গতি বাড়ছে প্রচারের, দুই সিটিতে জরিপে এগিয়ে আতিক-তাপস

প্রকাশিতঃ 9:42 pm | January 19, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের প্রচারের গতি  বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাদের ব্যস্ততা। দিনমান জনসংযোগ, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক, কর্মী সমর্থকদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তাঁরা পার করছেন ব্যস্ত সময়।

প্রতিটি এলাকায় একবার হলেও ভোটারদের দেখা দিয়ে আসার প্রয়াস নিজয়েছেন প্রার্থীরা। কখনও হেঁটে, কখনও গাড়িতে চড়ে ছুটছেন তারা। বলছেন নানা কথা, দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। তবে দুই সিটিতেই জনপ্রিয়তায় বিএনপি’র দুই প্রার্থী তাবিথ আউয়াল এবং ইশারক হোসেনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস।

নিজেদের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ১১ বছরের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড, ঢাকাকে আধুনিক নগরী গড়ে তুলতে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের পক্ষে দলীয় নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচারণা ভোটের মাঠে আতিকুল ও তাপসকে এগিয়ে রেখেছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিচালিত এক গোয়েন্দা জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

দলীয় সূত্র জানায়, দুই সিটিতে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে নিজস্ব জরিপ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই জরিপে এগিয়ে থাকায় স্বচ্ছ ইমেজের দুই প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপসকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়।

এরপর আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হওয়ার পর প্রথম সপ্তাহে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ মনোনীত দুই মেয়র প্রার্থীর অবস্থান কেমন, তারা কেমন সাড়া জাগিয়েছেন, জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে এগিয়ে না পিছিয়ে এসব বিষয় জানতে আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাঠ জরিপ করেন।

একই সূত্র জানায়, দুই প্রার্থীর প্রচারণা ও কৌশলে ভোটারদের মাঝে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে না কী কৌশলে পরিবর্তন আনা গুরুত্বপূর্ণ এ লক্ষ্যেও জরিপটি পরিচালিত হয়। জরিপে দুই প্রার্থীর শক্ত অবস্থানের চিত্রই উঠে আসে।

গত শনিবার (১৭ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা ক্লিন ইমেজের দুজনকে মনোনয়ন দিয়েছি। জনগণ স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থীকে পছন্দ করে। আগামী নির্বাচনে দুই সিটিতে মেয়র হিসেবে আমাদের প্রার্থীরা বিজয়ী হবেন বলে আমি আশা করি।’

যোগ্য প্রার্থীদের রেখে কেন তাবিথ-ইশরাককে মনোনয়ন?
জনমানসে আওয়ামী লীগ মনোনীত দুই প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তাপসের ইতিবাচক ভাবমূর্তি থাকলেও বিএনপি’র দুই প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

২০১৭ সালের নভেম্বরে ফাঁস হওয়া দুর্নীতির প্যারাডাইস পেপারসে ‘অভিজাত দুর্নীতিগ্রস্তদের’ তালিকায় নাম রয়েছে বিএনপি’র ধনকুবের নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু, তাবিথ আউয়ালসহ পরিবারের সদস্যদের। তারা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য বারমুডায় অর্থ সরিয়ে রেখেছিলেন, এটাই ওই সময় বলেছিল প্যারাডাইস পেপারস।

এমন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ায় ভেতরে ভেতরে অসন্তুষ্ট বিএনপি’র সিনিয়র নেতারাও। প্রকাশ্যে কেউ মুখ না খুললেও গুলশান, বনানী, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকার ভোটাররা দুর্নীতির অভিযোগ উঠা এমন প্রার্থীকে আদৌ গ্রহণ করবেন কীনা এ বিষয়টি নিয়েও সন্দেহ-সংশয় তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি মূলধারার একটি অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিএনসিসি নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি, বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন। কিন্তু তাকে দলীয় মনোনয়ন দেননি বিএনপি’র দন্ডপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান।  

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে তারেকের বিলাসী জীবনের সব খরচের জোগানদাতা তাবিথের ধনকুবের বাবা আব্দুল আউয়াল মিন্টু। ফলে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির সৎ প্রার্থীদের রেখে তাকেই তিনি মনোনয়ন দিয়েছেন।

বিএনপি’র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, কর ফাঁকি দিয়ে বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়া, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাঠানো, অবৈধ আয়ের টাকায় ‘বৈধ’ ক্ষমতার মালিক হতে গোপনে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে বিনিয়োগের। বিদেশে বিনিয়োগ করা সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার।

আরেকটি সূত্র বলছে, নানা ইস্যুতে চরম ইমেজ সংকটের মুখে ছিলেন ডিএসসিসির বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকন। তাঁর আমলনামা সন্তোষজনক না হওয়ায় তিনি দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হন।

এক্ষেত্রে তাঁর পরিবর্তে মনোনয়ন দেওয়া হয় ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য, সৎ ও বিনয়ী রাজনীতিক শেখ ফজলে নূর তাপসকে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন ঠিক তাঁর উল্টোটি করেছেন বিএনপি।

সূত্র জানায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি’র প্রভাবশালী রাজনীতিক মির্জা আব্বাস, তাঁর স্ত্রী আফরোজা আব্বাস, ঢাকা দক্ষিণ বিএনপি’র সভাপতি হাবীব-উন-নবী খান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশারসহ অনেকেই মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেও তারেক আস্থা রেখেছেন প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেনের ওপর।

এ নিয়ে বিএনপি’র ভেতরকার একটি শক্তিশালী অংশ নাখোশ। সাঈদ খোকনের সঙ্গে গত সিটি নির্বাচনে আব্বাস ভোটে দাঁড়ালেও মূল প্রচারণা চালিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। সব সময় দলীয় নেতা-কর্মীদের আপদে-বিপদে পাশে থাকার মানসিকতার কারণে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার জোর দাবি উঠেছিল।

কিন্তু তারেক অভিজ্ঞতা, জনপ্রিয়তা বা ত্যাগ কোনটিকেই বিবেচনায় না নিয়ে একেবারে আনকোড়া একজন প্রার্থীকে বেছে নিয়েছেন।

একই সূত্র বলছে, সম্প্রতি দুর্নীতির মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে ইশরাক হোসেনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন।

ইতোমধ্যেই ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৯ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন।

সূত্র জানায়, তারেকের যেমন যুক্তরাজ্যের বিলাসী জীবনের ব্যয়ভার বহন করছেন তাবিথের বাবা তেমনি দুর্নীতি মামলায় কারাগারে থাকা তাঁর মা, দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ারও ভরণপোষণের অর্থের জোগান দিতেন প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা।

ফলে যোগ্যতার মাপকাঠির বদলে অর্থকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তারেক। ভোটের মাঠে এসব বিষয় ইশরাককে ব্যাক গিয়ারে নিয়ে গেছে বলে মনে করছেন ভোট বিশ্লেষকরা।

কাউন্সিলর পদেও বিতর্কিতদের মনোনয়ন দেয়নি আ.লীগ
ডিএনসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ কারান্তরীণ বর্তমান কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব। তার বদলে এই ওয়ার্ডে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের ‘ফ্রেশ ব্লাড’ হিসেবে পরিচিত তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা আসিফ আহমেদকে। হাইকমান্ডের এই সিদ্ধান্তে খুশি দলটির নেতা-কর্মীরা। ফলে ঐক্যবদ্ধভাবে আসিফকে বিজয়ী করতে কোমরবেঁধে মাঠে নেমেছেন তারা।

কেবল এই ওয়ার্ড নয়, দুই সিটিতে ৪০ টি ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলররা আওয়ামী লীগের সমর্থন পায়নি। তাদের বিরুদ্ধে ক্যাসিনো, মাদক, দখল, পরিবহন চাঁদাবাজি, ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ, বৈঠকে অনুপস্থিত থাকাসহ নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ যেমন রয়েছে তেমনি দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এলাকার বিভিন্ন ক্লাব, সামাজিক সংগঠন, বিভিন্ন মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করছিলেন তারা।

এদের মধ্যে কেউ গ্রেফতার হয়েছেন আবার কেউ বিদেশে পালিয়ে আছেন। এই ৪০ ওয়ার্ডসহ ৫১ ওয়ার্ডে এবার নতুন মুখের প্রতি সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এদের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত ভোটারদেরও প্রভাবিত করছে। ফলে প্রচারণা ও জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে বিএনপি’র মনোনীত প্রার্থীদের চেয়ে এসব ওয়ার্ডেও এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।

কী বলছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা?
দুই সিটিতে দুই মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের বিজয় নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে রয়েছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। বিজয়ের ফসল ঘুরে তুলতে নানা পরিকল্পনা যেমন নিয়েছেন তেমনি দলটির কেন্দ্রীয় নেতারাসহ ঢাকা মহানগরের দুই অংশের নেতারা এবং মূল দল ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও বিরামহীন প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান কালের আলোকে বলেন, ‘দুই সিটিতেই বিজয় ধরে রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মাঠে রয়েছেন। ভোটাররাও তাদের পক্ষে ইতিবাচক সমর্থন দিচ্ছেন। তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বিবেচনায় নিয়েই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তাঁরাই নির্বাচনে জয়ী হবেন বলে আমি মনে করি।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য আব্দুর রহমান কালের আলোকে বলেন, দুই মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের বিজয়ের বিষয়ে আমরা শতভাগ আশাবাদী। তাঁরা গ্রহণযোগ্য, সৎ ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী। বিপরীতে বিএনপি’র দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। আমি মনে করি ভোটাররা নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সময় এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করবেন।’

কালের আলো/এসআর/এমএএএমকে