এক ছাদের নিচে ২৪ ঘন্টাই মিলছে চিকিৎসা সেবা

প্রকাশিতঃ 4:34 pm | April 22, 2018

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো :

বাইসাইকেলের প্যাডেল পায়ে ঢুকে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছেন সিফাত (১৩) নামের এক কিশোর। তাঁর বাড়ি গাজীপুর জেলায়। মাত্র ২২০ টাকায় ১৫ মিনিটেই এক্সরে করানোর পর তাৎক্ষণিক অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসক।

পরে তাকে ১৬ শয্যার পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানে ওষুধসহ সব ধরণের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। ২৪ ঘন্টা পর্যবেক্ষণের পর অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাকে ভর্তি না করে বাড়িতেই ফেরত পাঠালেন দায়িত্বরত চিকিৎসক।

পেটের পীড়া নিয়ে গৌরীপুরের ডৌহাখলা ইউনিয়নের একটি গ্রাম থেকে এসেছেন রফিকুল ইসলাম (৩৫)। ডে-কেয়ার হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রেখে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হওয়ায় মাত্র ৬ থেকে ৭ ঘন্টাতেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন দরিদ্র এ রোগী। এসব ঘটনা প্রবাহ মঙ্গলবার (১৭ এপ্রিল) ও বুধবারের (১৮ এপ্রিল)।

শুধু সিফাত কিংবা রফিকুলই নন এ হাসপাতালে দু’পক্ষের সংঘর্ষে বা দুর্ঘটনায় আহত, প্রসূতিসহ প্রায় সব ধরণের রোগীদের অবস্থা বুঝে এভাবেই তড়িৎ ব্যবস্থা নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। আর এমনটি সম্ভব হয়েছে মূলত এ হাসপাতালটিতে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ সুবিধা চালু হওয়ার কারণেই। এখানে এক ছাদের নিচেই দিন-রাত ২৪ ঘন্টাই মিলছে চিকিৎসা সেবা।

এ সুবিধার আওতায় তাৎক্ষণিক সব ধরণের জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ৬ শয্যার ডে কেয়ার ও ১৬ শয্যার পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ডের সুবিধা চালু হওয়ার পর হাসপাতালের ভেতরের ওয়ার্ডে রোগী ভর্তির চাপ কমতে শুরু করেছে।

এমনকি ওয়ান স্টপ সার্ভিসের দৌলতেই গত ৬ মাসে গড়ে ৬৩ শতাংশ রোগী দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। এ সময়টাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মাত্র ৩৭ শতাংশ রোগী, এমন তথ্যই নিশ্চিত করেছে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন আহমেদ।

দ্রুত চিকিৎসা সেবা পেয়ে খুশি সিফাতের স্বজনেরাও। অবশ্য তাদের একজনের এ হাসপাতালটিতেই সেবা গ্রহণকারী হিসেবে অতীত অভিজ্ঞতা তিক্ত। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের এ চাকুরে কালের আলোকে বলছিলেন, ৮ থেকে ৯ মাস আগেও এ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে এসে দেখেছি জরুরি বিভাগে কোন রোগী দেখেই দায়িত্বরত চিকিৎসক স্লিপ লিখতেন।

ভর্তি দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন হাসপাতালের ভেতরের ওয়ার্ডে। চিকিৎসক-সেবিকাদের দেখা পাওয়া তখন ছিল কঠিন। মিলতো না কাঙ্খিত সেবাও। ফলে এক ধরণের হাসফাঁস অবস্থা ছিল রোগী ও তাদের স্বজনদের।

অথচ এখন শতভাগ ওষুধ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশও পাল্টে গেছে। নিশ্চিত হয়েছে আধুনিক সেবা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ।’

 

একই রকম কথা জানালেন পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সদর উপজেলার দাপুনিয়ার উজান ঘাগড়া এলাকার শাহিদা বেগমের (৪০) স্বজন মিনারা করিম। তিনি বলেন, দেশের যে কোন হাসপাতালের চেয়ে এ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান ভালো। তবে এখনো শয্যা না পেয়ে অনেক রোগীকে হাসপাতালের মেঝেতে বা বারান্দায় থাকতে হয়।’

এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, সেবার ভালো মানের কারণেই অন্ত:বিভাগে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে প্রত্যেকের জন্য বিছানা দেয়াটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালের চারটি ভবন অঁেকাজো থাকায় এমনটি হচ্ছে। নতুন কিছু ভবনের কাজ সম্পন্ন হলেও শয্যা সঙ্কটও কেটে যাবে।

দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আগে এখানে চালু হওয়া জরুরি ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গত দু’দিন বিভিন্ন সময়ে অবস্থান করে দেখা গেছে, হাসপাতালের ভেতরের ওয়ার্ডে ভর্তি করানোর মতো প্রয়োজন নেই এমন রোগীদের চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে ডে কেয়ারে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে।

সার্বক্ষণিক তিন শিফটে সার্জারী, মেডিসিন, গাইনী বিভাগের দু’জন করে মোট ১৮ জন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন। এসব চিকিৎসকরা কেবলমাত্র যেসব রোগীদের ধারাবাহিক চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন রয়েছে তাদেরকেই ভেতরের ওয়ার্ডে পাঠাচ্ছেন। চিকিৎসক, ওয়ার্ড বয়, টেকনেশিয়ানসহ ৫৩ জনের একটি টিম নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে।

হাসপাতালের ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ প্রক্রিয়ার সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক তারিকুল ইসলাম খান ওয়াসিম বলেন, বুকে ব্যাথা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত রোগীরা বাইরের ক্লিনিক বা হাসপাতালগুলোর চেয়ে নামমাত্র মূল্যে এখানে জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পারছেন।

তাদের বিনামূল্যে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ দেয়া হচ্ছে। ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রে পানি জমার মতো জটিল সমস্যার দ্রুত সমাধান মিলছে। এ সার্ভিসে আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন, ইসিজি, প্যাথলজি ল্যাব, অপারেশন থিয়েটার ও অত্যাধুনিক ডিজিটাল এক্সরে মেশিন সন্নিবেশিত করা হয়েছে।’

হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানায়, ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এক হাজার শয্যার এ হাসপাতালটিতে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ৬ জেলার বাসিন্দারা ছাড়াও গাজীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষজন চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। প্রতিদিন গড়ে এখানে রোগী ভর্তি হন ৩ হাজার। জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগ মিলিয়ে রোগীর সংখ্যা ৬ হাজারের কম নয়।

বিশাল অঙ্কের এসব রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিতের পাশাপাশি দিন-রাত ২৪ ঘন্টা তাদের সেবা দিতে এবং অনাবশ্যক রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ দ্রুত বাড়ি ফেরত পাঠিয়ে রোগীর চাপ কমাতে ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ সুবিধা চালু করেন হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন আহমেদ।

নিজে এ পদে দায়িত্বের প্রায় আড়াই বছরে সরকারি শতভাগ ওষুধ রোগীদের সরবরাহের পাশাপাশি সেবার মানোন্নয়ন ঘটিয়েছেন এ পরিচালক। দালাল মুক্ত করে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত নানা সমস্যা ও অনিয়মের বৃত্ত থেকে ক্রমশ বের করে আনছেন প্রায় চার কোটি মানুষের চিকিৎসা সেবার প্রধান এ ভরসাস্থলকে, এমনটি জানান নগরীর বিশিষ্টজনেরা।

এসব বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, সুচিকিৎসা নিশ্চিতের মাধ্যমে সরকারি এ হাসপাতালটির ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি। উন্নত ও সহজ সেবা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে স্বল্প সময়ের মধ্যে তড়িৎ চিকিৎসা দিতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছি। এর ফলে একদিকে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় ও ভোগান্তি কমছে। আবার হাসপাতালের ভেতরের ওয়ার্ডেও রোগীর চাপ কমেছে।’