অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সমৃদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী; প্রস্তুত প্রতিরক্ষায়

প্রকাশিতঃ 2:40 pm | January 27, 2020

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো :

যুদ্ধ নয় বরাবরই শান্তির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যুদ্ধ চান না তবে আক্রান্ত হলে মোকাবেলার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে বলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে।

একটি দক্ষ, সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত বাহিনী হিসেবে গোটা বিশ্বে স্বনামে খ্যাত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের গুণগত মান আরও বৃদ্ধি ও উন্নয়ন অর্জনের জন্য নানামুখী কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।

সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে যেমন প্রধানমন্ত্রীর গভীর মনোযোগ রয়েছে তেমনি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে নতুন নতুন ট্যাংক, অরলিকন রাডার কন্ট্রোল্ড গান বা প্রশিক্ষণ বিমান কিনে দিচ্ছেন দেশপ্রেমিক এই বাহিনীকে। পরিকল্পনায় রয়েছে কাসা বিমান কেনার।

অত্যাধুনিক এসব অস্ত্র সরঞ্জাম ‘ফোর্সে গোল-২০৩০’ অর্জনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্যদের মনোবলও বহুগুণে বৃদ্ধি করবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সব সময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই উচ্চারণ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে শক্তিশালী সেনাবাহিনী জনগণের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি জাতীয় প্রয়োজনে যে কোন দায়িত্ব পালনে সক্ষমতা অর্জন করেছে।’

সম্প্রতি নোয়াখালী জেলার স্বর্ণদ্বীপে কল্পিত যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পর্যদুস্ত করে বিজয় অর্জন করা মহড়া ‘অপারেশন বিজয় গৌরব’এ দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতায় নিজের সন্তুষ্টির কথা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শীতকালীন এই প্রশিক্ষণ মহড়া পরিদর্শনে দর্শক সারিতে সার্বক্ষণিক প্রধানমন্ত্রীর পাশেই বসেছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টতই বলেন, ‘অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যেন কিছুতেই পিছিয়ে না থাকে সেটাই আমাদের লক্ষ্য। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো জ্ঞানসম্পন্ন সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হবে। স্বর্ণদ্বীপের প্রশিক্ষণ সুবিধা সেনাবাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধিতে তাৎপর্য ভূমিকা রাখবে।’

সেদিনের ওই প্রশিক্ষণে আধুনিক ট্যাংক, এপিসিএস, মিগ ফাইটার প্লেন এবং তিন সশস্ত্র বাহিনীর এমআই হেলিকপ্টার ব্যবহৃত হয়। ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের ২২২ পদাতিক ব্রিগেডের পাশাপাশি বিমানবাহিনী, নৌ বাহিনী ও সেনা বাহিনীর আর্টিলারি ইঞ্জিনিয়ার্স সিগন্যাল কমান্ডো এবং আর্মি এভিয়েশন গ্রুপ আক্রমণে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে।

উপভোগ্যকর সেই মহড়া অনুষ্ঠানের ধারাভাষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্র সরঞ্জামের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়। ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল নজরুল ইসলামও ওই মহড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে সংযোজিত আধুনিক সমরাস্ত্র ও সরঞ্জামাদির সমন্বয়ে ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের ২২২ পদাতিক ব্রিগেড গ্রুপ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করছে বলে অনুষ্ঠানে ব্রিফ করেন।

ধারাভাষ্যকাররাও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্বয়ংক্রিয় (সেলফ প্রোপেলড) কামান ও ট্যাংক-বিধ্বংসী মেটিস এম-১ ক্ষেপণাস্ত্র, আর্মার পার্সোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি), টোটাল লকেটিং রাডার, মনুষ্যবিহীন আকাশযানসহ বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্রের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কালের বিবর্তনে এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্রমধারায় ট্যাংক এবং এর ফায়ার ক্ষমতার ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নতুন সংযোজিত এমডিটি ২০১০ একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। স্বর্ণদ্বীপে কল্পিত যুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণে ব্যবহৃত হয় ট্যাংক টি ৫৯, টি ৬৯ টু জি এবং বর্তমান সরকারের দেওয়া অত্যাধুনিক ট্যাংক ৫৯ রি দুর্জয় ও এমডিটি ২০০০।

পদাতিক বাহিনীর গতিশীলতা বৃদ্ধি ও ক্ষুদ্রাস্ত ফায়ারের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা প্রদানের জন্য আর্মার পার্সোনাল ক্যারিয়ারের (এপিসি) আবির্ভাব ঘটে। ১৯১৮ সালে একটি যুদ্ধে সর্বপ্রথম এটি ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ম্যাকানাইজড ইনফ্রেন্টি ব্যাটালিয়নসমূহ অত্যাধুনিক বিটিআরএটি এপিসি দ্বারা সুসজ্জিত।

সশস্ত্র বাহিনীতে অতি সম্প্রতি সংযোজিত এপিসি বিটিআর ৮০, মডার্ন ইনফ্রেন্টি বুলেট প্রুফ হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, ১৫৫ মিলিমিটার নোরা বি-৫২ গান, টোটাল লকেটিং রাডার, মনুষ্যবিহীন আকাশযান, ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র মেইড ইজ এম ওয়ান, অটোমেটিক গ্রেনেড লঞ্চার এবং আর্মি এভিয়েশন গ্রুপের হেলিকপ্টার ‘অপারেশন বিজয় গৌরবে’ অংশগ্রহণ করে।

এপিসি বিটিআর ৮০ সম্পর্কে বলা হয়, এটি একটি অত্যাধুনিক যান যা ভূমি এবং পানিতে চলাচলে সক্ষম। এতে একটি ১৪.৫ মিলিমিটার বিমান বিধ্বংসী মেশিন গান ও ৭.৬২ মিলিমিটার মেশিন গান রয়েছে। যাদের কার্যকর দূরত্ব ২ হাজার ও ১৫০০ মিটার।

এই এপিসিগুলো নাইট ভিশন ডিভাইসের মাধ্যমে রাতের বেলায় চলাচল ও লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে সক্ষম। ভূমিতে এই এপিসির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটার ও পানিতে ঘন্টায় ৯ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সংযোজিত এপিসি বিটিআর ৮০ বিভিন্ন শান্তিরক্ষা মিশনে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছে।

নোরা বি-৫২ গান বা কামান সর্বোচ্চ ৪১ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম বলে জানানো হয়েছে। এই কামান দিয়ে মিনিটে ৫টি করে গোলা ছোড়া যায়। এছাড়া আরও ৩৬টি গোলা মজুত রাখার স্থান আছে এই কামানে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০৩০’র আলোকে আর্মি এভিয়েশনকে একটি অত্যাধুনিক সংস্থায় রূপান্তরের প্রচেষ্টায় সংযোজিত হয়েছে স্পেনের তৈরি চতুর্থ প্রজন্মের একটি অত্যাধুনিক কাসা সি-২৯৫ সামরিক পরিবহন বিমান, যুদ্ধে বহুল প্রতিক্ষীত রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক ৬ টি এমআই ১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার এবং ফ্রান্সের তৈরি চতুর্থ প্রজন্মের দুইটি টকহীন হেলিকপ্টার।

একই সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর এসব অবদান আর্মি এভিয়েশনকে একটি যুগোপযোগী সংস্থায় পরিণত করার প্রচেষ্টাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আর্মি এভিয়েশন অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এক কোম্পানি সৈন্য বাংলাদেশের যে কোন স্থানে যে কোন সময়ে স্থানান্তর করতে সক্ষম।

দেশের যে কোন দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা মোকাবেলায় আর্মি এভিয়েশন আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি সক্ষম। স্বর্ণদ্বীপের ওই মহড়ায় প্যারাট্রুপারদের জন্য নিয়োজিত কাসা ২৯৫ বিমান এবং সকল হেলিকপ্টার আর্মি এভিয়েশন থেকে নিয়োগ করা হয়।

সূত্র মতে, সরকারের ফোর্সেস গোল ২০৩০ অনুযায়ী অর্জনের লক্ষ্যে প্রধামন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে মেটিস এম-১। যা দ্বিতীয় প্রজন্মের ট্যাংক বিধ্বংসী একটি অস্ত্র।

এই অস্ত্রটির সর্বোচ্চ কার্যকরী দূরত্ব ২ হাজার মিটার। এটি বর্তমান যুগের যে কোন আধুনিক ট্যাংক ধ্বংস করতে সক্ষম। রাশিয়ার তৈরি এই ক্ষেপণাস্ত্রের ওজন ৩০ কেজির মতো।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে নতুন লুকেটিং রাডার এসএমসিটু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আরেকটি নতুন সংযোজন। একটি উইপন লুকেটিং রাডার ব্যবস্থা মূলত তিনটি গাড়ির সমন্বয়ে গঠিত। এ গাড়ি ব্যবহার করে শত্রুর অস্ত্রের অবস্থান নির্ণয় করা যায়।

তেমনি শত্রুর অবস্থানের নিজস্ব আর্টিলারি ফায়ারেরও সমন্বয় করা যায়। শত্রুর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য রাডারের জন্য ইউএবি সংযোজন করা হয়েছে সেনাবাহিনীতে, জানিয়েছে একই সূত্র।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, অটোমেটিক গ্রেনেড লাঞ্চার অতীব কার্যকরী একটি অস্ত্র। বর্তমান সরকারের উদ্যোগে অতি সম্প্রতি পদাতিক বাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে এটি। এর কার্যকরী দূরত্ব ১৫০০ থেকে ২২০০ মিটার। এর সাহায্যে প্রতি মিনিটে ৩৫০ থেকে ৫০০ রাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা সম্ভব।

চীনের তৈরি ট্যাংক-বিধ্বংসী অস্ত্র পিএফ-৯৮টি নামের অস্ত্রটি মূলত হালকা কামান। এটি ৮০০ মিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারবে। কামানটিতে রাতেও নির্ভুলভাবে গোলা নিক্ষেপের ব্যবস্থা আছে।

যুক্তরাজ্যে তৈরি ‘সাউন্ড রেঞ্জিং ইকুইপমেন্ট’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্টিলারি রেজিমেন্টের লোকেটিং উইংয়ের কাছে রয়েছে। এই যন্ত্র সর্বোচ্চ ২৫ কিলোমিটার দূরের গোলাবারুদের শব্দ শুনে উৎস শনাক্ত করতে সক্ষম। তবে ১৫ কিলোমিটার দূরের শব্দ নির্ভুলভাবে সনাক্ত করতে পারবে।

স্বর্ণদ্বীপে শীতকালীন মহড়া শেষে প্রধানমন্ত্রীর দরবারে স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে নেতৃত্ব দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘জাতির পিতার নির্দেশিত প্রতিরক্ষা নীতি ১৯৭৪ এর আলোকে বাংলাদেশের নতুন প্রতিরক্ষানীতি ২০১৮ ফোর্সেস গোল ২০৩০ প্রবর্তিত হয়েছে।

সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ দিকনির্দেশনায় ফোর্সেস গোল-২০৩০ বাস্তবায়নের কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে।’

গত বছরের অক্টোবরে এবং ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সংযোজিত হয় ‘অরলিকন রাডার কন্ট্রোল্ড গান’ ও চারটি ডায়মন্ড ডিএ৪০এনজি প্রশিক্ষণ বিমান। আকাশে শত্রু বিমান ধ্বংসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের ধারায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে এই গান।

যুদ্ধ সরঞ্জামাদিতে আধুনিক এই প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় নিজস্ব সক্ষমতার দিক থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ গত বছরের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ ফায়ারিং প্রত্যক্ষ করে নতুন অস্ত্রের নিপুণতা এবং কার্যকারিতা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিমান বহরে নতুনভাবে চারটি ডায়মন্ড ডিএ৪০এনজি প্রশিক্ষণ বিমান সংযোজিত হয়। ওইদিন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি কাসা বিমান কেনার পরিকল্পনার কথা জানান।

ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে আরও ৬ টি হেলিকপ্টারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও সরকারকে জানানো হয়েছে সেদিন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন সেনাপ্রধান।



এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান
অ্যাকটিং এডিটর
কালের আলো.কম
.

কালের আলো/এমএএএমকে