‘যৌন শিক্ষাকে’ ট্যব্যু হিসেবে রাখলে হবে না, আলোয় আনতে হবে

প্রকাশিতঃ 5:08 pm | April 05, 2018

:: রুহেল বিন ছায়েদ ::

একটা সময় ছিল দেশে ‘ইভটিজিং’ শব্দটা ট্রেন্ডিং যাচ্ছিল। প্রাইমারি স্কুলে যখন পড়াশোনা করতাম তখন বিটিভিতে খেয়াল করতাম প্রতিদিনই ‘ইভটিজিং’ বিষয়ক সচেতনতামূলক বিভিন্ন নাটিকা, প্রামাণ্যচিত্র কিংবা টক শো দিত নিয়মিত। তখন থেকেই মূলত বুঝতে পেরে ওঠেছিলাম একটি মেয়েকে যখন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে কথা বলতে বা সম্পর্ক সৃষ্টির চেষ্টাই ইভটিজিং। এদিকে প্রতিদিন ভোর পেরুতেই মসজিদে চলে যেতে হতো কোরআন শিক্ষার জন্য। তখন খেয়াল করলাম মসজিদের হুজুর কোনো এক অজানা কারণে মেয়েদের ছেলেদের থেকে আলাদা জায়গায় রাখতেন অর্থাৎ ছেলেদের চক্ষুর আড়ালে। তার ওপর নৈতিক শিক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক।

ঘরকুনে ছিলাম বেশ। আম্মুর সাথে বেশিরভাগ সময় বাসায় কাটতো। আমি খুব পড়ুয়া স্বভাবের ছিলাম। সারাদিন এটা সেটা পড়তাম আর আম্মু থাকতেন সবসময় আমার আশেপাশে। খেয়াল করলাম আম্মু একটু সুযোগ পেলেই আমাকে বুঝাতে শুরু করতেন ‘বাবা বড়দের দেখলে সালাম দিও/ কারো সাথে খারাপ আচরণ করো না/ মেয়েদেরকে সম্মান করো। মোদ্দকথা নিজেকে সবার কাছে ভালো হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করতে হবে আম্মুর চাওয়া ছিল এরকম।

তখনও হাফপ্যান্ট পরে চলাফেরা করার বয়স। খেয়াল করলাম নিজের মধ্যে খুবই ন্যাচারাল একটা বুঝার ক্ষমতার উপদ্রপ ঘটলো। ক্লাসের মেয়ে সহপাঠীদের সাথে কম মেশা, ক্লাসের স্যার ম্যাডামদের সাথে বিনয়ের সাথে আচরণ সব যেনো ‘অটোম্যাটিক’ করছি আমি! পরীক্ষার সময়ে মেয়ে ছেলের সিট এক ব্যাঞ্চে পড়ে যেতো অনেক সময়। সেসময় আমাকে বেশ বিব্রতই পোহাতে হতো, এখনও মনে আছে! মেয়েদের প্রতি নিজের মাঝে আপনাআপনি চলে আসলো একধরনের সম্মানের জায়াগা।

বিটিভির ওই অনুষ্ঠানাদি থেকে আম্মুর বুঝানো যে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ জ্ঞানের অংশ ছিল তা তখনও অজানা ছিল। কিন্তু ইদানীং খুব বোধ করি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই ছোট ছোট জিনিসগুলো আমার ব্যক্তিগত সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে।

যাহোক, আমার বেড়ে ওঠার সময়েও ‘ধর্ষণ’ শব্দটা সম্পর্কে তেমন জানাশোনা হয়নি। ‘ইভটিজিং’ শব্দটা যতটা এখন শোনা যায় না ততটা ‘ধর্ষণ’ শোনা যায় সাম্প্রতিক সময়ে। গত কয়েক বছরে ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশই। এর কারণ হিসেবে ভিন্ন জনের ভিন্ন মত। এক গোষ্ঠীর মতে মেয়েদের খোলামেলা কাপড়/চলাফেরা/চাকরি করা কিংবা ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা/ অসামাজিক উৎসব-পার্বণ কিংবা ধর্মীয় অনুশাসন না মানাই হচ্ছে ধর্ষণ বাড়ার কারণ। আমরা এ গোষ্ঠীকে চিনি ধর্মভীরু কিংবা অনগ্রসর কুসংস্কারচ্ছন্ন হিসেবে। অনেকে একটু বাড়িয়ে এ গোষ্ঠীকে ‘জঙ্গিবাদী’ বলতেও কার্পণ্য করেন না!

আরেক গোষ্ঠী আছেন যারা খুবই চেতনাবান, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ধ্যান ধারণার। আগের গোষ্ঠীর সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান তাদের। বলা যায় আগের গোষ্ঠীর সমালোচনা করাই তাদের অন্যতম প্রধান কাজ। তাদের মতে নারীদের পোশাক, চলাফেরা কিংবা ইন্টারনেটন-ফিন্টারনেট কিছুই ধর্ষণ বাড়ার কারণ নয়। বরং ধর্ষকের সামাজিক অবস্থান কিংবা ধর্মীয় অবস্থানই ধর্ষণ বৃদ্ধির কারণ। ভীষণ রকমের সচেতন তারা। এবং নিজেদের যুক্তি উপস্থাপনে বেশ শক্ত!

প্রথম গোষ্ঠী যারা কথায় কথায় ধর্মীয় অনুশাসন না মানার বিষয়টি তুলে তারা তাদের অবস্থান সম্পর্কে সবসময় নড়বড়ে থাকে। এজন্য তারা অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক যুক্তি দিয়ে গরম তেলে পানি ঢালে আর শুরু হয় সমালোচনা। ইসলামে স্পষ্ট বলা আছে, পর্দা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য অবশ্য পালনীয় বিষয়। এখানে নারীর পর্দা বলতে, কেবল বোরকা পরতে হবে এরকম না। তবে বলা হয়েছে পুরুষের কামপ্রবৃত্তি বাড়তে পারে এরকম পোশাক এবং চলাফেরা থেকে নিজেকে হেফাজত রাখা। নারীর মতো নরেরও অর্থাৎ পুরুষেরও পর্দা মানা লাগবে। পুরুষের শারীরিক পর্দা ছাড়াও থাকতে হবে ‘চোখের পর্দা’! অর্থাৎ চোখকে সবসময় খারাপ দৃষ্টি থেকে সংযমিত কিংবা হেফাজত রাখার কথা বলা হয়েছে ইসলামে। ধর্ষণ সম্পর্কে ইসলামে বলা আছে স্পষ্ট। ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ষণ একটি জঘন্য পাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামে ব্যভিচারকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ ও হারাম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটি প্রকাশ্য অশ্লীলতা ও অত্যন্ত মন্দ পথ’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩২)।

শুধু ইসলাম নয়, কোনো ধর্মেই ব্যভিচারের শিক্ষা নেই। আর বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ব্যভিচার করবে না।’ কিন্তু ধর্ষণ তবু বাড়ছে। এই বাড়ার বিষয়ে দ্বিতীয় গোষ্ঠী যারা প্রগতিশীল তাদের অবস্থান আমার কাছে বেশ ‘নড়বড়ে’ মনে হয়। অসাম্প্রদায়িকতার দোহাই দিয়ে তারা সবসময় অপর গোষ্ঠীকে আক্রমণ করতে পছন্দ করেন। তাদের মতে পর্দা টর্দা কিছু না, পর্দা করা সত্ত্বেও মাদ্রাসায় বোরকা পড়া মেয়ে ধর্ষিত হয়, বয়স্ক মহিলা ধর্ষিত হয়, ধর্ষিত হয় শিশু! তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের কাঁদা ছোড়াছুঁড়ি বেশ চোখে পড়ে! তাদের অনেকেই আবার ইসলামকে সরাসরি উদ্দেশ্য করে কটূক্তি করেন, কেউ আবার পরোক্ষভাবে ধর্মকে খাটো করেন। ধর্ম বললে ভুল হবে স্প্যাসিফিকেলি উনারা একটা নির্দিষ্ট ধর্মকে খাটো করেন আর তা হচ্ছে ‘ইসলাম’!

আমি ঠিক ভেবে ওঠতে পারি না কেন তারা কোনো ধর্ষণ হলেই সরাসরি ইসলামকে খাটো করতে শুরু করেন। ইসলামে তো কোনো জায়গায় ধর্ষণের বৈধতা দেয়া হয়নি বরং সব ধর্মের চেয়ে বেশি দেয়া হয়েছে ‘অবৈধতার স্বীকৃতি’। ইসলামে ধর্ষণের শাস্তিও সর্বোচ্চ পর্যায়ের। তাহলে একজন ধর্ষকের কৃতকর্মের দায়ভার সরাসরি ইসলামের ওপর কেন বর্তাবে? ধর্ষক তো নিয়মনুযায়ী অলরেডি ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে তাহলে তার ব্যক্তিগত দোষের কারণে তাকে এবং তার পরিবারকে বাদ দিয়ে ইসলামের ওপর কোন যুক্তিতে আপনারা দায় দেন? আপনাদের ক্ষোভের জায়গা আমি জানি। আপনাদের ক্ষোভের জায়গা হচ্ছে সেসকল মানুষের প্রতি যারা ইসলামকে ব্যবহার করে নিজের ফায়দা লুটে এবং ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। তাই বলে কি আপনাদের ‘অসাম্প্রদায়িক’ চেতনাকে এতোই ঠুনকো করে দেবেন যা সমাজে অশান্তি কমার চেতে দাবানলের মতো বাড়তে কাজ করে?

একেকটি ধর্ষণের খবর আসলেই নিউজফিড ভরে যায় এর বিরুদ্ধে সবার স্ট্যাটাসে। কিন্তু ম্যাক্সিমাম ক্যাপশনে কেন যেন ইসলামকে নিয়ে হেয় করার একটা পাঁয়তারা দেখা যায়! মাঝে মাঝে খুব ভাবি তারা আদৌ ধর্ষণ কমাতে চাচ্ছেন নাকি সামাজিক দাঙ্গা সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ফুঁসলিয়ে দিয়ে! কিন্ত কেনো?

ইসলাম ধর্ম কখনোই ধর্ষণ কেনো এর চেয়ে অনেক অনেক মামুলি অপরাধকে বৈধতা দেয়নি। হ্যাঁ, ইসলামের চেতনা থেকে অনেকেই বেরিয়ে পড়ছে, ভুল করছে, পাপ করছে, ধর্ষণ করছে কিন্তু এর মানে এই না যে ইসলাম তাকে বলছে এটা করতে। আর আপনারা যারা প্রগতিশীল তাদের্ব কোনভাবেই উচিত না ওই ধর্ষককে আক্রমণ না করে ইসলামকে নির্বোধের মতো আক্রমণ করা।

অনেকের কথা বার্তা বা প্রতিবাদের ভাষায় মনে হয় শুধু মুসলিমরাই ধর্ষণ করে! অন্য ধর্মের কিংবা জাতের কেউ ধর্ষণ মানে কি জানেই না! একটা তথ্য দেই , ধর্ষণ সবচেয়ে বেশি ঘটে যে ১০টি দেশে তার মধ্যে বাংলাদেশ নেই। এই অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেশী দেশ ভারত ধর্ষণের সংখ্যার হিসেবে পাঁচ নম্বরে আছে। আর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা যে দেশগুলোতে হয় সেখানে নেই কোনো মুসলিম দেশের নাম! আপনাদের কাছে যে দেশগুলো অনুকরণীয়, সভ্য এবং উন্নত সে দেশগুলোতেই হয় ধর্ষণের ঘটনা নিয়মিত। যেমন যুক্তরাষ্ট্র,দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, ভারত, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জিম্বাবুয়ে!

সুতরাং, আসুন একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে হেয় না করে, সাংঘর্ষিক কথা না বলে কীভাবে ধর্ষণ রোধ করা যায় তা নিয়ে সময় নষ্ট করি। নিজেদের চেতনায় কেনো গুড়েবালি দেবেন বলেন? অসাম্প্রদায়িক অসাম্প্রদিয়ক বলে ঠিকই সারা বছর চিল্লান আর পূজোর সময় রঙিন পাঞ্জাবি পরে মায়ের আসা থেকে বিসর্জন পর্যন্ত নিউজফিড ভরে দেন ছবিতে! তাহলে আর অসাম্প্রদায়িক রইলেন কই? যদি অসাম্প্রদায়িক মনোভাব থাকে তবে তো কোনো ধর্মকে হেয় করতেন না আবার এক ধর্মের কুৎসা রটিয়ে আরক ধর্মের খোশগল্পে মত্ত থাকতেন না! তাই না?

নারীবাদীদের বলছি, সস্তায় মেগাবাইট পেয়ে শুধু ফেইসবুকে পোস্ট শেয়ার এবং দু/চারটে বিতর্কিত কথা বললেই ধর্ষণ ঠেকানো যাবে না। যারা ধর্ষক তারা আহম্মক। মুহূর্তের কাম প্রবৃত্তি তাদেরকে এই আহম্মকি করাচ্ছে। তাদের এই গুরুতর আহম্মকির বিচার কীভাবে করা যায় এবং আরও দু/একটা হতে যাওয়া নরপশু আহম্মককে ঠেকানো যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। কিন্তু প্লিজ নিজেরা প্রগতিশীল হয়ে, সুশীল হয়ে, শিক্ষিত হয়ে, অসাম্প্রদায়িক হয়ে ইন্টারনেটে এসে একটা ধর্মকে আক্রমণ করে আহম্মকি করবেন না।।

বর্তমান আধুনিক যুগে সবকিছুর আধুনিকীকরণের সুবাদে সবকিছু হয়ে যাচ্ছে সহজলভ্য। বিশেষ করে ইন্টারনেট। এর ভালো ব্যবহারের চেয়ে মন্দটাই ব্যবহৃত হচ্ছে বেশি। আর এ সুযোগে পশ্চিমার বিকৃত মানসিকতার এক গোষ্ঠী আমাদের টার্গেট করে ইন্টারনেটে ছডিয়ে দিচ্ছে বিকৃত ভিডিও কিংবা কন্টেন্ট। যা প্রভাব ফেলছে আমাদের সমাজে এবং ব্যক্তিত্ববোধে। তাই অহরহ বাড়ছে ধর্ষণের মতো অযাচিত ঘটনা। একটু চিন্তা করে দেখুন আজ থেকে ১৫/১০ বছর আগেও কি এরকম মহামরি আকারে ছিল ধর্ষণ? না ছিল না, কারণ তখন আমদের হাতের নাগালে ছিল না ইন্টারনেট কিংবা অশ্লীল কন্টেট। ফলে একজন ব্যক্তির মধ্যে কাম প্রবৃত্তি ফুঁসলিয়ে দেয়ার কিছু ছিল না। আমি বলছি না আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহার বাদ দিতে হবে। কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহারের ভালো দিকটা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। বর্জন করতে হবে খারাপ দিকসমূহ।

পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে সামাজিক মূল্যবোধ। মিডিয়ার ভূমিকা রাখতে হবে। ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা দরকার। ‘যৌন শিক্ষাকে’ আলোয় আনতে হবে। এটাকে ট্যব্যু হিসেবে রেখে দিলে হবে না।

যারা কথায় কথায় ধর্মের দোহাই দেন তাদের বলবো, ‘ভাই আর কতকাল ভণ্ডামি চলবে? মেয়েটা পর্দা করেনি সেটা দেখলেন আর আপনার চোখের পর্দা যে ভাঙলেন সেটা কে দেখবে’? ধর্মকে ব্যবহার না করে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন। আর প্রগতিশীলদের বলছি, ‘আর কত নিজেদের সাথে নিজেরা প্রতারণা করে যাবেন? মুখে এক কথা, অন্তরে এক কথা আর ফেসবুকে আরেক কথা! কোনো কিছু উস্কে দিলে সমস্যা সমাধান হয় না, প্রতিবাদী হোন কিন্তু প্রতিঘাতী না’ ! ধর্ষকের কৃতকর্মের দায়ভার ধর্ম কিংবা ধর্ষকের চেয়ে জাতি হিসেবে আমাদের সবার নিতে হবে বেশি পরিমাণে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি সাহিত্য বিভাগ, এমসি কলেজ, সিলেট

 

কালের আলো/ওএইচ