টার্গেট হয়ে উঠে সেনাবাহিনী। আর এরই অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়টি ফলাও করে প্রকাশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার হীন অপপ্রয়াস নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন একাধিক সূত্র।

একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র মনে করছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করতে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সেনবাবাহিনীর ওপর অর্পিত হওয়ার আগে কৌশলে আরসা ও আল ইয়াকিন নামক বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাদের সৃষ্ট জঙ্গি সংগঠন রাতের বেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছে। ওই সময় মাদক, নারী পাচারকারী ও সন্ত্রাসী চক্রের দৌরাত্ম বেড়েছিল।

হত্যা ও নির্যাতনের আতঙ্কে সাধারণ রোহিঙ্গারা সকল নির্যাতন, শোষণ, জুলুম, অপকর্ম চোখ বুজে সহ্য করেছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ, রাতে নিরাপত্তা টহল ও ক্যাম্পে বহিরাগত কাউকে অবস্থান না করার নির্দেশ বাস্তবায়ন হওয়ায় ষড়যন্ত্রকারী চক্র নিজেদের স্বার্থে মিডিয়াবাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই সব ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন। তাদের সাম্প্রতিক অপতৎপরতায় এ বিষয়টিই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

সূত্র মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোট ১২৩টি দেশি-বিদেশি এনজিও কাজ করছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক এনজিও রয়েছে ২১টি এবং কক্সবাজারের স্থানীয় এনজিও রয়েছে ৫টি। অন্যরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে কাজ করছে। এসব এনজিও বিভিন্নভাবে অর্থ এনে রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয়ের কথা বললেও এসব অর্থের একটি অংশ ব্যয় করা হচ্ছে কর্মকর্তাদের পেছনে।

কর্মকর্তাদের দামি গাড়ি, উচ্চ বেতনে চাকরি ও ফাইভ স্টার হোটেলে থাকা-খাওয়াসহ বিলাসী জীবনযাপনে এসব অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। কক্সবাজার শহর, টেকনাফ ও উখিয়ায় এখন পর্যটন মৌসুম না থাকলেও হোটেলে জায়গা পাওয়া কঠিন। দামি হোটেলগুলো এনজিও কর্মকর্তারা নিয়ে নিয়েছেন। মাসের পর মাস তারা পুরো হোটেল ব্যবহার করেন।

স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, বিদেশী অনেক গণমাধ্যম কক্সবাজারে তারকা হোটেলগুলোতে বিশাল অফিস ও জনবল নিয়ে বসেছে। তাঁরা শুধু রোহিঙ্গাদের নিউজ করার জন্য অর্থ ব্যয় করছে বিষয়টি তেমন নয় মোটেও। তাদের চোখে রোহিঙ্গা তরুণীদের নিয়ে এনজিও কর্মকর্তাদের আমোদ ফুর্তির ঘটনা সংবাদ হতো।

স্থানীয় একাধিক গণমাধ্যম কর্মীরা বলছেন, বিদেশি এনজিওগুলো কক্সবাজারের ফাইভ স্টার মানের হোটেলগুলোতে রীতিমত ফ্লাট আকারে ভাড়া নিয়ে অফিস ও আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহার করছে। একই হোটেলের একই ফ্লোরের কিছু রুমে অফিস, কিছু রুমে বাসস্থান করে বসবাস করছে।

হোটেলের রুমগুলোতে নারী-পুরুষ পাশাপাশি থাকছে। নানা অনৈতিক কীর্তিকলাপ হচ্ছে ফ্রি স্টাইলেই। সুন্দরী নারীদের যোগ্যতা না থাকলেও অথবা কম যোগ্যতা সত্ত্বেও উচ্চ বেতনে চাকরি দিয়ে রেখেছে কীজন্য এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখার জোর দাবি উঠেছে।

একই সূত্র বলছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সুন্দরী তরুণীদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণের নামে ৩ থেকে ৭ দিনের জন্য কক্সবাজারের হোটেলগুলোতে নিয়ে রেখে ফুর্তি করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তার নামে টাকা এনে ৭০ শতাংশেরও অধিক অর্থ ম্যানেজমেন্ট খাতে ব্যয় করে সে অর্থ দিয়ে ফুর্তি করার সংবাদ কোথাও কেন প্রকাশিত হচ্ছে না সেই প্রশ্নও বড় দাগে উঠে এসেছে।

অভিযোগ উঠেছে, কক্সবাজার, টেকনাফের বহু হোটেল, রিসোর্টগুলোতে এখন রোহিঙ্গা তরুণীদের দিয়ে পতিতাবৃত্তির রমরমা ব্যবসা চলছে। এ নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমগুলো কার্যত নীরবতা অবলম্বন করছে। রোহিঙ্গা তরুণীদের পাচারকারীরা সারা দেশে ও দেশের বাইরে পতিতালয়গুলোতে বিক্রি করে দিচ্ছে, রোহিঙ্গারা পরিচয় গোপন রেখে বাংলাদেশি নাগরিক সনদপত্র ও পাসপোর্ট গ্রহণ করছে- সেসব বিষয়েও সংবাদ হচ্ছে না।

সূত্র মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পজুড়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর রয়েছে। একই সঙ্গে সেখানে রয়েছে বিভিন্ন এনজিওর ছদ্মাবরণে থাকা অনেক দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। অনেকে রোহিঙ্গা মেয়ে বিয়ে করে রাতে ক্যাম্পেই অবস্থান করে। তাদের কেউ কেউ এই অঞ্চলকে আরেকটি মুসুল, রাকা, বানানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের এদেশে থাকার সঙ্গে অনেকের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। বিশেষ করে বিভিন্ন এনজিওর তহবিল, কর্মীদের বেতন নির্ভর করে রোহিঙ্গাদের থাকার ওপর। রোহিঙ্গারা চলে গেলে তাদের এসব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্যই তাঁরা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চান না।

রোহিঙ্গাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করার কথা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। দিন পাঁচেক আগে চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরে আর্টিলারি সেন্টার ও স্কুলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চারটি গোলন্দাজ ইউনিটকে রেজিমেন্টাল কালার প্রদান অনুষ্ঠান শেষে গণমাধ্যকর্মীদের তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যাম্প ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। বেড়া নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে।

এছাড়া রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পের বাইরে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে না পারে সেজন্য তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে আনার দায়িত্ব সরকার সেনাবাহিনীকে দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে সরকারের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবে সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো চিন্তাকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সমর্থন দেওয়া হবে উল্লেখ করে জেনারেল আজিজ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর যে চিন্তা-চেতনা সেটাকে বাস্তবায়ন করা, সেটাকে সমর্থন দেওয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান হিসেবে আমার নৈতিক দায়িত্ব।’

কালের আলো/এমএইচ/এমএএএমকে