বদলে যাচ্ছে এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ছক

প্রকাশিতঃ 7:53 am | May 05, 2018

:: অ্যান্ড্রু হ্যামন্ড ::

২০১৫ সালের পর প্রথমবারের মতো ত্রিদেশীয় বৈঠকে মিলিত হতে যাচ্ছেন দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও জাপানের শীর্ষ নেতারা। ৯ মে এ সংক্রান্ত বৈঠকটি হবে বলে দেশ তিনটির নেতাদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝে ছোট আকারে সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হওয়ার পর এশিয়ার ভূরাজনৈতিক দাবার ছক যে বদলে যাচ্ছে, এটি তার সর্বশেষ উদাহরণ। এমনকি বিষয়টি (দুই কোরিয়ার সম্পর্ক পুনঃস্থাপন) কেবল সিউল ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যকার সম্পর্ক উষ্ণ করার উপলক্ষই নয়, এটি ত্রিদেশীয় বৈঠকের দিকেও চালিত করছে।

৯ মে অনুষ্ঠেয় বৈঠকের পেছনের আরেকটি মূল অনুঘটক হল সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় চীন ও জাপানের বিরুদ্ধে বাণিজ্য শুল্কারোপসহ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এজেন্ডাগুলোর কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা, যা দক্ষিণ চীন সাগরে দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বিরোধের কারণে দুই দেশের সম্পর্ক ইতিহাসের সর্বনিু পর্যায়ে থাকার পরও দেশ দুটিকে পরস্পরের কাছাকাছি আসার জন্য বড় ধরনের উদ্দীপনা জুগিয়েছে।

এ পর্যায়ে ৮ থেকে ১১ মে ত্রিদেশীয় বৈঠকের অংশ হিসেবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সফরে জাপান যাচ্ছেন। তার এ সফরকে দু’পক্ষ থেকেই দেখা হচ্ছে চীন ও জাপানের মাঝে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মূলভিত্তি শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তির ৪০ বছর পূর্তির আগে সম্পর্ক বৃদ্ধির আগাম উষ্ণ তোপধ্বনি হিসেবে। গত সপ্তাহের আন্তঃকোরিয়া বৈঠকের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের কাছ থেকে জেনে নিতে ত্রিদেশীয় সংলাপকে কাজে লাগানোরও চেষ্টা করবেন জিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। নিজেদের গভীর স্বার্থের বিষয়টি সামনে রেখে বেইজিং ও টোকিও- কেউই অনুষ্ঠেয় বৈঠকটিকে হালকাভাবে বা সাইডলাইন থেকে দেখতে চাচ্ছে না। এ কারণেই ২০১১ সালে ক্ষমতা নেয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরে মার্চ মাসে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনকে বেইজিংয়ে ডেকে নেয়া হয়।

জিনপিং ও আবে- দু’জনই তীক্ষèভাবে সতর্ক আছেন যে, মে বা জুন মাসে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাঝে প্রস্তাবিত বৈঠকের পরিকল্পনাগুলো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প বলেছেন, অনুষ্ঠেয় বৈঠকটির জন্য সম্ভাব্য স্থান হিসেবে কোরিয়ার সমরমুক্ত অঞ্চল ও সিঙ্গাপুরকে বিবেচনা করছেন তিনি। এ মাসেই উত্তর কোরিয়ার প্রধান পরমাণু পরীক্ষা কেন্দ্র পুংগে-রি বন্ধের বিষয়ে কিমের ঘোষণা আসার পর একটি পারমাণবিক চুক্তির সত্যিকারের সুযোগ এসেছে- যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও’র এমন ঘোষণার পর ট্রাম্প-কিম বৈঠকের সম্ভাব্য স্থানের খবরটি এসেছে।

এসব খবরের কারণে এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ছকে সম্ভাব্য বৃহৎ পরিবর্তনের বিষয়টি জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে। এমনকি নতুন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন এ প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক সুর যোগ করেছেন রোববার এমন ইঙ্গিত দিয়ে যে, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিপরীতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংসের যে ধরনের চুক্তি ২০০৩ সালে লিবিয়ার সঙ্গে হয়েছে, সে ধরনের যুক্তরাষ্ট্র-কোরিয়া চুক্তি হতে পারে। ২০১৭ সালজুড়ে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প নিয়ে উত্তেজনা ঘুরপাক খাওয়ার পর ২০১৮ সাল যে উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সুযোগ নিয়ে এসেছে, তা এককথায় অনবদ্য। ট্রাম্প এ জন্য অনেক কৃতিত্ব নিতে পারেন এবং তার কঠোর অবস্থানের নীতি সম্ভবত কিছু মিশ্র ঘটনার অংশ হিসেবে কিম জং উনকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে এনেছে।

যদিও অনেক বেশি মার্কিন চাপ উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে কূটনৈতিক সুযোগের জানালা খুলে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তারপরও পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় সমর্থন দিয়ে চীনও নিজের পক্ষ থেকে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। ঐতিহ্যগতভাবে নিজের কমিউনিস্ট প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে চীনের অনীহা ছিল। এটি অবশ্য ছিল এই ভয়ে যে, দেশটিকে বেশি কঠোরভাবে চেপে ধরলে উত্তর কোরিয়া আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।

জিনপিং বিশ্বাস করেন, অন্তত দুটি কারণে এটি (উত্তর কোরিয়াকে অস্থিতিশীল করে তোলা) সম্ভবত চীনের স্বার্থের অনুকূলে নয়। প্রথমত, যদি উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট শাসন পড়ে যায়, তবে বিষয়টি চীনের কমিউনিস্ট দলের গ্রহণযোগ্যতাকেও দুর্বল করবে। তিনি আরও ভয় করেছিলেন, উত্তর কোরিয়ার আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়লে সীমান্তে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হবে। বড় ধরনের শরণার্থী লাইন তৈরি হবে, যার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব চীনকে নিতে হবে এবং সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রপন্থী একটি দেশের উত্থান ঘটবে।

ট্রাম্প-কিম বৈঠকের পরিকল্পনার পারিপার্শ্বিক ইতিবাচক যেসব বিষয় এখন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, সবাই জানে যে, তাতে সুযোগের পাশাপাশি বড় ধরনের ঝুঁকির বিষয়াদিও রয়েছে। যদিও দেখা যাচ্ছে কিমের সঙ্গে বৈঠকে খুবই আগ্রহী ট্রাম্প, অথচ তিনি আগে বলেছিলেন, ‘উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না, তারা কেবল একটি জিনিসই বোঝে!’ এ মন্তব্যে কেবল ট্রাম্পের অস্থিরতাই প্রকাশ পায় না, একই সঙ্গে এ ইস্যুতে তিনি যে রাজনৈতিক চাপের মধ্যে আছেন তাও বোঝা যায়। এ কারণে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র এবং আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রবাহী পারমাণবিক ওয়ারহেড নিয়ে দেশটির ওপর রাজনৈতিক চূড়ান্ত সীমা ঘোষণা করা হয়েছিল।

‘ইউএস ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্টসে’র হিসাব-নিকাশ হচ্ছে, নভেম্বর মাসে উত্তর কোরিয়া সর্বশেষ যে ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল, সেটি যদি যথাযথ পথের বিপরীতে মানসম্মত বাঁকা পথে যায় তবে তা হবে ১৩ হাজার কিলোমিটার মাত্রার। এটি ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো অঞ্চলে আঘাত হানার জন্য যথেষ্ট। এ কারণে ট্রাম্প সব ধরনের বিকল্প নিয়েই টেবিলে বসবেন।

সবকিছু বিবেচনায় নিলে জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার ঘোষণা এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ছকে পরিবর্তনের সর্বশেষ নির্দেশক। এখন পর্যন্ত যদিও পরিস্থিতি অনেক বেশি ইতিবাচক, বিশেষ ইঙ্গিতপূর্ণ ঝুঁকিও কিন্তু রয়ে গেছে। যদি দুই কোরিয়ার সংলাপ শেষ পর্যন্ত মরীচিকা প্রমাণিত হয়, তবে ইস্যুটি নিয়ে ট্রাম্প নিজে যে চাপের মধ্যে আছেন, উত্তর কোরিয়ার ওপর আবারও চাপের পাহাড় তোলার চেষ্টা করবেন তিনি।

আরব নিউজ থেকে অনুবাদ : সাইফুল ইসলাম

অ্যান্ড্রু হ্যামন্ড : লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের এলএসই আইডিয়াস-এর সহযোগী