দুই সিটিতে যেসব কারণে জিতবেন আতিকুল-তাপস!
প্রকাশিতঃ 12:22 pm | January 31, 2020
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
প্রচারণা শেষে এখন ঢাকার দুই সিটিতে ভোটের অপেক্ষা। এক বছরের ব্যবধানে আবারও মুখোমুখি হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও সাবেক প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দুই সিটিতে ৫৪ লাখ ভোটার হলেও এ ভোটের দিকে তাকিয়ে আছে ষোল কোটির বাংলাদেশ। ফলে কে জিতবে আর কে হারবে এ নিয়ে সব মহলেই চলছে চূলচেরা বিশ্লেষণ।
আরও পড়ুনঃ উত্তরে আতিকুল ৫০.৭%, তাবিথ ১৭.৪%; দক্ষিণে তাপস ৫৪.৩%, ইশরাক ১৮.৭%
ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এক জরিপে বিশাল ভোটের ব্যবধানে উত্তর ও দক্ষিণে আওয়ামী লীগ মনোনীত দুই মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের বিজয় দেখেছেন।
অনেকগুলো সমীকরণ সামনে নিয়ে হিসাব কষেছে দেশের জনপ্রিয় অনলাইন গণমাধ্যম কালের আলোও। এই গণমাধ্যমের নিজস্ব জরিপে দুই সিটিতে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর ভোট বিপ্লবের বার্তাই উঠে এসেছে।
আওয়ামী লীগের দুই অভিজ্ঞ প্রার্থী
রাজনৈতিক অঙ্গণে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপস চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের দুই প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেনের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছেন।
দুই ‘ধনকুবের’ বাবার পরিচয়ে তাবিথ-ইশরাক মনোনয়ন পেলেও আতিকুল ও তাপস পেয়েছেন নিজেদের যোগ্যতার মাপকাঠিতে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর বাস্তবমুখী অভিজ্ঞতা থাকলেও এক্ষেত্রে বিএনপি’র দুই প্রার্থী একেবারেই আনকোড়া।
ফ্যাক্টর শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা
ভোটে শেষ পর্যন্ত কে হাসবেন বা কে পরাজয়ের গ্লানির মুখে পড়বেন এমনটি ফল প্রকাশের পর নির্ধারিত হলেও উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার প্রশ্নে সরকার প্রধান, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ইমেজ ও জনপ্রিয়তাই আওয়ামী লীগের দুই হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থীকে জেতাতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই।
জানা যায়, ভোটের প্রচারণা শুরু হওয়ার সাতদিনের মাথায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিচালিত এক গোয়েন্দা জরিপে বলা হয়েছিল, মেয়র পদে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ১১ বছরের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড, ঢাকাকে আধুনিক নগরী গড়ে তুলতে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের পক্ষে দলীয় নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচারণা ভোটের মাঠে তাদের এগিয়ে রেখেছে।
উন্নয়ন নিশ্চিতেই গুরুত্ব ভোটারদের
কালের আলো’র জরিপে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন গোটা বিশ্বের কাছেই বিস্ময়। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে থাকা, উন্নয়নের মহাসড়কে অদম্য অগ্রযাত্রা ও সফলতার ধারাবাহিকতা ঢাকার দুই সিটিতেও থাকবে মেয়র পদে নৌকার দুই প্রার্থী বিজয়ী হলে।
এই ব্যাপারটি ভোট প্রদানে ভোটারদের কাছে অন্যতম প্রধান বিবেচ্য বিষয়। অপরূপ ঐতিহ্যের এক স্বপ্নের ঢাকা গড়ার অঙ্গীকার করা নৌকার দুই প্রার্থী মেয়র নির্বাচিত হলে বাসযোগ্য ঢাকা গড়া বা নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ তাদের জন্য যতটুকু সহজ হবে ঠিক ততটুকুই কঠিন হবে তাবিথ ও ইশরাকের জন্য।
কারণ ঢাকাকে বাসযোগ্য করা কেবলমাত্র একজন মেয়রের পক্ষে সম্ভব নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সরকারের সদিচ্ছার বিষয়টিও। ভোটাররা এটিও গুরুত্ব দিয়েই নিজেদের বিবেচনায় এনেছেন। বাসযোগ্য, আধুনিক ও ঐতিহ্যের ঢাকা নিশ্চিতেই তারা নৌকার দুই প্রার্থীর পক্ষে হেলে পড়েছেন।
বিতর্ক সৃষ্টিতে বিএনপি’র মনোযোগ
বিএনপি’র দুই প্রার্থী ইন্টেলিজেন্ট সিটি বা বিশ্বমানের বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার কথা বললেও তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে দুর্নীতির মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে।
ইভিএম নিয়ে তারা অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী যেখানে শুধুমাত্র উন্নয়নকেই সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়েছেন সেখানে বিএনপি’র দুই প্রার্থীর এমন নীতি ভোটারদের উদ্দীপ্ত করতে পারেনি।
জরিপে আরও উঠে এসেছে, নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই বিএনপি’র দুই প্রার্থী তাবিথ ও ইশরাক বড় ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা বা বাঁধার মুখে না পড়লেও তারা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ ও ইভিএম নিয়ে ভোটের মাঠকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু সাধারণ মানুষ দেখেছে তারা নেতা-কর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে নিজেদের প্রচারণা চালিয়েছেন। ঢাকা অলি-গলিতে তাদের ধানের শীষ প্রতীকে ছেয়ে গেছে। জাতীয় নির্বাচন থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সবক্ষেত্রেই বিএনপি যে পুরনো এই স্টাইলেই ‘পাবলিক’ টানার চেষ্টা করেন এই বিষয়টিও এবার ভোটারদের মাঝে খোলাসা হয়েছে।
আর ভোটাররা এই বিষয়টি হিসাব-নিকাশ করেই ইতিবাচক ভাবনা নিয়ে মাঠ কাঁপানো আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপসের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখেছেন। নির্বাচনে জেতার জন্য নয়, কেবলমাত্র ইস্যু তৈরি করতেই বিএনপি পুরোপুুরি মশগুল এই বিষয়টিও পরিস্কার হয়েছে ভোটারদের কাছে। এটিও আতিকুল ও তাপসের ভোটের ফসল ঘরে তুলতে সহায়ক হবে।
পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি বনাম দুর্নীতি
টানা ৯ মাস উত্তরের মেয়র ছিলেন আতিকুল ইসলাম। পরিশ্রমী, ভদ্র, বিনয়ী ও সজ্জন হিসেবেই সবার কাছে পরিচিতি রয়েছে তার। বাবার পরিচয়ে তিনি পরিচিত নন। আপন যোগ্যতায় নিজে দেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর দেশের গার্মেন্টস সেক্টরকে ঘুরে দাঁড় করিয়েছেন নিজের ক্যারিশমায়।
মেয়র পদে ৯ মাসের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হলে আগামী ৫ বছর টেস্ট খেলার কথা বলেছেন বারবার। এমন একটি ব্যবস্থা তিনি গড়ে তুলতে চান যেখানে সবাই মেয়রের ভূমিকা পালন করবেন। সিটি করপোরেশনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
নিজের ইশতেহারে ‘নগর পিতার’ ধারণাটি পাল্টে ‘নগর সেবক’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ভোটের প্রচারণায় কখনও ক্রিকেট খেলেছেন, নিজ হাতে চা বানিয়ে কর্মীদের পরিবেশন করেছেন। আবার কখনও গলাছেড়ে গান গেয়েছেন।
প্রয়াত জনপ্রিয় মেয়র আনিসুল হকেরই প্রতিচ্ছবি আতিকুল নিজের উদ্যম, সাহস ও বাস্তবধর্মী স্বপ্নে বদলে দিতে চান অবহেলিত উত্তর। নয় মাসে তার কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতার দৌলতেই তাকে নিয়ে ভোটারদের ভাবনা ইতিবাচক। এসব কারণেই তারা আতিকুল ইসলামের পক্ষেই এজন্য নিজেদের পূর্ণ আস্থা রেখেছেন।
এর বিপরীতে বিএনপি’র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল গত নির্বাচনে ঘটনাচক্রে বিএনপি’র সমর্থন পেয়েছিলেন। এবারও দলের অভিজ্ঞ অনেক নেতাকে ডিঙিয়ে দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন। আবার দুর্নীতির প্যারাডাইস পেপারসে ‘অভিজাত দুর্নীতিগ্রস্তদের’ তালিকায় তার ও নিজের পরিবারের সদস্যদের নাম রয়েছে।
ভোটের প্রচারণার শুরুতেই এক মুয়াজ্জিনকে ‘ধাক্কা’ দিয়ে চরমভাবে বিতর্কিত হয়েছেন। আবার ফাঁস হয়েছে তাঁর ছোট ভাইয়ের পরকীয়া কেলেঙ্কারি। এসব দিক থেকে পরিচ্ছন্ন আতিক ভোটের মাঠে বাড়তি সুবিধা পাবেন।
দক্ষিণে প্রত্যাশিত প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে পারেনি বিএনপি। সেখানে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছেন তিনবারের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে। ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারের সন্তান।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুজিববাহিনীর অধিনায়ক ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে এবং যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের ছোট ভাই। লাল-সবুজের বাংলাদেশে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন শেখ মনি। তার ছেলে তাপসের পরিচ্ছন্ন ইমেজ রয়েছে ভোটারদের কাছে।
ঢাকা দক্ষিণের হেভিওয়েট প্রার্থী শেখ তাপস তার ইশতেহারে ঐতিহ্যের ঢাকা ও সুশাসিত ঢাকার প্রতি জোর দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হবে বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে প্রথম দুর্নীতিমুক্ত সংস্থা। সাধারণ মানুষও তাপসের ভাবনার সঙ্গে একমত। আর এই ভাবনা বিনির্মাণেই তারা শতভাগ আস্থা রেখেছেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শাহাদাতবরণকারী শেখ মনি ও বেগম আরজু মনির এই সন্তানের ওপর।
অন্যদিকে, ব্যারিস্টার শেখ তাপসের অভিজ্ঞতার কাছে একেবারেই নস্যি বিএনপি’র প্রার্থী ইশরাক হোসেন। অভিজ্ঞতা, ত্যাগ ও জনপ্রিয়তা কোনটিই না বিবেচনা করে তাকে মনোনয়ন দিয়েছেন লন্ডনে পলাতক দলটির ভাইস চেয়ারম্যান। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রয়েছে; গঠন করা হয়েছে অভিযোগও। এসব দিক বিবেচনায় সচেতন ভোটাররা আওয়ামী লীগের প্রার্থী তাপসের জয়ের পাল্লাই ভারী বলে মত দিয়েছেন।
কাউন্সিলর পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই
দুই সিটিতে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের দুই হেভিওয়েট প্রার্থী বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও উত্তরে ৫৪ সাধারণ কাউন্সিলর ও ১৮ সংরক্ষিত কাউন্সিলর, দক্ষিণে ৭৫ কাউন্সিলর ও ২৫ সংরক্ষিত কাউন্সিলর নির্বাচনে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। কালের আলোর জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে।
সূত্র মতে, দুই সিটিতে কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রেও এবার অধিক মাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ। মাদক ও ক্যাসিনো বাণিজ্য, দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে এবার দুই সিটিতে ৪০ জন কাউন্সিলর এই নির্বাচনে দলীয় সমর্থন পায়নি। অনেক ওয়ার্ডে ক্ষমতাসীন দলটিতে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। ফলে কোন কোন ওয়ার্ডে ত্রিমুখী লড়াই হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
একই সূত্র জানায়, কোন কোন ওয়ার্ডে জনপ্রিয়তা ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিএনপি’র কাউন্সিলর প্রার্থীদের চেয়ে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীরা অনেক এগিয়ে রয়েছেন। অবিশ্বাস্য আশ্বাস-প্রতিশ্রুতিতে ভোটাদের দূয়ারে ভোট না চেয়ে সমস্যা সনাক্ত করে দ্রুত সমাধান দেওয়ার কথা বলেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী আসিফ আহমেদ।
তার প্রতিটি জনসংযোগে সর্বসাধারণের সম্পৃক্ততা চোখে পড়েছে। ভোটারদের তিনি জাগিয়ে তুলেছেন। পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখানো আসিফ আহমেদ আপাদমস্তক আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান।
নিজের প্রচারণার শেষ শোডাউনেও বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন উদ্যমী ও প্রতিশ্রুতিশীল এই রাজনীতিক। স্থানীয় সোনালী মাঠেই যেন এখানকার সব পথ গিয়ে মিশেছিল। রেকর্ড জনসমাগম ঘটিয়ে গণমাধ্যমেরও দৃষ্টি কেড়েছেন। তাঁর মতো জনসম্পৃক্ত কাউন্সিলর প্রার্থীরাই দুই সিটির ওয়ার্ডসমূহে বেরিয়ে আসবেন, এমন মতামত উঠে এসেছে কালের আলো’র জরিপে।
কালের আলো/এসকে/এমএএএমকে