হলো না শেষ রক্ষা, যেভাবে ধরা পড়লো ‘পাগলা মিজান’
প্রকাশিতঃ 3:07 pm | October 11, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :
নিজে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের হাতেগড়া দল ফ্রিডম পার্টির সক্রিয় নেতা। এমনকি যেদিন খুনিরা বঙ্গবন্ধু কন্যাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার জন্য গ্রেনেড বোমা আর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো ধানমন্ডি এলাকা। সেই টার্গেট কিলিং মিশনের অন্যতম ছিলেন তাঁরই ছোট ভাই ফ্রিডম মোস্তফা।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টাকারীর ভাই কীভাবে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন?
কিন্তু সময় গড়াতেই মিজানুর রহমান ওরফে হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান ডিগবাজি দিয়ে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেন। দলটির বিতর্কিত এক প্রভাবশালী রাজনীতিকের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে রাজনীতিতে উত্থান ঘটে তাঁর। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও হয়েছেন।
কিন্তু চলমান শুদ্ধি অভিযানে লন্ডভন্ড হওয়ার উপক্রম তাঁর অপরাধ সাম্রাজ্যের! গ্রেফতার এড়াতে বিলাসী জীবন ছেড়ে প্রথমে প্রভাবশালীদের দূয়ারে দূয়ারে কড়া নাড়েন। কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেন সবাই। শেষতক পালাতে চেয়েছিলেন বিদেশে। কিন্তু আর সহায় হয়নি ভাগ্য।
আরও পড়ুন: কার ‘সোনার ডিমপাড়া হাঁস’ ছিলেন পাগলা মিজান, ‘লাপাত্তা’ আদাবরের তুহিন!
শুক্রবার (১১ অক্টোবর) সকালে র্যাবের একটি বিশেষ টিম মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে গুহ রোডের হামিদা আবাসিক গেস্ট হাউজের সামনে থেকে তাকে আটক করে। র্যাব জানিয়েছে, এ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ওই এলাকার বাসিন্দারা জানান, গত ক’দিন ধরে ওই এলাকায় মিজানকে আনাগোনা করতে দেখেছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: ম্যানহোলের ঢাকনা চোর থেকে শত কোটি টাকার মালিক ‘পাগলা মিজান’
সূত্র জানায়, এক সময় ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি ছিল মিজানুর রহমান ওরফে হাবিবুর রহমান মিজানের পেশা। খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হয়েছেন। দেশ-বিদেশে বিলাসবহুল বাড়ির মালিক হয়েছেন। একাধিকবার জেলে গেছেন। আবার জেল থেকে বেরিয়েই নিজের অপরাধ সাম্রাজ্য গুছিয়ে নিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের গত ১০ বছরে কেবলমাত্র টেন্ডারবাজি করেই টাকার কুমির হয়েছেন। সরকার দলীয় বিতর্কিত এক নেতার সঙ্গে গোপন সমঝোতায় সব রকমের অপরাধ করেও পার পেয়ে গেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন: পাগলা মিজানের বাসায় র্যাব, মিলেছে ৮ কোটি টাকার চেক
সূত্র মতে, চলমান সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরুর পর রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার সাক্ষাৎ আতঙ্ক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাকারী ফ্রিডম মোস্তফার বড় ভাই ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানকে গ্রেফতারের গণদাবি উঠে। এ গণদাবির মুখে পাততাড়ি গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন পাগলা মিজান।
ওই সময়ই এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়ে পাগলা মিজান গা ঢাকা দিয়েছেন। বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ছড়িয়ে পড়া গুঞ্জণ অবশেষে সত্যে পরিণত হলো। ঠিকই বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময়ই র্যাবের হাতে ধরা পড়েছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার ত্রাস হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান।
র্যাব নিশ্চিত করেছে, ভারতে পালিয়ে যেতেই শ্রীমঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন হাবিবুর রহমান মিজান। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক এএসপি মিজানুর রহমান ভূইয়া বলেন, ‘চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে হাবিবুর রহমান মিজানকে আটক করা হয়েছে। সে দেশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।’
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনার কথা জানতেন সেই ‘পাগলা মিজান’!
যে বাসা থেকে গ্রেফতার হন পাগলা মিজান
মোহাম্মদপুরের বিতর্কিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান মৌলভীবাজারের যে বাসা থেকে আটক হয়েছেন সেই বাসা ঘিরে জনমনে কৌতুহল শুরু হয়েছে।
শুক্রবার(১১ অক্টোবর) ভোররাতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের গুহ রোডের যে বাসা থেকে আটক হন। এ বিষয়ে আশ্রয় দেয়া ওই বাড়ির মালিক মৃত ফজলুর রহমানের স্ত্রী নূরজাহান বেগম বলেন, মিজান (পাগলা মিজান) তার মেয়ে জামাইয়ের বন্ধু ছিল। তার মেয়ের জামাই মোস্তাক আহম্মেদ সাত বছর আগে মারা গেছেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মিজান তাদের বাসায় আসে। এ সময় তার হাতে শুধু একটি ব্যাগ ছিল।
তিনি বলেন, এক রাত থেকে পরের দিন (শুক্রবার) সে সিলেটে মাজারে যাবে বলেছিল। গত বছরও তিনি একবার এসে এক রাত থেকে পরের দিন মাজারে গিয়েছিলেন। সে খারাপ লোক এ কথা জানলে তারা তাকে বাসায়ই ডুকতে দিতেন না।
নূরজাহান বেগমের মেয়ে শিউলি বলেন, মিজান আমার জামাইয়ের বন্ধু ছিল। এই সুবাদে কয়েকবার সে আমাদের বাসায় এসেছিল। তার কাছে হানিফ বাসের টিকেট দেথে বুঝা গেছে এবার সে বাসে করে এসেছে। আগে সে গাড়ি নেয়ে আসতো।
স্বস্তি ফিরেছে মোহাম্মদপুরে?
মোহাম্মদপুরের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানের সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতো না। সর্বশেষ জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মূল কুশীলবের ভূমিকা পালন করেন এ মিজান। তাঁর গ্রেফতার হওয়ার খবরে মোহাম্মদপুরে জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
আনন্দে উদ্বেলিতও হয়েছেন অনেকেই। এখন সন্ত্রাসীদের গডফাদার মিজানকে বিচারের আওতায় আনা হলেই অপরাধ জগতের অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে বলেও মনে করছেন স্থানীয় সচেতন বাসিন্দারা। একই সঙ্গে মিজানকে শেল্টার দেওয়া সেই রাজনৈতিক গডফাদারদেরও মুখোশ উন্মোচনের জোর দাবি উঠেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কাউন্সিলর মিজানের গ্রেফতারের খবরে আমরা খুশি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার অনেক উন্নয়ন করেছে। কিন্তু মিজানদের মতো সুযোগ সন্ধানী দুর্নীতিবাজদের কারণেই উন্নয়নে প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি।
সরকার বিলম্বে হলেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করে দেওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষজনের নিরঙ্কুশ সমর্থন পাবে। এই অভিযানকে সফল করতে সহায়তা করা উচিত সবার, মত অনেকের।
কালের আলো/এমএইচ/এমএএএমকে