মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে অগ্রগতি : সার্বিক আলোচনা তুলে ধরলেন সেনাপ্রধান

প্রকাশিতঃ 7:15 pm | December 12, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

তখন মাত্র ৯ ঘন্টা আগে মিয়ানমার থেকে ফিরেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। চারদিনের ব্যস্ত সফর শেষে বৃহস্পতিবার (১২ডিসেম্বর) সকালে দেশে ফিরেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিমান বহরে নতুনভাবে ৪ টি ডায়মন্ড ডিএ৪০এনজি প্রশিক্ষণ বিমান সংযোজিত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছেন।

আরও পড়ুন: আরও ৬ টি হেলিকপ্টার কিনছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ট্রেনিং স্কুল লালমনিরহাটে

দিনবদলের পালায় আর্মি এভিয়েশন গ্রুপের ক্রমশ সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার বিষয়টি উপস্থাপন করে নিজে থেকেই খোলাসা করলেন নিজের মিয়ানমার সফরের বিষয়টিও। বাংলাদেশের কাঁধে যখন মিয়ানমারের ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বোঝা তখন দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনার মাধ্যমে চলমান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সরকার নির্দেশিত সামরিক কূটনীতিতেই হাঁটছে বাংলাদেশ।

সেনাপ্রধানের মিয়ানমার সফরের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বেশ অগ্রগতি হলেও একশ্রেণি হঠাৎ করেই এ সফর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর উপপ্রধান ও সেনাবাহিনী প্রধান ভাইস সিনিয়র জেনারেল সো উইন এর সাথে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের দৃঢ় অনড় অবস্থান এবং নিজেদের ভূমিতে তাদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও আবাসন নিশ্চিত করারও আহ্বান জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

তিনি স্পষ্ট ভাষায় মিয়ানমার সেনাপ্রধানকে জানিয়েছেন, সমস্যা যেহেতু মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে তাই সমাধানও তাদেরই করতে হবে। মিয়ানমারের সেনাপ্রধান রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার জোর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাংলাদেশেরও আন্তরিক সহযোগিতা চেয়েছেন, নিজের বক্তব্যে এমনটিই বলছিলেন সেনাপ্রধান।

আরও পড়ুন: আইসিজে’র সঙ্গে সেনাপ্রধানের মিয়ানমার সফরের কোন সম্পর্ক নেই কেন?

আইসিজে’র মামলার সঙ্গে মিয়ানমার সফরের সম্পর্ক নেই
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমার মিয়ানমার সফর পূর্ব নির্ধারিত ছিল। সাধারণত আপনারা সবাই জানেন, কোন বাহিনীর প্রধানরা যখন অন্য দেশে যায়, ৭ থেকে ৮ মাস আগে থেকে এটার প্রস্তুতি চলে। এবং এটার সব ধরণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আসলে ‘ইন্টারন্যাশন্যাল কোর্ট অব জাস্টিস’ (আইসিজে) এর মামলা ও শুনানির সঙ্গে এ সফরের কোন সম্পর্ক নেই।’

বিষয়টি স্পষ্ট করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেকটা দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র লেফটেন্যান্ট থেকে শুরু করে এবং অন্যান্য পদবির যারা আছেন তারা গুডউইল ভিজিটে যান এবং সেটা নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার লক্ষে। নিজেদের মধ্যে ট্রাস্ট, কনফিডেন্স এবং একচুয়ালি ট্রেনিংয়ের অংশ হিসেবে এর ক্ষেত্র তৈরির জন্য ভিজিট করে থাকে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এরকম ভিজিট গুরুত্বপূর্ণ।’

সীমান্ত, আকাশসীমা লঙ্ঘনসহ যেসব বিষয়ে আলোচনা
মিয়ানমার সফরে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অন্যান্য কোন কোন ক্ষেত্রে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারি এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, জানান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান।

জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মাঝে মাঝে কিছু কিছু ইনসিড্যান্ট হয়েছে। যেমন : সেখানে আমরা কিছু কিছু স্থল মাইনের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি এবং আমরা আইইডির (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইজ) উপস্থিতি পেয়েছি।

এসব বিষয়ে আমাদের কনসার্ন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধানকে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে যাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এবং এ ধরণের স্থলমাইন সীমান্ত এলাকাতে স্থাপন করা কোনভাবেই কাম্য নয় এ বিষয়টিও তাদের বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় তাদের হেলিকপ্টার এবং কখনও কখনও তাদের ড্রোন আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে দিনক্ষণ দিয়ে আমরা তাদের জানিয়েছি। এবং এ বিষয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা তাদের বলেছি এবং এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এ বিষয়টিও বলা হয়েছে।

তারা আশ্বস্ত করেছে এধরনের কিছু হয়ে থাকলে সেসব আন ইনটনশনালি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যেন হয় সে ব্যপারে তারা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিবে এবং ড্রোনের বিষয় তারা খতিয়ে দেখবে বলে জানিয়েছে।’

কাউন্টার ইনসার্জেন্সি অপারেশন
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘মাঝে মাঝে বিভিন্ন মিডিয়াতে আসে সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি করা হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহীনি প্রধান আমাকে নিশ্চিত করে বলেছেন যে, তারা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় আরাকান আর্মির সাথে তাদের কিছু কাউন্টার ইনসার্জেন্সি অপারেশন হচ্ছে, সেটা প্রতিনিয়তই চলছে। সেই অপারেশনের প্রয়োজনেই তারা বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনী নিয়ে আসে এবং সেনাবাহিনী পরিবর্তন করে থাকে।

এর সাথে দুই দেশের সম্পর্কের কোন ধরণের ভুল বুঝাবুঝি হওয়ার কোন সুযোগ নেই এবং যেন না হয় সেজন্য তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছে।’

তিনি বলেন, ‘তারা এটাও বলেছে এ ধরণের কার্যক্রমে যদি আমাদের কোন সন্দেহের অবকাশ হয় তাহলে তাদের সেটি জিজ্ঞেস করলে তারা সেটার এক্সপ্রেশন দিবে। আমরা তাদের বলেছি, তারা যদি আগে থেকে আমাদের আগে থেকে কাউন্টার ইনসার্জেন্সি অপারেশনের কথা জানিয়ে রাখে তাহলে সমস্যাগুলো হবে না।’

প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি
সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী আমাদের জানিয়েছে, তারা যেহেতু সীমান্ত এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করছে। অপারেশনের সময় যেন আমরা তাদের সহায়তা করি যাতে কোন দুষ্কৃতিকারী তাদের তাড়া খেয়ে বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে না আসতে পারে।

আমরা তাদের বলেছি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা আমাদের ভূমি প্রতিবেশী কোন রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী গ্রুপকে ব্যবহার করতে দেবো না। আমি তাদের সেটা আশ্বস্ত করেছি আমাদের জাতীয় যে পলিসি আছে, সরকারের যে নির্দেশনা আছে সে অনুযায়ী কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘তাদের সৈনিকরা মাঝে মাঝে বর্ডার ক্রস করে চলে এসেছে আমরা তাদের ফেরত দিয়েছি সে ব্যপারেও তাদের আমরা জানিয়েছি।’

রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি এখানে আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি করছে এবং পাশাপাশি এখানে যে সিকিউরিটি কনসার্ন। তারা ড্রাগ স্মাগলিংয়ে জড়িয়ে পড়ছে। আর যেখানে ড্রাগ স্মাগলিং হবে সেখানে অবৈধ অস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাবে।

ক্রমশ এ ব্যাপারগুলো কোথায় যেতে পারে, এই সিকিউরিটি কনসার্নগুলো তাদের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। এবং তাদের বলা হয়েছে এই সমস্যাটি মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে সুতরাং তাদেরকেই এটার সমাধান করতে হবে। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার সব ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।’

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জোর আশ্বাস
সেনাপ্রধান বলেন, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রধান বলেছেন তারা যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চান এবং সেই জন্য তারা আমাদের আন্তরিক সহযেগিতা চেয়েছে। কী কারণে অতীতে যে বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছিলো রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য সেগুলো কেন ব্যর্থ হয়েছে সেই কারণগুলোও আমি তুলে ধরেছি।

তাদের বলেছি এই কারণগুলো যদি সনাক্ত করা না হয়, যতই চেষ্টা করা হোক এটা হয়তো আলোচনার মধ্যেই থাকবে বাস্তবে রূপ নিবেনা। খুব শিগরিই তারা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এশিয়ান হিউম্যানিটারিয়ান ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিমের প্রতিনিধিদের দ্রুত আহবান জানাবে।

আমি তাদের বলেছি রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদেরকেও নিয়ে যেতে, যাতে তোমরা কি ব্যবস্থা নিয়েছে তারা যেন তা স্বচক্ষে দেখে আসতে পারে এবং তারা ফিরে এসে যেন অন্যদের বলতে পারে যে এই আয়োজন করা হয়েছে।’

সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমরা বলেছি, তোমাদের যারা নাগরিক (রোহিঙ্গা) তাদের সেটিসফাই করতে হবে। যাতে করে তোমরা যদি ফেরত আসো, এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এই আবাসন, এই সুযোগ সুবিধা আমরা করেছি এসব দেখাতে হবে। কারণ তারা সেটিসফাই হলেই কেবল মাত্র তারা যাবে। অন্যথায়, এনজিও বা বিভিন্ন সংস্থা যারা কাজ করছে তাদের কনভিন্স করে এদের নিয়ে আসাটা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার।’

তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে খুব শিগরিই কিছু রোহিঙ্গাদের, তারপরে আশিয়ান হিউমিনিটি এন্ড ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম এবং আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয় যাবেন।’

আমরা দেশের নিরাপত্তা সম্পর্কে সব সময় সচেতন
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘মিয়ানমার সফর সম্পূর্ণভাবে একটি দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তার সাথে সাথেই অবশ্যই যখন এ ধরনের সুযোগ আসে আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় যেসব বিষয়গুলো আছে সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি।

কারণ এই সেনাবাহিনী যেমন দেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাজনিত কর্মকান্ড ও বিষয়গুলো দেখে থাকে সেটা তাদের দায়িত্ব এবং যুদ্ধকালীন সময় দেশকে শত্রুমুক্ত বা যে কোন বহি:আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা সর্বদা প্রস্তুত থাকি। আমরা দেশের নিরাপত্তা সম্পর্কে সবসময় সচেতন ছিলাম আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকবো।’

অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল শামসুল হক, চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল শফিকুর রহমানসহ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীসহ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য বিভিন্ন বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে