‘আপ্লুত’ জাতির সূর্য সন্তানরা, যেন ফিরে গেলেন দু:সাহসিক স্মৃতিঘেরা দিনগুলোতে!

প্রকাশিতঃ 10:15 pm | November 26, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, শহীদ সৈনিক মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ও শহীদ সৈনিক হামিদুর রহমান। লাল-সবুজের জমিনে চিরকালের নায়ক, একাত্তরের বীরশ্রেষ্ঠ। মহান মুক্তিযুদ্ধের রুদ্ধশ্বাস সমরে তাদের বীরোচিত আত্নত্যাগ মণিমুক্তার মতো ভাস্বর। তাদের কীর্তিতেই টানটান বাঙালির মেরুদন্ড।

আরও পড়ুন: আন্তরিক’ চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, মিয়ানমারের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নতি করতে চান সেনাপ্রধান (ভিডিও)

পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে মানবের জাগরণ ঘটা একাত্তরে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিলেন দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মোহাম্মদ শফিউল্লাহ। তিনি দেশের গৌরব; বীর উত্তম।

লে: কর্ণেল মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন আহমেদ, লে: কর্ণেল মোহাম্মদ আব্দুল গাফফার হালদার, অনারারী ক্যাপ্টেন নুরুল আমিন ও সার্জেন্ট আব্দুস সাত্তার। জীবনের মায়া ত্যাগ করে শত্রুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। মুক্তির জন্য করেছিলেন যুদ্ধ। জাতির শ্রেষ্ঠ এ সন্তানদের ভুলেনি বাংলাদেশ। তাঁরা পেয়েছিলেন বীর উত্তম খেতাব।

বাঙালির অব্যক্ত আবেগকে স্বপ্নের স্ফূর্তি দিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম। বীর বিক্রম খেতাব পেয়েছিলেন। এক আকাশ স্বপ্নের বিনিময়ে এনে দিয়েছিলেন বাঙালির চির আকাঙ্খিত স্বাধীনতা। ১৯৯৪ সালের ৩১ আগস্ট তিনি হয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান।

তাঁর মতোই মেজর জেনারেল জিএইচ মোর্শেদ খান, মেজর জেনারেল ইমাম উজ জামান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, লে: কর্ণেল জাফর ইমাম ও লে: কর্ণেল এম আব্দুল মান্নানও মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অহংকার। তাঁরা বীর বিক্রম খেতাবধারী।

একাত্তরের সুমহান চেতনায় নিজেদের বীরত্ব, ত্যাগ আর সংগ্রামের চিহ্নে মহিমান্বিত চিত্রপটে জ্বলজ্বল করে আছে তাদের নাম। সোমবার (২৫ নভেম্বর) সকালে তাদের সম্মানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য ৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে খেতাবপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর ৩ জন বীরশ্রেষ্ঠের নিকটাত্নীয়, ৫ জন বীর উত্তম, ১২ জন বীর বিক্রম ও ৩০ জন বীর প্রতীক এবং ২৫ জন অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যকে ঘটা করে এ সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

এছাড়া একই অনুষ্ঠানে ২০১৮-১৯ সালে শান্তিকালীন সময়ে বিভিন্ন প্রশংসনীয় ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ৬ জন ‘অসামান্য সেবা পদক’ এবং ১৭ জন ‘বিশিষ্ট সেবা পদক’ এ ভূষিত করেন সেনাপ্রধান।

খেতাবপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর ৩ জন বীরশ্রেষ্ঠের নিকটাত্মীয়, ৫ জন বীর উত্তম, ১২ জন বীর বিক্রম ও ৩০ জন বীর প্রতীক এবং ২৫ জন অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্য সেদিন ছুটে এসেছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিমন্ত্রণে।

প্রতি বছরই এ সম্মাননা তাদের গর্বিত করে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের দু:সাহসিক স্মৃতিঘেরা দিনগুলোতে।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে অহংকৃত বছর একাত্তর। এ বছরেই বীর বাঙালিতে পরিণত হয়েছিল তাঁরা। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাদুকরি নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল গোটা জাতি। একটি স্বাধীন ভূখন্ড ফিরে পেতে জড়িয়ে পড়েছিল সরাসরি যুদ্ধে। এসেছিল চির আরাধ্য স্বাধীনতা।

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মাঝে এসে মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনিতে প্রজ্বলিত হয়ে উঠেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহ্নিশিখায় নবজাগরণ তৈরি করা দেশপ্রেমিক এ বাহিনীর সর্বোচ্চ কর্মকর্তা শত্রু সেনাদের খতম করতে মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গণ করা জাতির সূর্য সন্তানদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাসের সার কথা তুলে ধরেন।

উপস্থাপন করেন পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসন-শোষণ আর পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসী, ঐতিহাসিক নেতৃত্ব ও দূরদর্শীতার কথা। তিনি বলেন, ‘আজকের তাৎপর্যপূর্ণ দিনে আমি স্বশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

যার নেতৃত্বে সূচিত হয়েছিল মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম। যার বলিষ্ঠ আহবানে সারা দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা পায়।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদকে গভীর শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘সকল শহীদ ও বীর মুক্তিযুদ্ধাদের সুমহান আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা। আরও স্মরণ করছি সাত বীরশ্রেষ্ঠসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক হাজার ৫’শ ৩৩ জন শহীদ বীর সেনাসদস্যদের। যারা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেদের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে।

এছাড়া পার্বত্য চট্রগ্রামে জীবন উৎসর্গ করা ১৭০ জন বীর শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আরও স্মরণ করছি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্বপালনকালে জীবন উৎসর্গকারী ১১৮ জন বীর শহীদদের।

স্মরণ করছি বিডিআর বিদ্রোহে আত্মত্যাগকারী ৫৯ জন বীর সেনানীর। আমি স্মরণ করছি দেশ মাতৃকার টানে আত্মত্যাগকারি সকল শহীদদের এবং তাদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’

দেশের যেকোন প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দেশের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করতে সেনাবাহিনী সদা প্রস্তুত জানিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, ‘অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা ও জীবনের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়।

আপনাদের পরিশ্রম, সক্রিয় সহায়তা ও অনুপ্রেরণা আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংগঠিত হয়ে কেবল জনবলে বৃদ্ধি পেয়েছে তা নয়, সাথে সাথে দেশ বিদেশে এর যোগ্যতা, কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে।

আপনাদের পথ অনুসরণ করে আমাদের সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আজ দেশ সেবায় নিয়োজিত। দেশের অখন্ডতা, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌত্ব রক্ষার আদর্শিক প্রেরণায় সেনাবাহিনীর উপর অর্পিত সকল দায়িত্ব নিরলসভাবে পালন করে চলেছে।’

তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী আজ শুধু তার নিজস্ব প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই বরং বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও জাতির গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সরকার, দেশের সাধারণ জনসাধারণকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

দেশের যেকোন প্রয়োজনে সহযোগিতা প্রদান করা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক দায়িত্ব। দেশের সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনী সবসময়ই স্বত:স্ফূর্তভাবে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। যা দেশ ও দেশের বাইরে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জল করেছে।’

সেনাপ্রধান বলেন, ‘ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে হাতিরঝিল প্রজেক্ট, মিরপুর-বিমানবন্দর ফ্লাইওভার, ঢাকা-মাওয়া চারলেন সড়ক, নির্মাণাধীন বহু স্বপ্নের পদ্মাসেতু এবং পদ্মাসেতু সংযোগ সড়ক প্রকল্পসহ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে সেনাবাহিনী ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ, পুনর্বাসন ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণসহ সকল দায়িত্ব সেনাবাহিনী নিরলসভাবে পালন করে চলেছে। এ সবকিছুই সেনাসদস্যদের অকৃত্রিম দেশপ্রেম, কর্মদক্ষতা, শৃঙ্খলাবোধ ও দায়িত্ব পালনের আন্তরিকতার বহি:প্রকাশ।

‘আমাদের প্রাণপ্রিয় সেনাবাহিনীকে সুসংহত ও জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে সেনাপ্রধান হিসেবে আমার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তথ্য প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের যুগে একটি শক্তিশালী ও আধুনিক সেনাবাহিনী গড়ে তোলা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।

পারস্পারিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও মূল্যবোধের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে আমাদের অগ্রযাত্রা। ধরে রাখতে হবে বহু যুগ ধরে তৈরি আমাদের উজ্জ্বল সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’ যোগ করেন জেনারেল আজিজ আহমেদ।

অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো: মাহফুজুর রহমান, আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের (আর্টডক) জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস.এম.শফিউদ্দিন আহমেদ, কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল শামসুল হক, চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল শফিকুর রহমানসহ সাবেক বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধানসহ বর্তমান উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কালের আলো/এডিএ/এমএএএমকে