প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার ‘দৌড়ে’ কূটকৌশল থিউরিতে হঠাৎ আলোচনায় এলজিইডি!
প্রকাশিতঃ 7:16 pm | November 24, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
বাতিক নেই বিদেশ সফরের। সময়ের কাজ সময়ে করতে পারঙ্গম। বড়-ছোট প্রকল্পে ঠিকঠাক কাজের মান, অধিদফতরে নিয়োগ-পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছেন। গ্রামের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ সড়কে বিটুমিনের বিকল্প হিসেবে ইউনিব্লক ব্যবহারে খরচ সাশ্রয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠানটিকে খোলনলচে পাল্টে দিতে নিজেকে ‘রাউন্ড দ্যা ক্লক’ সক্রিয় রেখেছেন।
প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বদলী আতঙ্ক দূর করে রাজধানী কিংবা মফস্বল যেখানে অনিয়ম, সেখানেই শাস্তি নিশ্চিতে হার্ডলাইন নিয়েছেন। কোন প্রান্তে সমস্যা দেখার জন্য ‘অফিস ডে’র বাইরে বেছে নিয়েছেন সাপ্তাহিক ছুটির দিনকে। তবুও বিদায়ের হাতছানি! সরকারি নিয়মে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার সময়ক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। সেই হিসেবে আর মাত্র ১৯ দিন বাকী।
সরকারি চাকরির বয়স শেষ হওয়ার মাত্র ৮ মাস আগে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিয়ে কর্তব্যপরায়ণতায় রীতিমতো এক উদাহরণ তৈরি করেছেন মো: খলিলুর রহমান। প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নতুন করে তিনি কী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাবেন না কী এ পদটিতে কোন নতুন মুখ আসবে এ নিয়েও চলছে তুমুল জল্পনা। দৌড়ঝাঁপও শুরু করেছেন সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেটরা।
অবশ্য ভাবনা-চিন্তার প্রথম পথটি বন্ধ করতে ইতোমধ্যেই ‘কুটকৌশল’ থিউরি বাস্তবায়নে সক্রিয় তৎপরতা চলছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের ভাষ্যমতে, এলজিইডি’র বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী ও তার পরিবারকে জড়িয়ে নানামুখী অপপ্রচারের পাশাপাশি খিস্তিখেউরও করে বেড়াচ্ছে একটি চক্র।
অথচ খলিলুর রহমান নিয়ম মেনে অবসরে গেলে পদপ্রত্যাশী আরও চার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর সরকারি চাকরির আয়ুও মাত্র ১৩৪ দিনের মধ্যেই শেষ হওয়ার তথ্যে ঘন ঘন পদোন্নতির অস্থিরতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে অধিদফতরটিতে। খবর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের।
জানা যায়, চলতি বছরের ৭ মে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ওই সময়কার জ্যেষ্ঠতম অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা) মো: খলিলুর রহমান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এমপি ও সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ’র দিকনির্দেশনা ও আন্তরিকতায় দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় এলজিইডিকে গর্বিত অংশীদার করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
মনোযোগ দেন উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক প্রশস্ত ও শক্তিশালীকরণের কাজে। ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা টাকা ব্যয়ে এ কাজ চলছে জোরেশোরে। যেসব সড়কে বাস চলে অথবা ট্রাফিকের পরিমাণ বেশি এমন জনবহুল সড়ককে ‘ডাবল লেনে’ উন্নীত করার জোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে ইউনিয়নের আগে উপজেলার সড়কসমূহকে টার্গেট করা হয়েছে। নতুন নতুন প্রকল্পের আওতায় এসব কর্মযজ্ঞের বাস্তবায়ন চলছে।
সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কালের আলোকে বলেন, প্রকল্পের টাকায় এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বিদেশ সফরের হিড়িকের নেতিবাচক সমালোচনার সময়েও নিজেকে বিতর্কমুক্ত রেখেছেন এলজিইডি’র এ প্রধান প্রকৌশলী।
গত সাড়ে ৭ মাসের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে হালসময়কার এ ‘ট্র্যাডিশন’ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন। একদিনের জন্যও তার বিদেশ সফরে যাওয়ার রেকর্ড নেই। তাঁর সময়ে নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগের কথা শোনা যায়নি। উন্নয়ন কাজ থেকে শুরু করে, বদলী, পদোন্নতি ও পোস্টিং’র ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সম্প্রতি একসঙ্গে ৪২ জন জ্যেষ্ঠ উপজেলা প্রকৌশলীকে নির্বাহী প্রকৌশলী ও ১০২ জন উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে সহকারী উপজেলা প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি প্রদানেও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বঞ্চনার বৃত্ত থেকে মুক্ত জ্যেষ্ঠ উপজেলা প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীরাও স্বস্তি’র শ্বাস ছেড়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশের সব গ্রামেই এক থেকে দেড় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই মিলছে পাকা সড়ক। তবে গ্রামের কাঁচা সড়ক পাকা করতে গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে নতুন কৌশল নিয়েছেন এ অভিজ্ঞ প্রকৌশলী। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্ব না থাকলেও পাকা সড়কে মানুষের হাঁটার ব্যবস্থার মাধ্যমে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করেছেন। বিটুমিন এড়িয়ে ইউনিব্লকে এখন অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পাকা করা হচ্ছে।
একই সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের টাকার ঘাটতি না থাকায় কাজ শেষ করে সময়মতো বিল তুলতে পারছেন ঠিকাদাররা। দিনের কাজ দিনে শেষ করার নিয়মে কঠোর হয়েছে হাইকমান্ড। প্রতিটি প্রকল্পকাজের অগ্রগতি প্রতি সপ্তাহে পর্যবেক্ষণ ও মাসে লিখিত আবেদনের কয়েক যুগ আগের পুরনো নিয়মেই ফিরে গেছে এলজিইডি। এসব ক্ষেত্রে অধিদফতরটির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের ভাষ্য হচ্ছে- সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলীকে নদীর নাব্যতা হ্রাসে বড় আকারের স্প্যান বিশিষ্ট সেতু নির্মাণে নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই লক্ষে প্রধান প্রকৌশলী বিদেশে কর্মরত বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
গ্রামীণ পর্যায়ে বিশেষ করে উপজেলার সড়কগুলোকে শক্তিশালী করতে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দিয়ে ‘স্ট্যান্ডার্ড রোড ডিজাইন ম্যানুয়াল’ তৈরি করে মাঠ পর্যায়ে কাজ বাস্তবায়ন শুরু করেছেন। এর ফলে অবহেলিত এ সড়কসমূহও টেকসই হবে।
সূত্র মতে, এলজিইডিতে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে শুন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করেছে প্রধান প্রকৌশলীর দফতর। সম্প্রতি একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সয়েল টেস্টে নয়ছয়ের মাধ্যমে বিল উত্তোলনের অপকৌশল গ্রহণ করেন।
তাদের রিটেস্টের মাধ্যমে স্বচ্ছতা প্রমাণ করে বিল উত্তোলনে নির্দেশ দিলে ক্ষোভে অগ্নিশর্মা প্রতিষ্ঠানটি প্রধান প্রকৌশলীর সাদা জামায় কলঙ্ক কালিমা লেপ্টে তাকে বিতর্কিত করার অপতৎপরতা শুরু করেছে বলেও অভিযোগ করেছেন এলজিইডি’র বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

তারা বলছেন, প্রধান প্রকৌশলী নিজের চাকরি জীবনে কখনই কাজের মান নিয়ে কোন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই আপস করেননি। তাঁর সুনাম, যোগ্যতা ও দক্ষতার ফলশ্রুতিতেই তাকে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে সরকার বেছে নিয়েছে। রাইট ট্র্যাকে তাঁর সঙ্গে পেরে না উঠেই পেছনের দরজা দিয়ে তাকে ঘৃণ্য কায়দায় আঘাত করার অপচেষ্টা চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র কালের আলোকে আরও জানায়, প্রধান প্রকৌশলীর সরকারি চাকরির মেয়াদের শেষভাগে এ পদে আসতে চান চারজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। কিন্তু তাদের চাকরির বয়সসীমাও মাত্র ১৩৪ দিনের ব্যবধানে শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নির্ধারিত সময়ে নিয়োগ পেলে মেয়াদ পাবেন মাত্র ১৮ দিন।
জ্যেষ্ঠতা অনুসারে পরবর্তী আরও তিন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ পদে পদোন্নতিতে গুরু দায়িত্ব পেলে থাকতে পারবেন ১ দিন, ৬০ দিন ও ৫৫ দিন। ফলে অভিজ্ঞতা ও কর্মকান্ড বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত সরকার বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীতেই আস্থা রাখলে কুটকৌশলী চক্রটির মিশন আবারও ভেস্তে যেতে পারে। এমন শঙ্কায় এলজিইডিতে অস্থিরতা সৃষ্টির টার্গেটে থাকা সুযোগ সন্ধানী মহলটির সঙ্গে কারা মিলেমিশে একাকার হয়েছেন সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে।
কালের আলো/এডিবি/এমএইচ