আদাবরে দুই ভাইয়ের ‘শাসন’, বাস্তবে কত ‘ভয়ঙ্কর’ হাসু-কাসু?
প্রকাশিতঃ 12:23 pm | October 31, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
অতি সামান্য একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। অথচ আদাবর-শেখেরটেক এলাকার যেন একচ্ছত্র ‘অধিপতি’। সবই চলে তাঁর মন-মর্জিতে! সরকারি খাস জমি থেকে শুরু ব্যক্তিমালিকানার জমি যেমন দখলে নিয়েছেন তেমনি সুযোগ বুঝে বিক্রিও করেছেন। রেহাই মেলেনি হতভাগ্য সড়ক-ফুটপাতেরও। অর্ধশত প্লট ও বাড়িতে থাবা বসিয়েছেন। আয়ত্তে নিয়েছেন নিজের।
আরও পড়ুন: হাসু-কাসু’র সাম্রাজ্যে ‘পিষ্ট’ আওয়ামী লীগ
বাঁধা এলে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে কুপিয়ে জখম করার ঘটনাও ঘটিয়েছেন অহরহ। মাথায় টুপি, মুখে দাঁড়ি, শ্যামবর্ণের এ মানুষটি সব সময় পরিপাটি পোশাক পড়েন। বেশভূষা দেখে বোঝার ওপায় নেই এ মানুষটি কত ভয়ঙ্কর!
তাঁর নাম আবুল হাসেম হাসু। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।
হাল সময়কার দামি গাড়ি আর বিশাল বহর ছাড়া তাঁর চলার রেওয়াজ নেই। ছোট ভাইয়ের একনায়কতন্ত্রের রাজ্যে বড় ভাই আবুল কাশেম কাসুও যেন ক্ষমতায় কানায় কানায় ভরপুর। অন্যের জমি, ফ্ল্যাট-প্লট দখলে তাঁরও হাত পাকা। দুই ভাইয়ের কব্জায় আছে এমন কয়েকশ’ বিঘা জমি ও প্রায় শতাধিক প্লট, ফ্ল্যাট ও দোকান।
স্থানীয় নতুন ভবন, দোকান, অফিস ও হাসপাতাল থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি আর মাদক কারবারে সম্পদে ‘স্বাস্থ্যবান’ হয়েছেন। রয়েছে ‘টর্চার সেলে’ নির্যাতনের রোমহর্ষক কাহিনীও। নিজেদের রাজত্বে সিনেমার গল্পের মতোই যেন তাঁরা দুই ভাই ‘রাজা’ বাকী সবাই ‘প্রজা’।
মোগল সাম্রাজ্যের মতো রাজধানীর আদাবর-শেখেরটেক এলাকার মানুষকে এভাবেই ‘নিজস্ব আইনে’ শাসন-শোষণ করছেন।

তাঁর আছে কিশোর গ্যাংসহ অস্ত্রবাজ নানা বাহিনী। তাঁর সম্মতি ছাড়া এখানে কোন কিছুই করার সুযোগ নেই কারও। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। জমেছে অভিযোগের পাহাড়। কিন্তু নির্বিকার থানা-পুলিশ। আর এমনটিই বা হবে না কেন, অর্থসম্পদ আর ক্ষমতায় সবকিছুই যে হাসু-কাসু’র ‘পকেটে’!
সরেজমিন অনুসন্ধানে ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ থেকে দুই ভাই আবুল হাসেম হাসু ও আবুল কাশেম কাসুর অপকর্মের এসব তথ্য মিলেছে। তবে তাদের নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে এখনও এলাকার সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস করেন না। যদিও সরকারের চলমান অভিযান ভুক্তভোগীদের মুখ খুলে দিয়েছে।
রিকশা চোরের সর্দার থেকে কাউন্সিলর
স্থানীয় এলাকার বাসিন্দারা জানান, অভাব আর দারিদ্র্যতার শেকলে বন্দি জীবন ছিল আবুল হাসেম হাসু ও আবুল কাশেম কাসুদের। নব্বই দশকে বাবা ফজর আলী এখানে সেখানে আখ ফেরি করে বিক্রি করতেন। থাকতেন রাজধানীর আগারগাঁও বস্তিতে।
টানাটানির সংসারে সামান্য আয়েই জুটতো খাবার। বাবা একদিন ঘরে বসে থাকলে উপোস থাকতে হতো।
চরম দারিদ্র্যের অন্ধকার ঘরে টিকতে না পেরে অন্য পথ বেছে নিলেন দুই ভাই। শুরু করলেন রিকশা চুরি। হয়ে গেলেন চোরদের সর্দার। ওই বস্তিতে সেই সময় আনাগোনা ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসীদের। ফুটফরমায়েশ খাটতে খাটতে তাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন। তাদের সংস্পর্শে জীবনে চলে আসে নাটকীয় পরিবর্তন।

গড়ে তুলেন অস্ত্রবাজ বাহিনী। এলাকায় টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রাতারাতি বদলে যায় জীবন। ২০০২ সালের গোড়ার দিকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে বীরদর্পে চাঁদাবাজি ও দখল শুরু করেন।
বিএনপি’র প্রভাবশালী গুটিকয়েক নেতার সঙ্গে ‘দহরম মহরম’ সম্পর্কের কারণে স্থানীয় প্রশাসনও তাদের সামনে বাঁধার দেয়াল তৈরি করতে পারেনি।
এরপর সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঢুকে যান। বাগিয়ে নেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ। অবৈধ দখলবাজি ও চাঁদাবাজির কারণে দল থেকে বহিস্কৃত হন।
২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নিজের ক্যাডার বাহিনীর জোরে কেন্দ্র ব্লক করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
শরীফ উদ্দিন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা কালের আলোকে বলেন, হাসু-কাসু’র পৈতৃক কোন সম্পত্তি ছিল না। কিন্তু জমি দখল, চাঁদা আদায় আর মাদক বাণিজ্যের মাধ্যমে আঙুল ফুলে বটগাছ হয়েছেন। মূলত দখল, চাঁদাবাজি আর মাদক ব্যবসাই তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। হাসু কাউন্সিলর হওয়ার পর তাদের অপকর্ম আরও বেড়েছে।
অতি দরিদ্র পরিবার থেকে ‘ধনকুবের’ বনে যাওয়া হাসু-কাসুদের দেখে বিস্মিত স্থানীয় এলাকার লোকজনও। সরেজমিনে আদাবর এলাকায় গেলে সাংবাদিক পরিচয় জানার পর বেশ কয়েকজন দোকানি আড়ালে গিয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন।

হাসু-কাসু’র ক্যাডারদের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা থেকেই নিজেদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা কালের আলোকে বলেন, ‘দখলবাজি, চাঁদাবাজি আর অপকর্মের মাধ্যমে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন হাসু-কাসু। তাদের বিরুদ্ধে কারও কিছু বলার সাহস নেই।
তবে চলমান দুর্নীতি ও সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে তাঁরা আইনের আওতায় এলে আদাবর-শেখেরটেকের বাসিন্দারা জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাবে।’
একক প্রভাব খাটিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন দখলদারি
সরেজমিনে আদাবর ও শেখেরটেক এলাকায় কালের আলো টিম পৌঁছলে ভুক্তভোগীরা কাউন্সিলর আবুল হাসেম হাসু ও তাঁর ভাই আবুল কাশেম কাসুর বিরুদ্ধে দখলদারিত্বের অভিযোগ উত্থাপন করেন।
তাঁরা জানান, হাসু-কাসু অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে, হামলা-মামলা ও জাল স্বাক্ষরে ভূয়া দলিলে তাদের প্লট ও জমি দখল করা হয়েছে। জমি-প্লট দখলে অনেক ভুক্তভোগীকে মিথ্যা হত্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে তাঁরা।
দেলোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তি জানান, উত্তর আদাবরের ১৪৫/৩ নম্বরের একটি প্লট দখল করে নিয়েছেন হাসু-কাসু। একইভাবে আদাবর ৬ নং রোডের মাথায় আলী হোসেনের ২০৩ দাগে ৬৪ কাঠা ও ২০৯ দাগে ১৬০ কাঠা পৈতৃক জমি দখল করা হয়েছে। এ আলী হোসেন এখন ২৫/১ শ্যামলীর বাসিন্দা।

কালের আলোকে তিনি বলেন, আমার পৈতৃক জমি হাসু-কাসু দখল করার পর আমি আদালতে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করি। এর মধ্যে ২০৯ দাগের জমির জন্য ২০০৭ সালে দায়ের করা মামলাটি ৭ বছর চলার পর বিবাদী পক্ষ আদালতে কোনো জবাব দেয়নি। তাই আদালত কাগজপত্র দেখে আমাদের পক্ষে রায় দেন। আর ২০৩ দাগের মামলাটি এখন বিচারাধীন রয়েছে।
শেখেরটেক এলাকায় হাজী মো. ইউসুফের ৩ কাঠা ও বায়তুল আমান হাউজিংয়ে সাড়ে ৫ কাঠা জমি দখল হয়েছে। নবোদয় হাউজিং এলাকায় চারটি প্লট, মালেক গলিতে দুটি, আদাবরের বিভিন্ন রোডে সাতটি প্লট, আদাবরের ১০ নম্বর রোডের ৫৯৫ নম্বরের ১০ কাঠা প্লট, ১৩ নম্বর রোডে জমি দখল করে ১০টি দোকান, হোসনাবাদ মার্কেটের পাশে ১০ কাঠার প্লট দখল করে নিয়েছেন দুই ভাই হাসু-কাসু।
স্থানীয়রা আরও অভিযোগ করেন, আলিফ হাউজিংয়ের খাল দখল করে অফিস নির্মাণ, মনসুরাবাদ ব্রিজের পাশে জায়গা দখল করে অফিস নির্মাণ, কমফোর্ট হাউজিং ও সুনিবিড় মধ্যস্কুল এলাকায়ও কয়েকটি প্লট দখল করেছেন হাসু-কাসু চক্র। একটি মাদ্রাসার নামে লিখে নিয়েছেন আজিজ গার্মেন্টসের জমি। অন্যের জমি দখল করে কাঁচাবাজার বানিয়ে মাসিক চাঁদা তুলছে এ চক্রের সদস্যরা।
শেখেরটেক ও বায়তুল আমান হাউজিংয়ের ১০ নম্বর রোডের শেষ মাথায় ৫টি প্লট দখলে নিয়েছে হাসুর ঘনিষ্ঠ হাজী মোজাম্মেল হক ও অন্যরা। অথচ এ জমির মালিক ইউসুফ হাজির পরিবার। ইউসুফ হাজির ছেলে ইয়াসিন রহমান বলেন, ‘জমি উদ্ধারে কত জায়গায় ছুটলাম।

প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কাছেও ধর্ণা দিলাম। কিন্তু জমি আর ফেরত পেলাম না। এই দখলবাজদের দৌরাত্ম ঠেকানোর কেউ নেই।’
কমফোর্ট হাউজিংয়ের আদাবর ১৭/এ রোডের শেষ মাথায় ২টি প্লট, ১৬ নম্বর রোডের কাঁচা বাজারের সাত কাঠা জমি দখল এবং ১৬/এ রোডের মসজিদ গলিতে জমি দখল করে কাউন্সিলরের লোকজন ব্যবসা করছেন।
বায়তুল আনাম ১০ নম্বর রোডের শেষ মাথায় ব্রিজের কাছাকাছি সাড়ে ৫ কাঠা ও শেখেরটেক ৭ নম্বর রোডের মাথায় মজিদবাগ এলাকার ৩ কাঠা জমির মালিক মো. ইয়াছিন। কালের আলোকে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘হাসু-কাসু চক্র আমার জমি দখল করে নিয়েছে। এ নিয়ে আমি মামলার পাশাপাশি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাইনি।’
দখলবাজিতে মোহাম্মদপুর এলাকার দুই কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবও পাগলা মিজানকেও যেন হার মানিয়েছেন কাউন্সিলর আবুল হাসেম হাসু। তাদের দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে দখলবাজির বিস্তর অভিযোগ তুঙ্গে উঠেছে।
উত্তর আদাবরের ১৪৫/৩ প্লটের মালিক দেলোয়ার হোসেন কালের আলোকে বলেন, ‘আমার জমিতে দু’তলা ভবন নির্মাণ করেছেন হাসু-কাসু।

গত ৭ বছর যাবত আমার জমিটি ফেরত পেতে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের সবার কাছে গিয়েছি। কিন্তু হাসু-কাসু’র বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশন হয়নি।’ কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘এ দখলদার দুই ভাইয়ের হাত থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমাদের জমি আমরা ফেরত চাই।’
অভিযোগ রয়েছে, আদাবর ১০ নং রোডের মাথায় ৫৯৫ নম্বরের ১০ কাঠা প্লট দখল করে সেখানে জাতীয় পার্টির অফিস বানিয়ে দখলে রেখেছে হাসু-কাসু’র সাঙ্গপাঙ্গরা। এ প্লটসংলগ্ন অনেক দোকানও রয়েছে। ১৩ নং রোডে জমি দখল করে প্রায় ১৮ থেকে ২০টি দোকান তৈরি করা হয়েছে।
হোসনাবাদ গার্মেন্টসের পশ্চিম পাশে ১০ কাঠা প্লট, আলিফ হাউজিংয়ে খাল দখল করে অফিস নির্মাণ, মনসুরাবাদ ব্রিজের পাশে জায়গা দখল করে অফিস নির্মাণ করা হয়েছে। কমফোর্ট হাউজিং ও সুনিবিড় মধ্যস্কুল এলাকায়ও কয়েকটি প্লট দখলে রয়েছে হাসু-কাসু চক্রের।

নিজের পক্ষে সাফাই
এসব অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসেম হাসু’র সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে কালের আলো। তবে তাকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
যদিও এসব অভিযোগের বিষয়ে একাধিক গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘পৈতৃকভাবেই তিনি বিশাল সম্পত্তির মালিক। এনবিআরে এ সংক্রান্ত ফাইলও আছে। চাঁদাবাজি করে আমি এসব করিনি। বরং নির্বাচিত হয়ে ১০ কাঠা জমি বিক্রি করেছি।’
তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকতে পারে। কারণ আমি কাউন্সিলর। আমার পক্ষে-বিপক্ষে লোক আছে। অনেকেই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে। আমি স্বতন্ত্র কাউন্সিলর। সরকারদলীয় কাউন্সিলর না যে, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যাবে না। মাদকের সঙ্গেও আমি জড়িত নই। এসব অপপ্রচার।’
কালের আলো/এমএইচএ/এমএএএমকে