‘রাজধানীতে কোনো বাস বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া মেনে চলে না’
প্রকাশিতঃ 9:24 pm | April 30, 2018
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
বিআরটিএতে অনিয়ম নিয়ে দুদকের উদ্যোগে আয়োজিত গণশুনানিতে হাজির হয়ে রাজধানীতে চলাচল করা তাদের নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী চলে এমন একটি পরিবহনের নাম বলতে বলেন এক অভিযেগাকারী। এ প্রশ্নের জবাবে মুখ খোলেননি বিআরটিএ’র কোনো কর্মকর্তা।
এ সময় সঞ্চালক নাসিম আনোয়ার বলেন, “তারা যেহেতু এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিচ্ছেন না, তাহলে ধরেই নিলাম রাজধানীতে কোনো বাস বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া মেনে চলে না।”
সোমবার ঢাকার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিআরটিএ সংক্রান্ত দুর্নীতি প্রতিরোধ ‘ফলোআপ গণশুনানি’তে এমন চিত্র দেখা যায়।
দুদক কমিশনার নাসিরউদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন, দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মাহমুদ হাসান। গণশুনানি সঞ্চালনা করেন দুদকের ঢাকা বিভাগের পরিচালক নাসিম আনোয়ার।
বিআরটিএ’র ভেতরে-বাইরে দালালের দৌরাত্ম্য, অর্থের বিনিময়ে অযোগ্যদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া, বাসগুলো নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নেয়ার অভিযোগও জানান শুনানিতে উপস্থিতরা।
গণশুনানির শুরুতে ধানমণ্ডির বাসিন্দা রেহানা সালাম বলেন, “গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গত দুই বছর আগে এমনই একটি শুনানিতে এসেছিলাম। তখন বিআরটিএ’র কর্মকর্তা বলেছিলেন, দ্রুত মালিকানা পরিবর্তন করে আমার নামে নিবন্ধন দেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই কাজটি হয়নি।”
অভিযোগ শুনে বিআরটিএর উপপরিচালক মাসুদ আলম বলেন, “যার কাছ থেকে তিনি গাড়ি কিনেছেন, তাকে তিনি চেনেন না, প্রয়োজনীয় নথিপত্রও তিনি উপস্থাপন করতে পারেননি তখন, যে কারণে এত সময় লেগেছে, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে উনার কাজটি হবে।”
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এফ আর খান অভিযোগ করেন, বিআরটিএ আগের চেয়ে ‘ভালো হয়নি’। এই প্রতিষ্ঠানের বাইরে ও ভেতরে দালালে ভরা, এই দালালদের দূর করা হয়নি। বিআরটিএ’র আশ্রয়-প্রশ্রয় না থাকলে দালালদের দৌরাত্ম্য থাকত না।”
গাড়ি নিবন্ধনে গিয়ে বিআরটিএতে বছরের পর বছর হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ তোলেন এই আইনজীবী।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বিআরটিএ কর্মকর্তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
অনুষ্ঠানে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। বিআরটিএকে যদি শক্তিশালী করা হত, তাহলে দুর্ঘটনা কমে যেত।
পরিবহন সংক্রান্ত আইনগুলো আরও কঠোর করার মত দেন তিনি।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “সারাদেশে ৩৪ লাখ গাড়ি চলছে। কিন্তু এসব গাড়ি চালানোর জন্য ১১ লাখের মতো গাড়ির চালকদের নিবন্ধন নেই। কিন্তু নিবন্ধন না থাকা সত্বেও এসব গাড়ি তারা চালাচ্ছন। এসব চালকদের কাছে আমরা কেউ নিরাপদ নই। তাহলে কীভাবে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব?” প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চালক তৈরি এবং প্রতিটি জেলা শহরে বিআরটিএ’র থেকে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউশন খোলার দাবি জানান তিনি।
দালাল থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেন, “গত দুই বছরে ৫০০ জন দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, অনেককে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। আগামীতেও অভিযান পরিচালনা করা হবে।”
এ বিষয়ে দুদক কমিশনার নাসিরউদ্দীন বলেন, “দালালদের সঙ্গে বিআরটিএ’র কিছু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে বলেই দালালরা সেখানে ভিড়তে পারে।”
বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন তিনি। নইলে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন দুদক কমিশনার।
এসময় গাড়ির ফিটনেস ও নিবন্ধনের জন্য বিআরটিএতে গিয়ে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন উত্তরার বাসিন্দা আসলাম সেরনিয়াবাত। তিনি বলেন, “আমি ১০ বছর আগের একটি বিষয়ের কথা বলছি। নতুন তিনটি গাড়ির নিবন্ধনের জন্য বিআরটিএতে আবেদন করেছিলাম, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। দুদকের গত গণশুনানিতে দ্রুত করে দিবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু দুদকের ফলোআপ গণশুনানির কথা শুনে একটি গাড়ির নিবন্ধন হলেও বাকি দুটি গাড়ির নিবন্ধন হয়নি।”
জবাবে বিআরটিএ কর্মকর্তা মাসুদ বলেন, “নিবন্ধনের জন্য যে ফি তা পোস্ট অফিসের মাধ্যমে দিতে হয়, তিনি যে টাকা দিয়েছেন তা আমাদের কাছে কোনো নথি আসেনি, এছাড়া গাড়ির পর্যাপ্ত নথিপত্র তিনি দেখাতে পারেননি, বিক্রেতাও হাজির করাতে পারেননি।”
দোহারের বাসিন্দা প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম অভিযোগ করেন, রাজধানীর কোনো বাসই বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া মানছে না, বিআরটিএ এটা দেখছে না।”
মাসুদ আলম অভিযোগকারীর উদ্দেশে বলেন, “আপনি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করুন, আমাদের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসলে সেই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। সব ধরনের বাসকে ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর বিআরটিএ থেকে নির্ধারিত ভাড়া আদায় করতে বলা হয়েছে।”
এ সময় বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী বিআরটিএ কর্মকর্তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন।
দুদক কমিশনার নাসিরউদ্দীন তখন বিআরটিএ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, “সুপ্রভাত পরিবহনসহ কয়েকটি বাসের নাম এসেছে, যারা নিজেদের মতো করে ভাড়া নিয়ে থাকে, সেইসব বাসের বিরুদ্ধে বিআরটিএ থেকে কি ব্যবস্থা নিল, তা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে দুদককে অবহিত করতে হবে।”
সড়কের বহু দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চালক-হেলপার পালিয়ে যায়, তাদের বিরুদ্ধে বিআরটিএ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা বেদৌরা আলী। তিনি বলেন, “টাকার বিনিময়ে বিআরটিএ থেকে অযোগ্য ও কম বয়সীরাও ড্রাইভিং নিবন্ধন পেয়ে যাচ্ছে।”
এ বিষয়ে বিআরটিএ’র উপ-পরিচালক মাসুদ আলম বলেন, “বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে একটি দলের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয়। টাকার বিনিময়ে কোনো কর্মকর্তা লাইসেন্স দিয়ে থাকলে, তা প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
যেসব বাসে রাজীব ও রোজিনা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন, সেই বাসগুলোর চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করার কথা জানান তিনি।
ধানমণ্ডির বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আবুল হায়াত বলেন, “২০০২ সালের অটোরিকশার মেয়াদ কয়েক বছর আগে শেষ হয়ে গেলেও এখন সেইসব ‘চলন্ত বোমা’ কীভাবে রাস্তায় নামে? সেই বিষয়ে বিআরটিএ থেকে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?”
এ বিষয়ে বিআরটিএ কর্মকর্তা মাসুদ বলেন, “এসব অটোরিকশা ১ এপ্রিল থেকে ধ্বংসের কাজ শুরু হয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে সবগুলো ধ্বংস করার পরিকল্পনা রয়েছে।”
কালের আলো/এসকে