পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ ‘ইতিহাসের পাতায়’, তৃতীয় বারের মতো স্বীকৃতি প্রধানমন্ত্রীর
প্রকাশিতঃ 5:39 pm | January 05, 2020
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
বেশিদিন আগের কথা নয়। পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে লাখ লাখ টাকা লেনদেন বা ঘুষের ছড়াছড়ি ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। এতে করে ফরম তোলার আগ্রহেই ভাটা পড়তো মেধাবী তারুণ্যের। বছরের পর বছর নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হতে হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলা গৌরবময় পুলিশ বাহিনীকে।
আরও পড়ুন: আইজিপির জবানীতে ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পুলিশ’, প্রধানমন্ত্রীর বাস্তবধর্মী পদক্ষেপে বেড়েছে সক্ষমতা!
কিন্তু মাত্র ৫ মাস আগে বদলে গেলো চেনা সেই চিত্রপট। খেটে খাওয়া দিনমজুর, নরসুন্দর, ভ্যানচালক, সবজি বিক্রেতা বা অতি দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তানরা পেয়েছে কনস্টেবল পদে চাকরি। তবে এজন্য তাদের গুণতে হয়নি ১০৩ টাকার বেশি একটি টাকাও।
শুধু একটি বা দু’টি জেলা নয়; সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন এবং কুতুবদিয়া থেকে তেতুলিয়ায় অভিন্ন এক দৃশ্য। ঘুষমুক্ত ও সম্পূর্ণ স্বচ্ছতায় দরিদ্র পরিবারের এমন মেধাবী তরুণদের চাকরি দিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে অপরাধ দমন ও জননিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ বাহিনীটির। পুলিশই পেরেছে পুলিশের ভাবমূর্তি ফেরাতে। সরকারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করেছে জনমানসে।
আরও পড়ুন: গণতন্ত্রের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় পুলিশ সাহসিকতার ভূমিকা পালন করেছে : প্রধানমন্ত্রী
আর এই কঠিন কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে মূলত বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণার দৌলতেই। ফলে একবার বা দুইবার নয় তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ১০ হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা পুলিশ বাহিনীর দৃঢ়কন্ঠে প্রশংসা করেছেন হ্যাট্টিক প্রধানমন্ত্রী।
আরও পড়ুন: পুলিশকে কতটা ভালবাসেন প্রধানমন্ত্রী?
রোববার (৫ জানুয়ারি) সকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স মাঠে বার্ষিক পুলিশ প্যারেডের মধ্য দিয়ে পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এবার আমরা ১০ হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ দিয়েছি।
বাংলাদেশ পুলিশ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দুর্নীতিমুক্তভাবে এই ১০ হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ দিয়ে একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সেজন্য আমি আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি মনে করি আপনারা একটি অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।’
আরও পড়ুন: ‘সাহসী’ ও ‘মানবসেবী’ ১১৮ পুলিশকে পদক দিলেন প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রীর এমন ঐতিহাসিক উচ্চারণের স্বাক্ষী হয়ে থাকলো রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের বিশাল প্রান্তর। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম(বার) উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাতসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
তৃতীয়বারের মতো স্বীকৃতি প্রধানমন্ত্রীর
পুলিশ সদর দপ্তরের সদিচ্ছায় কোনো প্রকার অর্থ লেনদেন, দুর্নীতি, অনিয়ম ও তদবির ছাড়াই স্বচ্ছতা ও মেধার ভিত্তিতে প্রায় ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর এই নিয়োগ নিয়ে অকপটে নিজের মুগ্ধতার কথা বারবার প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার প্রধান তৃতীয়বারের মতো স্বীকৃতি দিয়েছেন পুলিশকে।
বিদায়ী বছরের বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের মালকানাধীন কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ’র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ দুর্নীতির একটি বদনাম ছিল। পুলিশ সেখানে এবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
ঘুষ, দুর্নীতিমুক্তভাবে যেভাবে নিয়োগ হয়েছে অতি সাধারণ পরিবারের গরিব ছেলে-মেয়েরা চাকরি পেয়েছেন। প্রত্যেকে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করে বিশেষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সকলের এ বিষয়টি অনুসরণ করতে হবে।’
নিজের এই বক্তব্যের চারদিনের মাথায় রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ৩৬তম বিসিএস ব্যাচের সহকারী পুলিশ সুপারদের (এএসপি) পাসিং আউট প্যারেডে বক্তৃতাতেও পুলিশ বাহিনীর মনখোলা প্রশংসা করেন।
পুলিশ বাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিন স্পষ্ট ভাষায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের পুলিশ বাহিনী যে এবার নতুন রিস্ক্রুট করেছে সেখানে একটি লোকও কোন দুর্নীতি বা ঘুষ দেওয়ার কথা বলতে পারেনি। এ নিয়োগে এতো স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়েছে। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করার জন্য এ পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দিনেও এ ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই আপনারা (পুলিশ) এগিয়ে যাবেন।’
নতুন বছরের শুরুতেই রোববার (৫ জানুয়ারি) সকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স মাঠে পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগকে রীতিমতো ইতিহাস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি মনে করি পুলিশ বাহিনী একটি অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’
সেই কনস্টেবল নিয়োগের পেছনের গল্প
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীকে ডেকে নিয়ে বলেন, পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হতে হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম থাকবে না। চাকরি পেতে ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়।
কেউ জমি বিক্রি করে, ধার-দেনা করে ওই টাকা সংগ্রহ করে। এই কারণে ওই পুলিশ সদস্য চাকরিতে যোগ দিয়েই ওই টাকা উঠানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তাই আমি পুলিশে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পরই ছক কষে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।
পুলিশ বাহিনীতে সততার এক অনি:শেষ প্রেরণার প্রতীক পুলিশ প্রধান ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার) নিজেও একাধিকবার বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রক্রিয়ায় পুলিশে নিয়োগ প্রদান সম্ভব হয়েছে। জেলার পুলিশ সুপারদেরও ভূমিকা ছিল।’ এতো বড়ো সফলতা আসায় তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশের প্রতি সংবেদনশীল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বিভিন্ন সময়েই নিজের বক্তব্যে এ বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘১০ থেকে ১৫ বছর আগের পুলিশ আর এখনকার পুলিশ এক নয়। বর্তমানে পুলিশ জনবান্ধব পুলিশে রূপান্তরিত হয়েছে।
পুলিশ আস্থার প্রতীক হিসেবে মানুষের বিশ্বাসের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। পুলিশকে আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের ধারা চলমান রয়েছে। পুলিশ যদি নিরাপত্তার দায়িত্ব না নেয় তাহলে উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে এমন ভাবনায় প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে যথেষ্ট অগ্রাধিকার দেন।’
পুলিশ সপ্তাহে আরও কী বলেছেন প্রধানমন্ত্রী?
স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের নাম আজীবন থাকবে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। এদিন রোববার (০৫ জানুয়ারি) পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘দেশে পুলিশের অবদান ইতিহাসে সবসময় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
পুলিশ বাহিনী প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সাহসিকতা ও দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। বিশেষ করে সড়ক নিরাপত্তায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। পথচারীসহ সকলের চলাচলে ট্রাফিক পুলিশ অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে জনগণ তাৎক্ষণিক সুবিধা পাচ্ছেন। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। এমনকি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায়ও পুলিশ কাজ করছে।’
পুলিশের কাজে সাহসিকতা ও দক্ষতার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশের প্রত্যেকটি কাজে সাহসিকতা ও দক্ষতা দেখেছি। বিএনপি-জামায়াতের নাশকতায় পুলিশের ২৯ জন সদস্য নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি পুলিশ সদস্য এ সময় নিজের জীবনবাজি রেখে এসব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড প্রতিহত করেছে। এজন্য আমি পুলিশকে ধন্যবাদ জানাই।’
বাংলাদেশ পুলিশকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে বঙ্গবন্ধু’র জ্যেষ্ঠ কন্যা বলেন, ‘আমরা পুলিশে ব্যাপক পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছি। পুলিশের সেবা বাড়ানো হয়েছে। পুলিশের আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতিসংঘে শান্তি মিশনে বাংলাদেশের পুলিশের সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়া পুলিশে নারীদের নিয়োগও বাড়ানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের জন্য আজীবন রেশনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে সরকার। ইতোমধ্যে পুলিশের কল্যাণের লক্ষ্যে কল্যাণ ফান্ড গঠন করা হয়েছে। পুলিশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যাতে পুলিশ সদস্যরা সহজে ঋণ নিতে পারেন।’
কালের আলো/এমএএএমকে