রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্যারিশম্যাটিক কূটনৈতিক তৎপরতায় আশার আলো
প্রকাশিতঃ 4:00 pm | December 16, 2019
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো :
চুক্তির পরেও মিয়ানমারের অনাগ্রহে দুই দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভেস্তে গেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই বলছেন, শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন: আইসিজে’র সঙ্গে সেনাপ্রধানের মিয়ানমার সফরের কোন সম্পর্ক নেই কেন?
নিকটতম প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে নিজেদের লড়াইয়ে না জড়িয়ে আলোচনার ভিত্তিতেই দীর্ঘায়িত এ সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের প্রত্যাশার কথাও জানিয়েছেন। প্রায় ৫ মাস আগে বিশ্বের তৃতীয় পরাশক্তি চীন সফরে ‘দ্বিপক্ষীয় সমাধানে’ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস নিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেই বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘এই সঙ্কট (রোহিঙ্গা) আর ফেলে রাখা যায় না। রোহিঙ্গারা অবশ্যই তাদের নিজ দেশে (মিয়ানমার) ফিরে যাবে।’
প্রত্যাশার চেয়ে অর্জনের পাল্লা ভারী হওয়ার সফরের মাত্র চার মাসের মাথায় চীন সফর করে দেশটির সামরিক নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।
আরও পড়ুন: আন্তরিক’ চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, মিয়ানমারের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নতি করতে চান সেনাপ্রধান (ভিডিও)
সামরিক কূটনীতির বিশেষ কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে সেনাপ্রধানের এ সফরে মিয়ানমারের ‘মোড়ল’ এ বন্ধু দেশটির বলিষ্ঠ ভূমিকা নিশ্চিতের পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছার ইঙ্গিতও দেয়া হয়।
শক্তিধর মিত্র দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া এমন ইতিবাচক সাড়া শেখ হাসিনা সরকারের সফল কূটনৈতিক তৎপরতা বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এরপর নিজেদের অন্যতম প্রতিবেশী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরও সম্পর্ক উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বাড়ানোসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যুতে সেই দেশটি সফরের কথা জানান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। এ সফরের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন হতে সময় লেগেছে ৭ থেকে ৮ মাস।
মিয়ানমার সফরে যাওয়ার বেশ আগে থেকেই সফরকে ঘিরে কয়েক দফা কৌতূহলী সংবাদকর্মীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন সেনাবাহিনী প্রধান। সেই সফরের ১০ দিন আগেই সফরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে গণমাধ্যমকর্মীদের মুখোমুখি হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
আরও পড়ুন: চার দিনের সরকারি সফরে মিয়ানমার যাচ্ছেন সেনাপ্রধান, আলোচনা হবে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়েও
বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি সফরটি আমাদের পক্ষে যাবে। এটি আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। এর ফলে আরেকটি লাইন অব নেগোসিয়েশন তৈরি হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আলোচনার অরেকটি পথ খুলে দেবে।’
এর ঠিক সপ্তাহখানেক পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সেনাপ্রধান বলেন, ‘এটি একটি রুটিন সফর। প্রশিক্ষণ ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করার জন্যই এই সফর। সফরকালে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়েও আলোচনা হবে।’
তিনি আরও বলেন, দ্বিপক্ষীয় সফরগুলো করা হয় সম্পর্কন্নোয়নের জন্য। মিয়ানমার সফরও সে ধরনেরই একটা সফর। এর মধ্য দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও ভালো করা, দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও যোগাযোগ আরও বাড়ানোর বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।’
সেনাপ্রধানের চারদিনের মিয়ানমার সফরে প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক’ স্থাপন গোটা দুনিয়ায় দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ সফরকে ইতিবাচক হিসেবেই অভিহিত করে বিশ্বের নামি অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
সফরে সেনাপ্রধানসহ ৭ সামরিক কর্মকর্তাকে মিয়ানমার বিশেষ কূটনৈতিক মর্যাদা দেওয়ায় পাশাপাশি রোহিঙ্গাদেরও তাদের দেশে ফেরত নেওয়ায় সম্মত হওয়ার বিষয়টিকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বড় কূটনৈতিক অর্জন হিসেবেই দেখছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, মিয়ানমারের অং সান সু চির সরকারে দেশটির সেনাবাহিনীর কঠিন প্রভাব রয়েছে। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া দু’বারই ব্যর্থ হয়েছে।
আবার জ্বলন্ত রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যকার মানসিক দূরত্ব কমানোর পাশাপাশি মান-অভিমানের বিশাল প্রাচীর ভাঙতে দুই দেশের ‘মিলিটারি কথোপকথন’ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সেখানেই ‘মাস্টার স্ট্রোক’ খেলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কূটনৈতিক অভিজ্ঞ মহলটি মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর ‘গাইড লাইনে’ দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যকার শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে সফল সামরিক কূটনৈতিক তৎপরতায় সাহসী ও অভিজ্ঞ উপস্থাপনার মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ যুক্তি-তথ্যের সমন্বয়ে রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরেছেন।
আবার রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার মধ্যেই সংকটের সমাধান রয়েছে এই বিষয়টিও তিনি স্পষ্ট করেছেন।
সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সঙ্গে একমত পোষণ করেই আন্তরিক সহযোগিতা চেয়েছেন মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর উপপ্রধান ও সেনাবাহিনী প্রধান ভাইস সিনিয়র জেনারেল সো উইন। দুই দেশের দুই শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার এমন মতৈক্য সমঝোতার বাস্তবিক প্রয়োগ ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে বলেও মত বিশেষজ্ঞদের।
মিয়ানমার থেকে চারদিনের সফর শেষে দেশে ফেরার ৯ ঘন্টার মাথায় বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) সকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ মিয়ানমার সফরের আদ্যোপান্ত গণমাধ্যমের সামনে সুনিপুণভাবে তুলে ধরেন।
রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনায় ইন্টারন্যাশন্যাল কোর্ট অব জাস্টিস’ (আইসিজে) এর মামলা ও শুনানির সময়ে তার এ সফরকে ঘিরে অতি উৎসাহী এক শ্রেণির লম্ফঝম্ফ করলেও মিয়ানমার সেনাপ্রধানের সঙ্গে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে সেই সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেন জেনারেল আজিজ আহমেদ।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটলেই কেবলমাত্র রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে- দেশটির সেনাপ্রধানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাতে এ বার্তাই দিতে চেয়েছেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান।
দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ভাইস সিনিয়র জেনারেল সো উইনকে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন রোহিঙ্গাদের দেশটিতে ফিরিয়ে নিতে সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলতে মিয়ানমারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের নির্ভয়, নিরাপদ ও টেকসই জীবন নিশ্চিত করতে হবে।
সেদিন সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি এখানে আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি করছে এবং পাশাপাশি এখানে যে সিকিউরিটি কনসার্ন, তারা ড্রাগ স্মাগলিংয়ে জড়িয়ে পড়ছে। আর যেখানে ড্রাগ স্মাগলিং হবে সেখানে অবৈধ অস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাবে।
ক্রমশ এ ব্যাপারগুলো কোথায় যেতে পারে, এই সিকিউরিটি কনসার্নগুলো মিয়ানমার সেনাপ্রধানের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এবং তাদের বলা হয়েছে এই সমস্যাটি মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে সুতরাং তাদেরকেই এটার সমাধান করতে হবে। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার সব ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।’
‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রধান বলেছেন তারা যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চান এবং সেই জন্য তারা আমাদের আন্তরিক সহযেগিতা চেয়েছে’ যোগ করেন তিনি। দুই দফা প্রত্যাবাসন চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য অতীতে নেওয়া পদক্ষেপগুলো কেন ব্যর্থ হয়েছে সেই কারণগুলোও আমি তুলে ধরেছি।
তাদের বলেছি এই কারণগুলো যদি সনাক্ত করা না হয়, যতই চেষ্টা করা হোক এটা হয়তো আলোচনার মধ্যেই থাকবে বাস্তবে রূপ নিবেনা। খুব শিগরিই তারা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এশিয়ান হিউম্যানিটারিয়ান ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিমের প্রতিনিধিদের দ্রুত আহবান জানাবে।’
রোহিঙ্গাদের নিরাপদে তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার কার্যকর চেষ্টার প্রয়াসে এ সফরে আশার আলো জ্বললেও কায়েমি স্বার্থান্বেষীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অসাধারণ এ কূটনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভারসাম্য ও শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে সেনাপ্রধানের মিয়ানমার সফর গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকা নেবে বলেও মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
একই রকম যেন বলছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। রোববার (১৫ ডিসেম্বর) সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘মিয়ানমার আমাদের কোনো শত্রু দেশ নয়, বন্ধুপ্রতীম দেশ। তাছাড়া সেনাপ্রধানের মিয়ানমার সফর অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের যোগাযোগের নতুন চ্যানেল খুলবে।’
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এ সফর ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে দেশটির সেনাবাহিনীর বিশেষ প্রভাব রয়েছে। সে কারণে আমাদের সেনাপ্রধানের সফরের মধ্য দিয়ে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে। আবার নেদারল্যান্ডসের আদালতে বিচারের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপও বাড়বে।’
২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের গণবাস্তুচ্যুতি ও মানবতার চরম বিপর্যয়ের পর প্রথমবারের মতো সেনাপ্রধানের মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানে কার্যকর ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্যারিশম্যাটিক কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।
সামরিক কূটনৈতিক থিউরি এ সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে সম্মত করেছে। একই সঙ্গে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে আস্থা ও যোগাযোগের সম্পর্কও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাবে। তাদের মধ্যকার ভুল বুঝাবুঝির অবসান বাংলাদেশের একশ্রেণির স্বার্থান্বেষীদের ‘ভ্রুকুঞ্চিত’ করলেও প্রকারান্তরে এটিই এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিকে টেকসই রূপ দেবে বলেই মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা
.
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান
অ্যাকটিং এডিটর
কালের আলো.কম
.
কালের আলো/আরআইএ/এমএএএমকে