মোহাম্মদপুরের ‘যুবরাজ’ গ্রেফতারে শুদ্ধি অভিযানে গতি, দুশ্চিন্তার ভাঁজ নেতার কপালে

প্রকাশিতঃ 4:37 am | October 20, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

মোহাম্মদপুরের কথিত ‘যুবরাজ’ বলে কথা। কী দাপটই না দেখিয়েছেন গত ৫ বছর। তাঁর কথাই ছিল শেষ কথা। তটস্থ থাকতে হতো নানা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে। পান থেকে চুন খসলেই মহাবিপদ! নিজ দলের প্রবীণ নেতা বা মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে নিরীহ বাসিন্দা রেহাই পায়নি কেউ।

আরও পড়ুনঃ রাজীবের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগ : র‌্যাব

এমন পরিস্থিতিতে চলমান শুদ্ধি অভিযানে আশাবাদী হয়ে উঠে সবাই। আর এ অভিযানে নানা জল্পনা পর রাজধানীর ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের দোর্দন্ড প্রতাপশালী কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব হয়েছেন বন্দি। এতে খুশি হয়েছেন রাজীব ও তাঁর ক্যাডার বাহিনীর হাতে নানাভাবে নির্যাতিত সাধারণ মানুষ।

তাঁর গ্রেফতারে স্বস্তির ঢেুঁকুর তুলেছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাঁরা বলছেন, পাগলা মিজানের পর রাজীবেরও শেষ রক্ষা হয়নি। শেখ হাসিনার শাসনামলে সন্ত্রাসের রামরাজত্বের দিন শেষ।

এদিকে, রাজমিস্ত্রীর সন্তান থেকে দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হওয়া কাউন্সিলর রাজীবের গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে চলমান অভিযানে আবারও গতি ফিরে এসেছে বলে মনে করছেন দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।

আরও পড়ুন: কাউন্সিলর রাজীবের ‘দিনবদলের দখলবাজি’, দীর্ঘশ্বাসই যেন ‘নিয়তি’ সরফরাজ-ফারুকদের!

তবে আতঙ্ক পেয়ে বসেছে ক্ষমতাসীন দলের সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর। রাজীবকে শেল্টার দেওয়া সেই নেতার কপালে এখন দুশ্চিন্তার ভাঁজ। পাগলা মিজানের পর রাজীবের পতন তাঁর সাম্রাজ্য তছনছ করে দিচ্ছে। মুখে না বললেও চরম ভীতিতে দিন কাটাচ্ছেন। সময়টা বেশ খারাপ যাচ্ছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ঘনিষ্ঠদের।

এ শুদ্ধি অভিযানের পক্ষে যুক্তিকতা তুলে ধরে আওয়ামী লীগের একজন সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য কালের আলোকে বলেন, ‘সম্রাট, খালেদ বা মিজান-রাজীবদের মতো দুর্বৃত্তদের খপ্পরে পড়ে দেশের সাধারণ মানুষ ভুলতে বসেছিল আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল।’

তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি পরিস্কারভাবে উপলব্ধি করতে পেরেই এসব দুর্বৃত্তদের পতন ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছেন নেত্রী। আবারও জনগণের দল হিসেবে আওয়ামী লীগ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। রাজনীতিকদেরই রাজনীতি করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।’

আরও পড়ুন: বন্ধুর বাড়িতে আত্নগোপনে ছিলেন রাজীব, অবৈধ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার

রাজধানীতে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর পর পরই আলোচনায় চলে আসে রাজমিস্ত্রীর সন্তান থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের রাতারাতি উত্থানের বিষয়টি। মাত্র ৫ বছরে রকেট গতিতে নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন।

দখলবাজি, চাঁদাবাজি আর মাদক বাণিজ্যের মাধ্যমে কামিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। থাকতেন আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়িতে। চড়তেন বিলাসবহুল গাড়িতে।

যখন চলাফেরা করতেন তখন সামনে-পেছনে থাকতো শতাধিক ক্যাডারের বহর। নির্দয় ব্যবহারের কারণে ‘বেয়াবদ’ বিশেষণ যুক্ত হয়েছিল তাঁর নামের শেষে। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান গ্রেফতারের পর আতঙ্কে দৃশ্যপট থেকে সটকে পড়েন রাজীব।

আরও পড়ুন: র‌্যাবের হাতে কাউন্সিলর রাজীব গ্রেফতার

৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের এ কাউন্সিলর প্রায় সপ্তাহখানেক যাবত গ্রেফতার এড়াতে রাজধানী বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার চার নম্বর সড়কের ৪০৪ নম্বর একটি বাড়িতে গিয়ে উঠেন। ভেবেছিলেন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না র‌্যাব। কিন্তু শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাত ১১ টার পর থেকেই তাকে গ্রেফতারের খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর এ গ্রেফতারের খবরটি ছিল ‘টক অব দ্যা সিটি’।

রাজীবকে গ্রেফতারের পর পরই তাঁর মোহাম্মদপুরের বাসা ও বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। রাত ১১ টা থেকেই সেই বাসাটি ঘিরে রাখে র‌্যাব সদস্যরা।

রাজীবের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগ রয়েছে জানিয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম শনিবার (১৯ অক্টোবর) দিনগত রাত সোয়া ১ টার দিকে প্রেস ব্রিফিং করেন।

সেখানে তিনি জানান, ‘রাজীবের বন্ধুর ভাড়ার বাসা থেকে একটি বিদেশী পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি, ৭ বোতল বিদেশি মদ ও রাজীবের ব্যক্তিগত পাসপোর্ট জব্ধ করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে নগদ ৩৩ হাজার টাকাও। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের লাইসেন্স দেখাতে রাজীব ব্যর্থ হয়েছেন।’

যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও বলছেন, রাজীব ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি সরকারি দলের প্রভাবশালী এক নেতার কথিত ‘সন্তান’ হিসেবে মোহাম্মদপুর এলাকায় পরিচিত ছিলেন। ওই নেতার আশীর্বাদেই মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজত্ব গড়ে তুলেন এ ওয়ার্ড কাউন্সিলর।

অবৈধভাবে দলটির এক প্রবীণ নেতাকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর পদে জিতেন। রাতারাতি বদলে যায় সবকিছু। নিজের মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে ফিল্মি স্টাইলে বের হতেন আবার ঢুকতেও একই কায়দায়।

এদিকে, রাজীব গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে সংগঠন থেকেও ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, যুবলীগের পদ থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়েছে।  

প্রসঙ্গত, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীতে শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। এ অভিযানের শুরুতে গত গত ১৮ সেপ্টেম্বর র‌্যাব প্রথম গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। গ্রেফতারের পর তাকেও সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হয়।

এরপর গ্রেফতার হন ‘টেন্ডার কিং’ যুবলীগের গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, কৃষক লীগ নেতা সফিকুল আলম ফিরোজসহ বেশ কয়েকজন। খালেদ ও জি কে শামীম গ্রেফতারের পর ভারতে পালিয়ে যেতে চান সম্রাট।

কিন্তু তাকেও গ্রেফতার করা হয়। এরপর ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও শেখ হাসিনাকে হত্যাপ্রচেষ্টায় অভিযুক্ত ফ্রিডম মোস্তফার বড় ভাই পাগলা মিজানকে শ্রীমঙ্গল থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

কালের আলো/এএমএইচ/এএ