ড্রাইভিং সিটে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতারা, শুদ্ধি অভিযানের ‘শুভ বার্তা’ আ.লীগে

প্রকাশিতঃ 11:01 am | December 01, 2019

পলিটিক্যাল এডিটর, কালের আলো :

সামান্য টং দোকানি থেকে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রেফতারকৃত কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব। তাঁর উত্থান গল্প হার মানিয়েছিল সিনেমার গল্পকে।

২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) এ ওয়ার্ডের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শেখ বজলুর রহমানকে পরাজিত করে কাউন্সিলর হয়ে রাতারাতি বদলে ফেলেন নিজের ‘লাইফ স্টাইল’।

ওই সময় নিজের একক ম্যাকানিজমে থানায় বসে সিল মেরে রাজীবকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতিয়ে নিয়ে আসেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মোহাম্মদপুর এলাকার রাজনীতির ‘নিয়ন্ত্রক’ সাবেক এক প্রতিমন্ত্রী। সবাই জানেন আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহী কমিটির প্রভাবশালী ওই নেতার ‘কূপানলে’ পড়েই জেতা নির্বাচনে হার মানতে হয়েছিল শেখ বজলুর রহমানকে। তখন তিনি ছিলেন রীতিমতো অসহায়!

৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফ্রিডম মিজান ওরফে পাগলা মিজান এবং ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর টিজেড রাজীবদের মতোন বিতর্কিতদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া বিতর্কিত এ নেতার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘কপাল পুড়ে’। নৌকা প্রতীকে সেখানে স্থলাভিষিক্ত হন নতুন মুখ। যিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তাঁর সঙ্গেও নানা সমীকরণেই শেখ বজলুর রহমানের সম্পর্ক সুখকর ছিল না মোটেও।

আবার স্থানীয় রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই দলটির প্রভাবশালী ওই নেতা এবং সংসদ সদস্যের মধ্যে কার্যকর ‘ঐক্য’ গড়ে উঠে। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কমিটি নিজেদের ‘কব্জায়’ রাখতে নানা ছক কষতে শুরু করেন তাঁরা। সংসদ সদস্য হয়েও দলীয় কমিটিতে ‘বহাল’ থাকার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। সুকৌশলে উঠিয়ে আনতে চেয়েছেন নিজেদের অনুসারীদের।

কিন্তু রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির পরিচ্ছন্ন নেতৃত্বই বেছে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে শেখ বজলুর রহমান ও এস এ মান্নান কচি ঢাকার রাজনীতির ‘হৃদপিন্ড’ হিসেবে পরিচিত ইউনিটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এসেছেন।

যদিও ওই সংসদ সদস্যকে ‘সাইজ’ করতে শেখ বজলুর রহমানকে সভাপতি করতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাবেক সেই প্রতিমন্ত্রীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে এমন গোয়েবলসীয় প্রচারণার মাধ্যমে নিজের বলয়ের নেতা-কর্মীদের কাছে বাহবা নিতে চাচ্ছেন।

স্থানীয় মোহাম্মদপুর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের একাধিক নেতা কালের আলোকে বলেন, ঢাকা-১৩ আসন থেকে নির্বাচিত বর্তমান ও সাবেক তিন সংসদ সদস্যের কেউ শেখ বজলুর রহমানের রাজনীতিতে উত্থান চাননি। তাঁরা সব সময় তাকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে চেয়েছেন। চলার পথে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন।

রাজনীতিতে চলমান শুদ্ধি অভিযান কর্মীবান্ধব, ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের জন্য ‘আশীর্বাদ’ হয়ে এসেছে। এ কারণেই শেখ বজলুর রহমান ও এস এ মান্নান কচিদের মতো নেতারা নেতৃত্বের ফ্রন্টলাইনে চলে এসেছেন।

বজলুর রহমান ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও মোহাম্মদপুর এলাকার একাধিকবার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিলেন। নতুন সাধারণ সম্পাদক কচি এক সময়ের সাহসী সাবেক ছাত্রনেতা ও বিদায়ী কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

জানা যায়, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের মতোই ‘হোয়াইট ওয়াশ’ হয়েছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগেও। এখানেও উত্তরের মতোই নেতৃত্বে এসেছে নতুন মুখ।

পুরনোরা বাদ পড়েছেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হয়েছেন আবু আহাম্মদ মান্নাফি ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন হুমায়ুন কবির।

আবু আহাম্মদ মোহাম্মদ মান্নাফি গত কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হুামায়ুন কবিরও সহ-সভাপতি ছিলেন। দলে ক্লিন ইমেজ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সংগঠনকে গতিশীল করতেই অভিজ্ঞ ও নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের হাতেই নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি চলমান শুদ্ধি অভিযানে বিতর্কিত কর্মকান্ডে জেরে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয় যুবলীগ। একে একে ধরা পড়েন দক্ষিণের বহিস্কৃত সভাপতি ‘ক্যাসিনো রাজা’ ইসমাইল হোসেন সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক ফ্রিডম খালিদ, ‘টেন্ডার মোগল’ জিকে শামীমসহ দুর্নীতিবাজ অনেক নেতা। যুবলীগ চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় ওমর ফারুক চৌধুরীকে। একইভাবে পদ হারান স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মোল্লা আবু কাওসার।

ক্যাসিনো কান্ডে গ্রেফতার হন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি লোকমান ভূঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনো হোতা সেলিম প্রধানসহ যুবলীগ, কৃষক লীগ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা।

এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর সম্মেলনে নতুন কমিটিতে পুরনো কেউই স্থান পাননি। যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগের প্রতিটি কমিটিতেই আনা হয়েছে নতুন মুখ।

এরপর অপেক্ষা ছিল ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কী ঘটে? এখন এ দুই কমিটিতেও নতুন মুখের জয়জয়াকার। পুরনো ও বিতর্কিতরা ‘কিক আউট’ হয়েছেন। শত চেষ্টা করেও পদ আঁকড়ে থাকতে পারেননি।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সম্পাদক মন্ডলীর বেশ কয়েকজন নেতা কালের আলোকে বলেন, ক্যাসিনো ঝড়ে একেবারেই লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সহযোগী সংগঠন যুবলীগ। কিন্তু সংগঠনটির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সৃষ্টিশীল সংগঠনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেননি প্রধানমন্ত্রী।

মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও যুব আন্দোলনের কিংবদন্তি শেখ ফজলুল হক মনির হাতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া সংগঠনটির কান্ডারির দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন তাঁরই জ্যেষ্ঠ সন্তান অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশের কাঁধে।

পরশের স্পর্শে নিমিষেই ইমেজ সংকটে থাকা সংগঠনটির ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তেমনি তাঁর ‘রানিংমেট’ হিসেবেও সৎ ও যোগ্য নেতাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। তৃণমূল থেকে উঠে আসা মাইনুল হাসান নিখিল যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার আগে দীর্ঘদিন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

দলটির অনেক নেতা-কর্মী বলছেন, আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনে ক্লিন ইমেজ ও সাংগঠনিক দক্ষতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে প্রতিটি সংগঠনে বাদ বাকী পদসমূহেও যদি একই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে তবে সেটি রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা আনয়ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

যদিও দলীয় একটি সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু সংগঠনের উত্তরের সাধারণ সম্পাদক ও দক্ষিণের সভাপতিকে নিয়ে রাজ্যের প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। নানা অপকর্ম ও দলকে কলঙ্কিত করা দুর্বৃত্তদের তাঁরা ঘনিষ্ঠ।

একই রকম ভুল এড়াতে যুবলীগের উত্তর দক্ষিণ এবং অন্যান্য সংগঠনগুলোর বাদ বাকী পদে পদায়নের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক ও মনোযোগী হতে হবে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয়তা, সততা ও সাংগঠনিক দক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়ে পুরনো ও নতুনদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে শুরুতেই নিজের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

সরকারের সফলতা ও অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার উন্নয়ন গতি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের গুটিকয়েক নেতার রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় এরা ‘উন্নয়নের উইপোকা’।

ফলে এদের দমনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘শুন্য সহিষ্ণুতা’ নীতি ও কঠোর মনোভাব দেশের সাধারণ মানুষের মনে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নতুন আশা ও উদ্দীপনা তৈরি করে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন সাহসী অভিযান ছিল সময়ের দাবি এবং জনগণের কাঙ্খিত স্বপ্ন।

উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার প্রধানের এমন দূরদর্শী, দক্ষ নেতৃত্বগুণ ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত দেশের সাধারণ মানুষের মনে নতুন স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করে। প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয় দেশ-বিদেশে।

জনমানসে শক্তিশালী করে সরকারের অবস্থান। দেশের মানুষের ভরসা ও বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও এ অভিযানের শুরুতেই স্বাগত জানায়।

পেশাদারিত্ব, দক্ষতা, সততা, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার নজির স্থাপন করা এ বাহিনীটিকে নেতৃত্ব দেওয়া সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এ সাহসী সিদ্ধান্তকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর অবস্থানের বহি:প্রকাশ বলেও মন্তব্য করেছিলেন। সরকারের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দুর্নীতি বিরোধী এ অভিযানকে ‘শুদ্ধি অভিযান’ হিসেবে অভিহিত করেন।

সেই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘এ অভিযানকে সেনাপ্রধান স্বাগত ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। কাজেই এখানে চুনোপুঁটি আর রাঘব বোয়াল বলে কথা নয়। আপনি হয়তো দেখতে চুনোপুঁটি কিন্তু কাজটা করেছেন রাঘব বোয়ালের মতো।’

আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর প্রতিটি সম্মেলনে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রীর ‘শুদ্ধি অভিযান’ সফল করার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন দলে নাম লিখিয়ে বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর উৎকট প্রতিযোগিতা বন্ধে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনীতিতে শুদ্ধি অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কারণ নিজ দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে এমন দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনার নজির ইতোপূর্বে বাংলাদেশে ছিল না।

প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন না এবং সততার সঙ্গে রাজনীতি করেন বলেই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থান নেয়ার সাহস দেখাতে পেরেছেন। দেশের রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আনয়নে ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় এটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। শুদ্ধি অভিযান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বয়ে আনবে ‘শুভ বার্তা’।

কালের আলো/আরআইএ/এমএএএমকে