দুই সিটিতে আ.লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই পুরনো পথে বিএনপি?
প্রকাশিতঃ 8:29 pm | February 02, 2020
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে মেয়র পদে টানা দুইবার জিতেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। পরপর দুইবার ভোটে জিতে তিনি এখন ‘অপরাজেয়’। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনেও বিপুল ভোটে জিতেছেন ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসও।
আরও পড়ুন: ‘আইওয়াশ’ হরতাল মানেননি ফখরুল; আলোচনার খোরাক রিজভী
কাউন্সিলর পদেও নিজ নিজ ওয়ার্ডে নোঙর করেছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরাই। ফল ঘোষণার আগেই বিএনপি নিশ্চিত হার জেনেই ভোটে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। রোববার (০২ ফেব্রুয়ারি) তাদের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালে সাড়া দেননি নগরীর বাসিন্দারা।
দুই সিটিতে মেয়র-কাউন্সিলর পদে ‘গো হারার’ পর পুরনো পথেই হেঁটেছে বিএনপি। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে শনিবার (০১ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠিত ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানামুখী ছক কষেছে দলটি।
প্রথম ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোট দিয়ে ভোটাররা যেখানে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, তরুণরা নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন সেখানে উল্টো পথেই হেঁটেছে প্রায় এক যুগ ক্ষমতার রাজনীতি থেকে বাইরে থাকা বিএনপি।
নিজেদের ভুল কৌশলের কারণেই ব্যাপক ভরাডুবি ঘটলেও সেই বিষয়টি মানতে নারাজ তারা। আওয়ামী লীগের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা যেখানে নিজেদের ভোট ব্যাংকের ওপর জোর দিয়েছেন, ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছতে সহায়তা করেছেন, কেন্দ্রে কেন্দ্রে নিজেদের সুসংহত অবস্থান নিশ্চিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন সেখানে বিএনপি শুরু থেকেই ইভিএম নিয়ে ভীতি তৈরি করেছেন।
বিএনপি তাদের নেতা কর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি করা হচ্ছে এসব কথাবার্তা বলে সাধারণ ভোটারদের ‘সিমপ্যাথি’ পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শান্তিপ্রিয় মানুষজন কোন রকম ঝক্কি-ঝামেলার পথে না গিয়ে বিএনপি’র ভীতি সঞ্চারে ভোট প্রদান থেকে নিজেদের দূরে রাখেন।
ভোটারদের উৎসাহিত করে তারা যদি আওয়ামী লীগের মতোই তাদের ভোটকেন্দ্রে নির্বিঘ্নে যাওয়ার উদ্যোগ নিতো তাহলে অবশ্যই ভোটের হার বাড়তো বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিএনপি’র মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে খোঁজে পাওয়া যায়নি, এমন অপপ্রচারের বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলেন, বিএনপি প্রশিক্ষীত কোন এজেন্ট নিয়োগ দিতে পারেনি। এটা তাদের একটি সাংগঠনিক দুর্বলতা।
বিএনপি আশাবাদী ছিল, এজেন্ট না দেওয়ার ফলে তারা এই অভিযোগ করতে পারবে যে এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ হালে পানি পায়নি কারণ কোথাও এজেন্টদের বের করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি বা এজন্টেরা এ ধরণেন কোনো অভিযোগও করেনি।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, উত্তর ও দক্ষিণে দলটির ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং কাউন্সিলর প্রার্থীদের কাছে এজেন্টদের জন্য বরাদ্দকৃত ১ হাজার করে টাকা দিয়েছিলেন তাবিথ ও ইশরাক। কিন্তু ওই নেতারা সেই টাকা নিজেদের পকেটে ভরেছেন। ফলে ভোটের দিন এজেন্টরা কাঙ্খিত টাকা না পেয়ে তাদের সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এরই প্রভাব পড়ে ভোটকেন্দ্রে।
ভোটের দিন ধানমন্ডিতে দলের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, ‘বিএনপি সাংগঠনিক সক্ষমতা হারিয়েছে। এজন্য সব কেন্দ্রে হয়তো এজেন্ট দিতে পারেনি। এখন উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে।’
সরকারের তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ৫৪ লাখ ভোটারের মহানগর ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক শান্তিপূর্ণ এবং সুষ্ঠু হয়েছে।
নির্বাচনী প্রচারণার যে আমেজ ছিল তা থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত মানুষ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ভোট দিয়েছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে নির্বাচনী পরিবেশ ভালো ছিল।’
ইভিএম নিয়ে ভোটাররা যেখানে নিজেদের সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সেখানে বিএনপিমনা একটি গণমাধ্যম ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। এবারই প্রথম কোন নির্বাচনে জালভোট বা ভোটকেন্দ্র দখলের কোন অভিযোগ উঠেনি। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে তরুণ ভোটারদের স্বত:স্ফূর্ত উপস্থিতি চোখে পড়ে।
অনেক ভোটকেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা কম থাকলেও তরুণরা নিজ নিজ এলাকায় ছিলের সক্রিয়। তরুণরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন। কেউ কেউ ভোট দেওয়ার পরও কেন্দ্রের আশপাশে ঘোরাঘুরি করেছেন।
সিটি নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরে তারা খুবই খুশি। তবে কথার চেয়ে কাজ বেশি করবেন, এমন প্রার্থীকেই নগরপিতা হিসেবে তারা বেছে নিয়েছেন।
ডিএনসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা কালের আলোকে বলেন, একটি গণমাধ্যমে হাজী মকবুল হোসেন ডিগ্রি কলেজ ভোটকেন্দ্রে ঘুড়ি প্রতীকে জালভোট দেওয়ার হাস্যকর অভিযোগ এনেছেন। এ কেন্দ্রে নারী ও তরুণ ভোটারদের উপস্থিতির সংখ্যা ছিল আশানুরূপ।
তারা বলেন, ওই ভোটকেন্দ্রে ৩ থেকে ৪ জন নারী নৌকা ও ঘুড়ি প্রতীকের ব্যাজ পড়ে ধানের শীষ ও টিফিন ক্যারিয়ার প্রতীকে জালভোট দেওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন। এতে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেন।
মূলত ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে বিএনপি’র বহিরাগতরা ভোট দেওয়ার চেষ্টার সময় প্রতিরোধের মুখে পড়েন।
পরবর্তীতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ওইসব ভোটকেন্দ্রের সামনে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি বাড়ে। তারা শান্তিপূর্ণভাবে পুরো বিষয়টি ট্যাকেল করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সার্বিক সহযোগিতা করেন।
একই সূত্র জানায়, ডিএনসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে ১১ হাজার ৩৮৪ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছেন সৎ, যোগ্য ও আদর্শবান তরুণ প্রার্থী আসিফ আহমেদ। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি’র টিফিন ক্যারিয়ার প্রতীকের প্রার্থী এস.এম. আহম্মাদ আলী পেয়েছেন ৬ হাজার ৭০১ ভোট।
মূলত নিশ্চিত হার জেনে বিএনপি’র টিফিন ক্যারিয়ার প্রতীকের ওই প্রার্থী নানামুখী প্রচার-প্রপাগান্ডা শুরু করেন। আর এ কাজে তিনি একটি চিহ্নিত গণমাধ্যমকে সুকৌশলে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু জনতার রায়ে তার সব কূটকৌশল খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে বলে মনে করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হলেও প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে তরুণ ভোটারদের উপস্থিতিতে উৎসবের আবহ তৈরি হয়। তারা লাইনে দাঁড়িয়ে স্বত:স্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছেন। এসব ভোটারদের অধিকাংশই ছিল প্রথম ভোটার। অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পেরে তারা উচ্ছ্বসিত।
তবে ভোট নিয়ে দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটবে বলেই তাদের যে প্রত্যাশা ছিল সেই প্রত্যাশা হাওয়ায় মিলে গেছে ভোটের ফল ঘোষণার আগেই বিএনপি’র সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বানে।
তরুণ ভোটাররা বলছেন, শিক্ষা ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে তারা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করলেও একটি রাজনৈতিক দল হার স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে না পেরে ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র করছেন।
ভোটারদের তারা ভোটের আগে থেকেই নানাভাবে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। আর এটিই তাদের জন্য হয়ে উঠে ‘অশিনিসংকেত।’ সিটি নির্বাচনে ভোটে দুই মেয়র পদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পাশাপাশি উত্তর ও দক্ষিণেও কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের জয়জয়াকার লক্ষ্য করা গেছে।
তবে সিটি নির্বাচনে ভোটের এই ফলাফল বিএনপি’র সাংগঠনিক অস্তিত্বকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে এমনটি মনে করেন বিশ্লেষকরা।
কালের আলো/এসএ/এমএ