কাউন্সিলর রাজীবের অস্ত্রবাজ সেই ক্যাডাররা কোথায়?

প্রকাশিতঃ 6:44 pm | October 20, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের বহিস্কৃত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ডিএনসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব গ্রেফতার হওয়ার পরপরই তাঁর অবৈধ অস্ত্র ও অস্ত্রবাজ ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। সরকারি ও সাধারণ মানুষের জমি দখল, পরিবহন ও ফুটপাত চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গরুর হাট নিয়ন্ত্রণ, ডিশ ও মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে অস্ত্রবাজদের নিয়ে ক্যাডার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন রাজীব।

আরও পড়ুন: ‘জনতার কমিশনারের’ সম্পদের পাহাড়, গায়েব লেনদেনের আলামত!

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী এক নেতাকে অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করেই দিনের পর দিন এমন অপকর্ম করে বেড়াতেন তিনি। কোন সভা-সমাবেশে গেলে সঙ্গে রাখতেন অস্ত্রধারী ক্যাডারের বহর।

‘সুপার বেয়াদব’ হিসেবে পরিচিত এ কাউন্সিলর আত্মগোপনের পর র‌্যাবের হাতে ধরা পড়লেও তাঁর অস্ত্রধারী ১৩ ক্যাডার এখনও ‘অধরা’।

এলাকা বা দেশের ভেতরেই গা ঢাকা দিয়েছেন কেউ কেউ। ফলে এখন এদের কারও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এসব অস্ত্রধারী ক্যাডারদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলেই বহিস্কৃত যুবলীগ নেতা রাজীবের অপরাধ সাম্রাজ্যের অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন স্থানীয় এলাকার বাসিন্দারা।

আরও পড়ুন: মোহাম্মদপুরের ‘যুবরাজ’ গ্রেফতারে শুদ্ধি অভিযানে গতি, দুশ্চিন্তার ভাঁজ নেতার কপালে

ভোলার বাসিন্দা রাজীব বাবা তোতা মিয়ার সঙ্গে প্রায় ৮ বছর আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় আসেন। দরিদ্র পরিবারের এ সন্তান পরিবারের সঙ্গে থাকতেন ছোট্ট খুপরি ঘরে। এরপর ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করে মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক পদ থেকে বহিস্কার হন। এরপর কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতাকে ম্যানেজ করে পদোন্নতি পান। হন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ।

রাজনীতিতে রাজীবের উত্থান ও জীবনযাপন নিয়ে চমকপ্রদ কাহিনীর শেষ নেই যেন! তাঁর চলাফেরা, জামা-কাপড়ের মতো নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি বদলানোর স্টাইল দেখে যে কারও গোলকধাঁধায় পড়ে যাওয়ার কথা। কারণ, মাত্র অর্ধযুগ আগেও যিনি কাজ করতেন টং দোকানে!

আরও পড়ুনঃ রাজীবের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগ : র‌্যাব

সেই তিনিই কীভাবে দৃশ্যমান কোন ব্যবসাপাতি না থাকা সত্ত্বেও নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, বাপ-চাচাদের জন্যও বাড়ি-গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন এসব যেন রূপকথার গল্পকেই হার মানায়।

রোববার (২০ অক্টোবর) দুপুরে সরেজমিনে মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে বেড়ানোর সময় স্থানীয়রা কালের আলোকে বিভিন্ন তথ্য জানান। তাঁরা জানান, এ এলাকায় চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, টেন্ডারবাজি, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ আর মাদক বাণিজ্য করে গোটা এলাকাটিকে নিজের অপরাধ সাম্রাজ্যে রূপ দেন কাউন্সিলর রাজীব।

আরও পড়ুন: অবৈধ অস্ত্রের ভান্ডার ছিল যুবলীগের রাজীবের, বন্ধু মিশুই ‘নাটের গুরু’!

এখানকার বসিলা থেকে শুরু করে ওয়াশপুর, কাটাসুর, গ্রাফিক্স আর্টস ও শারীরিক শিক্ষা কলেজ, মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি এবং বাঁশবাড়ী এলাকায় ছিল তাঁর একচ্ছত্র দাপট। আর এসব অপকর্ম করতে পেশাদার ১৩ ক্যাডারকে ব্যবহার করতেন রাজীব।

আরও পড়ুন: কাউন্সিলর রাজীবের ‘দিনবদলের দখলবাজি’, দীর্ঘশ্বাসই যেন ‘নিয়তি’ সরফরাজ-ফারুকদের!

এছাড়া ঢাকার অপরাধ জগতের ভাড়াটে কিলার, চাঁদাবাজসহ অপরাধীদের সঙ্গেও গভীর সখ্য ছিল তাঁর। তাদের সমর্থন নিয়েই গোটা মোহাম্মদপুর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন রাজীব।

একই সূত্র জানায়, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও ফুটপাত ভাড়াসহ অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে দু’টি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন রাজীব। রাজীবের হয়ে পুরো বিষয়টি দেখভাল করতেন শাহ আলম জীবন। এক সময় জীবন ছিলেন গার্মেন্টস শ্রমিক। তাঁর মূল কাজ চাঁদার টাকা ভাগবাটোয়ারা।

রাজীব বাহিনীর অন্যতম এক সময়কার সিএনজি চালক সিএনজি কামাল ইয়াবা ব্যবসা ও পরিবহন চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী রহস্যজনক কারণে তাকে গ্রেফতার করতে পারে না। সিএনজি কামালের পাশাপাশি পরিবহন চাঁদাবাজির আরেকটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন অভি ফারুক।

ফুটপাত থেকে চাঁদাও তুলেন তিনি। এলাকায় যে কোন টেন্ডার ও জমি দখলে জুড়িমেলা ভার রাজীবের ‘ডানহাত’ ইয়াসিনের। এ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, শাহ আলম জীবন, ইয়াবা ব্যবসায়ী সিএনজি কামাল ও অভি ফারুকের নেতৃত্বে প্রতিমাসে কেবলমাত্র স্ট্যান্ড থেকেই প্রায় দুই কোটি টাকা চাঁদা তুলেন কাউন্সিলর রাজীব। মোহাম্মদপুর এলাকার ফুটপাতগুলো থেকে তোলা কোটি টাকা চাঁদাও যায় রাজীবের পকেটে।

আরও পড়ুন: বন্ধুর বাড়িতে আত্নগোপনে ছিলেন রাজীব, অবৈধ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বাসিন্দারা আরও জানান, মোহাম্মদপুর থেকে আল্লাহ করিম মসজিদ পর্যন্ত পুরো ফুটপাত থেকে ক’দিন আগেও নিত্য চাঁদা তুলতেন রাজীব বাহিনীর লোকজন। এ মসজিদ মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গায় দোকানপাট করে এসব দোকানপ্রতি একটা বড় অঙ্কের টাকা নিয়েছেন রাজীব।

স্থানীয় সূত্র আরও জানায়, কাউন্সিলর রাজীব এলাকায় তাঁর আধিপত্য বিস্তার ও বজায় রাখার জন্য নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীকে ব্যবহার করতেন। গরুর হাট থেকে শুরু করে ফুটপাত, বহুতল ভবনে চাঁদাবাজি এবং টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রণ ছিল রাজীবের এ সিন্ডিকেটের কাজ।

আরও পড়ুন: র‌্যাবের হাতে কাউন্সিলর রাজীব গ্রেফতার

এ সিন্ডিকেটের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ ছিলেন ইস্রাফিল। কাউন্সিলর রাজীবের হয়ে গরুর হাট নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। ফুটপাতে চাঁদাবাজিতে রয়েছে দেলোয়ারের কদর। ডিশ ব্যবসা ও কিশোর গ্যাং গ্রুপের নিয়ন্ত্রক জাকির।

মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন কোরবান আলী। ঢাকা উদ্যানে ছিনতাই ও চাঁদাবাজ গ্রুপের ঠিকাদারীর দায়িত্বে রয়েছেন রুহুল আমিন। জমি দখলবাজিতে কুখ্যাতি রয়েছে নাজমা, শাহনাজ, চান্দু ও ইব্রাহিমের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজীবের এ ১৩ ক্যাডার উঠে এসেছেন ফুটপাত থেকে। তাদের কোন সামাজিক মান মর্যাদা নেই। ফলে যখন তখন মারপিট কিংবা দাঙ্গা হাঙ্গামায় অংশ নেন যে কারও সঙ্গে। মূলত এদেরকে নিয়ে সবাই আতঙ্কে থাকতেন।

স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারাও এদের ‘সমঝে’ চলতো বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব ক্যাডারের কাছে অবৈধ একাধিক দামি ও অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। অনেকেই নিরাপদ জায়গায় তাদের অস্ত্র সরিয়ে নিয়েছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী সূত্র জানায়, রাজীবকে গ্রেফতারের আগে থেকেই তাঁর ফুটপাত, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিসহ সব রকমের অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারী মাঠ পর্যায়ের ক্যাডার ও মাস্তানদের বেশিরভাগ আত্মগোপন করে আছেন। অনেকে আবার ভোল পাল্টে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার আশ্রয়ে চলে গেছেন। তবে তাদেরকেও পর্যায়ক্রমে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

কালের আলো/ওএইচএম/এমএএএমকে