কাউন্সিলর রাজীবের ‘দিনবদলের দখলবাজি’, দীর্ঘশ্বাসই যেন ‘নিয়তি’ সরফরাজ-ফারুকদের!

প্রকাশিতঃ 10:21 pm | October 19, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

শুন্য হাতে ভোলা থেকে ঢাকার মোহাম্মদপুরে এসেছিলেন তোতা মিয়া। শুরুতে কাজ নেন রাজমিস্ত্রী হিসেবে। একার উপার্জনের ঘাটতি মেটাতে প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে পড়তেন সন্তান রাজীবকে সঙ্গে নিয়ে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবাকে সহযোগিতা করতেই উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হতো তাকে।

আরও পড়ুন: রাজমিস্ত্রির ছেলে কাউন্সিলর রাজীবের রূপকথার রাজত্ব!

কিন্তু তাতেও দূর হচ্ছে না অভাবের ঘনঘটা! অকূল পাথারের জীবনে এবার সেই তরুণ কাজ নিলেন পাড়ার টং দোকানে। তারপরও যেন অভাব ঘিরে ধরছে চারপাশ থেকে। চতুর এ তরুণের মাথায় চেপে বসলো ‘রাজনীতির ভূত’।

মোহাম্মদপুর এলাকার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের গুটিকয়েক নেতাকে হাত করে স্থানীয় থানা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়কের পদ বাগিয়ে নেন। সরকারের সাবেক এক প্রতিমন্ত্রী তাকে ‘পৃষ্ঠপোষকতা’ দিতেন। এমন আনুকূল্যে এবার জনপ্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেন।

আরও পড়ুন: অবৈধ অস্ত্রের ভান্ডার ছিল যুবলীগের রাজীবের, বন্ধু মিশুই ‘নাটের গুরু’!

এরই মধ্যে চলে আসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার সুযোগ। হাতছাড়া করেননি মোটেও।

সেই নেতার আশীর্বাদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও পরাজিত করেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমানকে। এরপর আর তাঁর পেছনে তাকাতে হয়নি। নিজেকে বদলে ফেললেন রাতারাতি। কোটি টাকায় কিনে নিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ।

আরও পড়ুন: র‌্যাবের হাতে কাউন্সিলর রাজীব গ্রেফতার

এবার তামিল মুভির ভিলেনের মতোই কোন সভা-সমাবেশে যেতেন ক্যাডারবেষ্টিত হয়ে। হাল সময়কার দামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে চড়তেন নিজে। সামনে-পেছনে থাকত শত শত মোটরসাইকেল আর গাড়ির বহর।

রাজিবের আলিশান সেই ডুপ্লেক্স বাড়ি-দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি। ছবি: সংগৃহীত

নিজের চারপাশে পাইকপেয়াদার এমন বহর নিয়ে তাঁর ছুটে বেড়ানোর হুংকারে টুঁ শব্দ করারও সাহস ছিল না কারও। নিমিষেই যেন বনে গেলেন দোর্দন্ড প্রতাপশালী নেতায়!

এরপর শুরু করলেন দিনবদলের দখলবাজি! ব্যক্তিগত জমি থেকে সরকারি জমি বাদ গেলো না কোন কিছুই। সবকিছুই দখল নিতে শুরু করলো পাগলা মিজানের পর মোহাম্মদপুর এলাকার আরেক ‘ত্রাস’ রাজীব বাহিনী।

আরও পড়ুন: কাউন্সিলর রাজীবের ‘দিনবদলের দখলবাজি’, দীর্ঘশ্বাসই যেন ‘নিয়তি’ সরফরাজ-ফারুকদের!

রাজধানীর ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর স্বঘোষিত ‘জনতার কাউন্সিলর’ রাজীবকে আর এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র।

একজন রাজমিস্ত্রীর সন্তান থেকে কাউন্সিলর রাজীবের সিনেম্যাটিক উত্থান নিয়েও জনমনে অদম্য কৌতূহল তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি এখনও রাজীব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর হাতে ধরা না পড়ায় নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকার জনমনে।

হাল সময়কার সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি ব্যবহারের নেশা এই যুবলীগ নেতার। ছবি: সংগৃহীত

তাঁরা মনে করছেন, সরকারি দলের পদকে পুঁজি করে রাম রাজত্ব গড়ে তোলা রাজীরে মতো ক্যাডারদের সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। অনেকটাই থমকে থাকা চলমান শুদ্ধি অভিযান আরও বেশি প্রশংসিত হবে।

আরও পড়ুন: বন্ধুর বাড়িতে আত্নগোপনে ছিলেন রাজীব, অবৈধ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার

যুবলীগ নেতা রাজীবের দখলবাজির খন্ডচিত্র
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার ৫ দিনের মাথায় মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান হাউজিংয়ের এ ব্লকে তিন কাঠা জমির একটি প্লট দখল করেন রাজীব বাহিনী। সেই প্লটে গড়ে তোলা হয়েছে চারতলা ভবন।

নিজেদের নামের দলিল দস্তাবেজ দেখিয়ে এ প্লটের প্রকৃত মালিক ফারুক আহমেদ, রুসেল আলী, বশির উদ্দিন, আজিজুল ইসলাম ও তাহাওজ্জামান অভিযোগ করে বলেন, তাঁরা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।

চা হাতে হাঁটছেন রাজীব সঙ্গে নিজের ক্যাডার বাহিনী মাথায় ধরে রেখেছেন ছাতা। ছবি: সংগৃহীত

নিজেদের বেতনের টাকায় জমানো অর্থে তাঁরা এ প্লট কিনেন। কিন্তু রাজীব তাদের সেই প্লট দখল করে নিয়েছেন। আর এ দখলে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজীবের চাচা এক সময়কার রাজমিস্ত্রীর কাজ করা ইয়াসিন হাওলাদার।

জানা যায়, নিজের শ্রম-ঘাম পানি করা টাকায় কেনা জমিতে দখলবাজদের চারতলা বাড়ি নির্মাণ করার শোক সহ্য করতে না পেরে ৫ মালিকের একজন স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এসব পরিবার এখন চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছেন।

মোহাম্মদপুর এলাকার সাত মসজিদ হাউজিংয়ের এক নম্বর রোডে ডি ব্লকে প্রায় ২৫ বছর আগে দুই কাঠা জমি কিনেছিলেন সরফরাজ আহমেদ। সেই জমি দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ৩০ লাখ টাকা ঋণও নিয়েছিলেন। সরফরাজ আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, এক রাতে রাজীবের সন্ত্রাসীরা আমার জমিতে থাকা ভাড়াটিয়াকে বের করে দেয়। সেখানে নতুন করে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।

তামিল সিনেমার ভিলেনের মতো চলেন কাউন্সিলর রাজীব। ছবি: সংগৃহীত

বাষ্পরুদ্ধ হাহাকার নিয়ে সরফরাজ কালের আলোকে বলেন, ‘রাজীবের সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত চান্দু, শাহীন, আরজু ও নাজমা বেগম এ জমিটি দখল করে রেখেছে। সরকারি দলের প্রভাবশালী এক নেতার কাছে আমি লিখিত অভিযোগ দিয়েও বিচার পাইনি। অথচ তাঁরা আমাকে একদিন বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু কথা রাখেননি।’

একই হাউজিংয়ের এক এর বি রোড এলাকায় ১৯৮০ সালে আড়াই কাঠা জমি কিনেছিলেন গৃহবধু সালেহা আক্তার। এ জমিতে তিনি বাউন্ডারী নির্মাণের কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাজীবের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা সেই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।

সালেহা আক্তার বলেন, ‘ক্যাডাররা গুলি করার হুমকি দিয়ে আমাকে বলেছে এ জমি আপনার না। তাঁরা এখানে পুরো সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছে।’

রাজীবের সঙ্গে থাকে পাইকপেয়াদার বহর। ছবি: সংগৃহীত

ভারী কন্ঠে সালেহা কালের আলোকে বলেন, ‘আমি বিচার নিয়ে কমিশনার রাজীবের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, আমার কোন লোক কাজ বন্ধ করেনি। অন্য একজনের সঙ্গে আপনার জমি নিয়ে সমস্যা। সেই জমির মালিক না আসলে আমার কিছুই করার নেই।’

একই এলাকার দুই নম্বর রোডের ৯ নম্বর প্লট। এখানে দুই কাঠা জমির মালিক সাইফুল ইসলাম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার কেনা জমিতে আমি ঘরবাড়ি উঠাচ্ছিলাম। কিন্তু কাউন্সিলর রাজীব বাহিনীর সন্ত্রাসী চান্দু, শাহেদ, তাবের এসে কাজে বাঁধা দেয়। তাঁরা বলে এখানে ঘরবাড়ি তুলতে পারবেন না।

তিনি বহুবার বিষয়টি সমাধানের মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন। কাজের কাজ কিছু হয়নি। উল্টো তাঁর সন্ত্রাসীরা এখনো আমার জমি দখল করে রেখেছে।’

কাউন্সিলর রাজীবের দখলকৃত জমি। ছবি: কালের আলো

সাইফুল জানান, কমিশনার রাজীবের কাছে নালিশ করায় তাঁর সন্ত্রাসী আনারুল চান্দু ও শাহিদ আমার কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এর বিরুদ্ধে আমরা মোহাম্মদপুর থানায় অভিযোগ করি। সেখানে একটা মামলাও হয়। মামলা নাম্বার ২২। মামলার বয়স ১০ মাস হয়ে গেছে। তবে আজ পর্যন্ত পুলিশ চার্জশিট দেয়নি।

মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব পাবলিক টয়লেটকে ঘিরে যুবলীগের বিশাল সাইনবোর্ড টাঙিয়ে আশপাশটাও দখলে নিয়েছেন কাউন্সিলর রাজীব। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস ছাড়াও সেখানে ৭ টি দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

নবদাই হাউজিংয়ের বিশাল মাঠটিও রাজীব ও তাঁর লোকজনের দখলে। সেখানে বানানো হয়েছে যুবলীগের অফিস। অথচ এ জমির মালিক আমেরিকা প্রবাসী মাহবুব আলী। পাশে বাউন্ডারি ঘেরা মাহবুব আলীর বাড়ির ভাড়াটিয়াকে বের করে ৩২ কাঠা জমির পুরোটাই দখলে নিয়েছে রাজীব বাহিনীর ক্যাডাররা।

কাউন্সিলর রাজীবের দখলকৃত জমিতে রাজীব বাহিনীর সীমানা প্রাচীর। ছবি: কালের আলো

বছিলা রোডের কবরস্থান ঘেষে গড়ে তুলা হয়েছে যুবলীগের আরেকটি কার্যালয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কার্যালয়টির সামনে বিশাল সাইনবোর্ড টাঙানো ছিল কিছুদিন আগেও। অথচ চলমান অভিযান শুরুর পর সেই সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এ জায়গাটিও দখল করেছেন রাজীবের সাঙ্গপাঙ্গরা।

সূত্র মতে, পুরো মোহাম্মদপুর এলাকাজুড়ে একাধিক দলীয় কার্যালয়, সিএনজি স্টেশন, ট্রাক স্টেশন, ফুটপাতসহ বাজার দখলেরও এন্তার অভিযোগ রয়েছে কাউন্সিলর রাজীবের বিরুদ্ধে। অবশ্য এসবের কাগজ কলমে কোন প্রমাণ নেই।

নবদাই হাউজিংয়ের বিশাল মাঠটিও রাজীব ও তাঁর লোকজনের দখলে। ছবি: কালের আলো

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় ভুক্তভোগীরা বলছেন, এসব অপকর্ম এতোদিন প্রকাশ্যে করেছে কাউন্সিলর রাজীব বাহিনীর লোকজন।

একই সূত্র জানায়, নিজের কার্যালয় হিসেবে তারেকুজ্জামান রাজীব যে স্থানটিকে অফিস বানিয়েছেন সেটি নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের কমিউনিটি সেন্টারের দু’তলায় অফিস করলেও কাজ শেষ করা আগেই পুরো ভবনটি দখল করে নিয়েছেন।

শুদ্ধি অভিযানে আশাবাদী ভুক্তভোগীরা
মাত্র ৫ বছরে অস্বাভাবিক সম্পদের মালিক হয়েছেন কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব। ক্ষমতা নামের আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ বদলে দিয়েছে তাঁর জীবনধারা। সাধারণ মানুষের জমি জিরাত দখল করেই মূলত রাজীব অতি দ্রুত সম্পদশালী হয়েছেন বলেও মোহাম্মদপুর এলাকায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে।

রাজীবের বিরুদ্ধেঅভিযোগ জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।

স্থানীয়রা তাঁর এ দখলবাজির নাম দিয়েছে, যুবরাজের জীবন বদলের দখলবাজি। রাজীবের দখলবাজির শিকার ভুক্তভোগীরা শুধুই দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। কিন্তু কেউ দেখে না তাদের কষ্ট। বারবার অভিযোগ করেও হয়নি কোন কিনারা। তবে সরকারের চলমান শুদ্ধি অভিযানে তাদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। তাদের বিশ্বাস এবার হয়তো তাঁরা নিজেদের জমি ফেরত পাবেন। দু’মুঠো খেয়েপড়ে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করে কালের আলো। তবে তাকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।

রাজীবের দামি ব্র্যান্ডের কয়েকটি গাড়ি। ছবি: সংগৃহীত

কালের আলো/এআর/এমএইচএ