বাণিজ্যে ১০ নেত্রী, ২০ হাজার টাকায় সিট ইডেন কলেজের আবাসিক হলে!
প্রকাশিতঃ 9:57 am | November 17, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :
সিট বাণিজ্য চরম আকার নিয়েছে রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের আবাসিক হলগুলোতে। ৬ টি আবাসিক হলের বেশিরভাগ কক্ষই কব্জায় নিয়েছেন ছাত্রলীগের আলোচিত ১০ নেত্রী। এসব হলের অনেক কক্ষকে তাঁরা ‘পলিটিক্যাল’ রুম নাম দিয়েছেন।
পলিটিক্যাল সিটে একজন সাধারণ শিক্ষার্থীকে উঠানোর জন্য তাদের জিম্মি করে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তবে এ বাণিজ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন বহুল বিতর্কিত বিবাহিত ছাত্রলীগ নেত্রী আঞ্জুমান আরা অনু। ছাত্রলীগের একেক সময় একেক কেন্দ্রীয় নেতার নাম ভাঙিয়ে প্রতিনিয়ত নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
তবে এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন কলেজ প্রশাসন। ঘনিষ্ঠদের কাছে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন কলেজটির অধ্যক্ষ শামসুন নাহার। এসব ঘটনায় যে কোন সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিকবার অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি।
জানা যায়, দিনের পর দিন অবৈধ সিট বাণিজ্য চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ইডেন মহিলা কলেজে। কলেজের আবাসিক হলের সিট ভাড়ার তুলনায় আশপাশের এলাকার মেসগুলোর কয়েকগুণ বেশি সিট ভাড়া এবং সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে বেশিরভাগ ছাত্রীরই লক্ষ্য থাকে কলেজের হলে অবস্থানের।
আবার অনেকের বাইরে থাকার সামর্থ্য না থাকায় তাঁরা মাসিক মাত্র ৩৭৫ টাকা খরচায় কলেজের হলেই থাকতে চান। তবে সিটের তুলনায় প্রার্থী অনেক হওয়ায় সবার ভাগ্যেই এ সুযোগ জুটে না। আর এ সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়ে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে কলেজ ছাত্রলীগের গুটিকয়েক নেত্রীরা।
সর্বশেষ গত ৯ নভেম্বর সিট বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে আধিপত্য ধরে রাখতে ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের দু’পক্ষের নেত্রীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেদিন কলেজের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে অর্থের বিনিময়ে বহিরাগত ছাত্রীকে সিট দেওয়াকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের দুই নেত্রীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।
সেদিন নিজ সংগঠনেরই এক নেত্রীর ধারালো অস্ত্রের কোপে আহত হন সাবিকুন্নাহার ওরফে তামান্না নামে এক ছাত্রলীগকর্মী। এ ঘটনায় বহুল সমালোচিত কলেজ ছাত্রলীগ নেত্রী আঞ্জুমান আরা অনু’র অনুসারীরা হলে হলে মহড়া দেয়।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সাধারণ কক্ষের চেয়ে কলেজের প্রতিটি হলেই ‘পলিটিক্যাল রুম’ এর সংখ্যা বাড়ছে। এই ‘পলিটিক্যাল রুমে’ সিটে ওঠানোর জন্য প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের টার্গেট করছেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। হল র্কর্তৃপক্ষ প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের সিট বরাদ্দ না দেওয়ায় ‘পলিটিক্যাল সিটে’ ওঠানোর ক্ষেত্রে প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও নিচ্ছেন তারা।
নবীন ওই ছাত্রীদের কাছ থেকে এককালীন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। আবার মাস্টার্স শেষ হয়েছে এমন অনেককেও অবৈধভাবে হলে সিট দিচ্ছেন তারা। এক্ষেত্রে প্রতি মাসে নেওয়া হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।
কলেজ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইডেন মহিলা কলেজে হজযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছাত্রীনিবাস, খোদেজা খাতুন ছাত্রীনিবাস, রাজিয়া ছাত্রীনিবাস, হাসনা বেগম ছাত্রীনিবাস, জেবুন্নেছা ছাত্রীনিবাস এবং শহীদ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রীনিবাসে মোট আসনসংখ্যা হচ্ছে ৩ হাজার ৩১০। এসব আসনের বিপরীতে এখানে থাকছেন প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থী। ফলে প্রতিটি কক্ষেই গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের আয়েশা সিদ্দিকা হলের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক আবাসিক ছাত্রী জানান, হলটিতে প্রায় ১ হাজার সিটের বিপরীতে তিন থেকে চার হাজার ছাত্রী রয়েছে। প্রতি ফ্লোরেই ৬ থেকে ৭ টি রুমের মধ্যে ৩ থেকে ৪ টি রুম পলিটিক্যাল। এসব রুমে চারটি করে বেড থাকলেও ১৭ থেকে ১৮ জনও থাকছে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে এ শিক্ষার্থী কালের আলোকে বলেন, এক সময় বৈধভাবেই শিক্ষার্থীরা হলে থাকতো। এখন সেই চলন উঠে গেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কম সিট দেওয়ার সুযোগ লুফে নিচ্ছে ছাত্রলীগের কলঙ্ক ১০ নেত্রী।
তাদের ম্যানেজ করেই অবৈধভাবে সিট নিচ্ছে অনেকেই। আর এজন্য একেকটি সিটের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আবার কলেজ কর্তৃপক্ষ কোন শিক্ষার্থীকে বৈধ করলে প্রতি দুই বছরের জন্য দিতে হচ্ছে ৯ হাজার টাকা। এসব রীতিমতো জুলুম।’
কলেজটির সাধারণ শিক্ষার্থীরা সিট বাণিজ্যের অভিযোগের আঙুল তুলেছেন সংশ্লিষ্ট কলেজ ছাত্রলীগের ১০ নেত্রীর মধ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া কলেজ শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক আঞ্জুমান আরা অনু। ছাত্রলীগের অব্যাহতি পাওয়া সভাপতি শোভন ও রাব্বানীর ঘনিষ্ঠ এ নারী নেত্রী অনেক ঘটন-অঘটনের পরেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
বিয়ের বিষয়টি গোপন করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেওয়ায় চরম বিতর্কের মুখে পড়তে হয় শোভন-রাব্বানীকে। যেসব নেত্রীদের বিরুদ্ধে পরিচয় গোপন করে পদ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
একই সূত্র বলছে, আঞ্জুমান আরা অণুর সমর্থকদের বিরুদ্ধেও রয়েছে সিট বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ। তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই ছাত্রলীগ কর্মী উর্মি এবং সোনালী অবৈধভাবে কয়েকটি কক্ষ দখল করে আছেন। তাদের ‘গুরু’ অনু কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পদ পাওয়ার পর উর্মি ও সোনালীর মতো অনুসারীদের বেপরোয়া আচরণের মাত্রা অন্য সব সময়কে ছাপিয়ে গেছে।
কলেজ শিক্ষার্থীদের কাছে অভিযুক্ত আরও ৯ ছাত্রলীগ নেত্রী হলেন- কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক তাসলিমা আক্তার, যুগ্ম আহ্বায়ক নাসিমা আক্তার, মাহবুবা নাসরিন রূপা, জান্নাত আরা জান্নাত, রিভা আক্তার, পাপিয়া আক্তার প্রিয়া, বিপাশা হায়াত রনি, বিথি আক্তার ও ইতি আক্তার।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবা নাসরিন স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ‘অনুর যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। একাধিকবার তাকে নিয়ে বৈঠক করেছি শোধরানোর জন্য। কিন্তু সে কারও তোয়াক্কা করে না।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগ নেত্রী আঞ্জুমান আরা অনু কালের আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়। সিট বাণিজ্যের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বিশেষ উদ্দেশ্যে কেউ কেউ জড়িয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে।’
নিজেকে কেন্দ্রীয় নেত্রী দাবি করে ‘বিতর্কিত’ আঞ্জুমান আরা অনু কালের আলোকে বলেন, ‘আমি এখন কেন্দ্রীয় নেত্রী। তাছাড়া ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের কমিটি অনেক আগেই বিলুপ্ত করে দিয়েছে।’
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক তাসলিমা আক্তারের সঙ্গে যোাগযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
কালের আলো/এসআর/এএমএ