আবেগরুদ্ধ কন্ঠে কম্পিত গলায় উচ্চারণ প্রধানমন্ত্রীর, অশ্রুতে ছলছল সবার চোখ
প্রকাশিতঃ 6:20 pm | November 21, 2019
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
স্বজন হারানোর বেদনা যে কত কঠিন, নির্মম সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো কেউ বোঝে না। ১৯৭৫’র ১৫ আগস্টের ভয়ঙ্কর কালো রাতে বাবা-মা’সহ পরিবারের ১৮ সদস্যকে হারিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ইতিহাসের কলঙ্কজনক ওইদিনের স্মৃতিচারণ করতেই অশ্রুসজল হয়ে উঠেন প্রধানমন্ত্রী।
ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে হৃদয়। মুহুর্তেই বেদনায় ভারী হয়ে উঠে সেনাকুঞ্জের পরিবেশ। অশ্রুতে ছলছল করে ওঠে পেছনে দাঁড়ানো প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব:) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদসহ সবার চোখ। কিন্তু ষোল কোটির বাংলাদেশই তাঁর শক্তি।
> সশস্ত্র বাহিনী দিবসে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর
এদেশের মানুষের প্রতিই তাঁর অগাধ আস্থা এবং বিশ্বাস। ফলে মানসিকভাবে আবারও নিজের অমিত দৃঢ়তার কথাই জানান দেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মঞ্চে ভাষণ দিতে গিয়ে খানিক সময়ের জন্য এমন বেদনাবিধূর দৃশ্যের অবতারণা হয়।
‘বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন, সশস্ত্র বাহিনী সারা বিশ্বের কাছে একদিন সম্মান নিয়ে আসবে’ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘একদিকে যেমন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সেই দেশের কথা কেউ চিন্তা করতে পারবেন না। যখন মুক্তিযুদ্ধ চলে এক বছর কোন ফসল উৎপাদন হয়নি। ৮২ ভাগের ওপর মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করতো। মানুষের খাদ্য ছিল না, থাকার ঘর ছিল না, চিকিৎসার ওষুধ ছিল না। মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করতো। তাঁর ওপর যুদ্ধের ভয়বাহতা ও ধ্বংসস্তুপ।
>সশস্ত্র বাহিনী দিবসে দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী, বিনিময় করলেন শুভেচ্ছা
সেই ধ্বংস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু সেই অবস্থায়ও তিনি সশস্ত্র বাহিনীকে গড়ে তোলার ব্যাপক পদক্ষেপ নেন। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সাংগঠনিক কাঠামোর উন্নতির জন্য তিনি মিলিটারী একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ওই অবস্থায় অনেক সামরিক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি যখন পেশ করেছিলেন তখন নৌ বাহিনীর মূল ঘাঁটি যেন আমাদের এ ভূখন্ডে হয় সেই দাবিও তিনি তুলেছিলেন, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই বঙ্গবন্ধু সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করেন। আমাদের বিমান বাহিনী গড়ে তোলার জন্য ৭৩ সালে অত্যাধুনিক সুপারসনিক মিগ-২১ যুদ্ধ বিমানসহ হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান, এয়ার রাডার ইত্যাদি সংযোজন করে বিমান বাহিনীকে আধুনিকায়ন করে গড়ে তুলতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
সেই সাথে আমাদের প্রতিরক্ষা নীতিমালা তিনি প্রস্তুত করে দিয়ে যান। মাত্র তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। এ স্বল্প সময়ের মধ্যেই একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে রাষ্ট্র হিসেবে তিনি যখন প্রতিষ্ঠা করেন ১২৬ টি দেশের স্বীকৃতি পাই আমরা। ওআইসি, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পদ আমরা অর্জন করি।
বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী দেশ হিসেবে মর্যাদা পায়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুকে ৭৫’র ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এটা শুধু একটি পরিবারের জন্য না একই সাথে আমার পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং কারাগারে জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করা হয়। আমি আমার ছোট বোন বিদেশে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলাম। ৬ বছর দেশে আসতে পারিনি। আমরা বাধ্য হয়েছিলাম রিফিইজি হিসেবে বিদেশে থাকতে, বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আরও পড়ুন: চাল নেই লবণ নেই বলে একটি গোষ্ঠী অপপ্রচার চালাচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী
আরও পড়ুন: ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশ খুনের রাজ্যে পরিচিত হয় : প্রধানমন্ত্রী
তিনি বলেন, ‘১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করে জনগণের সমর্থন নিয়ে আমি দেশে ফিরে আসি, একটি প্রত্যয় নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর কাঙ্খিত ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলবো।’
নিজের ভাষণের এ পর্যায়ে আবেগমথিত হয়ে উঠে তাঁর কন্ঠস্বর। আবেগরুদ্ধ কন্ঠে কম্পিত গলায় প্রধানমন্ত্রী উচ্চারণ করেন, ‘আমার দুই ভাই কামাল-জামাল দু’জনেই মুক্তিযোদ্ধা। জামাল কমিশন নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। ছোট ভাই রাসেলের লক্ষ্য ছিল বড় হলে সেনাবাহিনীতে যোগদান করবে। দুর্ভাগ্য সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট তাদের কেড়ে নেয়।
কাজেই আমি যখন এখানে আসি আমার বাবার সেই কথাগুলো বারবার মনে পড়ে।’ এ কথাগুলো উচ্চারণের ফাঁকে বুকের ভেতরটি মোচর দিয়ে উঠে বলেই কীনা আবারও স্তব্ধ হয়ে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা।
পরক্ষণে নিজেকে স্বাভাবিক করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ২১ বছর পর সরকার গঠন করি। যখন সরকার গঠন করি তখন থেকেই সশস্ত্র বাহিনীর সার্বিক উন্নয়নে কাজ শুরু করি। সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক ও যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেই। সশস্ত্র বাহিনী এখন আমাদের দেশের আর্তমানবতার সেবায় সব সময় ভূমিকা রেখে চলে। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
কিছুদিন আগে বিশাল আকারের ঘূর্ণিঝড় এসেছিল সেই সময়ও সশস্ত্র বাহিনী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে ১১ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। সেই আশ্রয়কালীন সময় থেকেও তাঁরা বিরাট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আমাদের প্রশাসন, বর্ডার গার্ড ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী সব ধরণের সহযোগিতা করে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যাতে ভালোভাবে বসবাস করতে পারে, তাদের নিরাপত্তারও ব্যবস্থা নিচ্ছে। বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। দায়িত্ব পালনকালে অন্য দেশের শান্তি রক্ষা করতে গিয়ে অনেক শান্তিরক্ষী জীবন দিয়েছে। তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। স্বজন হারানোর বেদনা কী আমি বুঝি।’
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের এ অনুষ্ঠান মঞ্চে বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল মশিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, নৌ বাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী, সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো: মাহফুজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে স্পিকার ড.শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি, শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি এমপি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.কে আব্দুল মোমেন, কৃষিমন্ত্রী ড.আব্দুর রাজ্জাক, তথ্যমন্ত্রী ড.হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোঃ নজিবুর রহমান, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার)সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিবসহ সশস্ত্র বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কালের আলো/এডিবি/এমএএএমকে