ময়মনসিংহের বেপরোয়া ছিনতাইকারী চক্রকে পুলিশের ‘রেড সিগন্যাল’

প্রকাশিতঃ 12:39 pm | May 14, 2018

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো:

বাড়ি ফেরার জন্য ময়মনসিংহ নগরের পাটগুদাম ব্রিজ মোড় বাসস্ট্যান্ডে যানবাহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী ইব্রাহীম খলিল (২৪)। হঠাৎ করেই তার হাতে থাকা মোবাইল নিয়ে চম্পট দেয় এক চোর। চোরকে ধাওয়া করে একসময় ধরে ফেললেও ইব্রাহীমের বাম উরুতে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় সে।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ইব্রাহীম। ঘটনাটি চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারির।

এর ঠিক সাত দিনের মাথায় নগরের বলাশপুরে এ হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিনতাইকারী গ্রুপের সর্দার নাঈম (২৫) ডিবি পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

মাত্র দু’দিন আগের ঘটনা। মধ্যরাতে বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের শিক্ষক মোবারক মোর্শেদ মিল্কি।

ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত ও কুপিয়ে আহত করে সর্বস্ব লুটে নেয়। ঘটনার পরের দিনেই পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার হওয়ার পর বন্দুকযুদ্ধে মারা যান পেশাদার ছিনতাইকারী সিরাজুল (২৩)।

পৃথক এ দুই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ময়মনসিংহ নগরের বেপরোয়া ছিনতাইকারী চক্রকে ‘লাল বার্তা’ বা ‘রেড সিগন্যাল’ দিয়েছে পুলিশ। এ দুই ছিনতাইকারী ছাড়াও শীর্ষ ছিনতাইকারী আব্দুস সালাম ওরফে কালা মিয়াও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠা ছিনতাইকারীদের রাশ টেনে ধরতে এবং আসন্ন মাহে রমজান ও ঈদে অপ্রতিরোধ্য ছিনতাইকারীদের ঠেকাতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) হালনাগাদ তালিকা প্রস্তুত করে অভিযান শুরু করেছে। এ তালিকায় ওঠে এসেছে প্রায় পাঁচ শতাধিক নাম-ঠিকানা।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আশিকুর রহমান কালের আলো’কে জানান, জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ নুরুল ইসলামের নির্দেশে পেশাদার ছিনতাইকারীদের তালিকা তৈরি করে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। এ তালিকায় থাকা শতাধিক ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে ৫ থেকে ৬টি করে মামলা রয়েছে।

বাকি ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা। তাছাড়া, এ তালিকার বাইরে এমন ছিনতাইকারীও রয়েছেন যারা কখনোই পুলিশের হাতে পড়েনি কিংবা তার নামে কোনো মামলা নেই। এ সুযোগে তারা নানা কৌশলে ছিনতাইয়ের ধরণ পরিবর্তন করে নির্বিঘ্নে অপকর্ম করে যাচ্ছে।

জানা গেছে, সম্প্রতি ময়মনসিংহ নগরীতে ছিনতাইকারীদের কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ায় এসব অপরাধীদের ধরতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে পুলিশ।

এরপরেও সাধারণ মানুষ বা পথচারী তাদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন। মোবাইল টিম বা পোশাকধারী পুলিশের তৎপরতা থাকলেও ছিনতাই ঠেকানো যাচ্ছে না। বড় ধরনের ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রমজানে ঈদের কেনাকাটায় যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি লেনদেন হয়। ফুটপাত থেকে বিপণি-বিতানে জমজমাট হয়ে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্য। কেনাকাটা করতে প্রতিদিন গ্রাম থেকে অনেক মানুষ ময়মনসিংহে আসে। ফলে এ সময়টাকেই টার্গেট করে পেশাদার ছিনতাইকারী চক্র। বিপণি-বিতানের আশেপাশে বা নগরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে সুযোগ বুঝেই শিকার করে এরা।

আবার এ দুই সময় ছাড়াও ছিনতাই স্পট হিসেবে পরিচিত নগরীর পাটগুদাম ব্রিজ মোড়, সানকিপাড়া রেল ক্রসিং, চরপাড়া, কেওয়াটখালী, গাঙ্গিনারপাড়সহ কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫টি পয়েন্টে অবস্থান নেয়।

ছিনতাইকারীরা মধ্যরাতে কিংবা ফজরের নামাজের পরপর ফাঁকা রাস্তায় ওৎপেতে থাকে। এরা টার্গেট করে অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে কিংবা আঘাত করে মানুষজনের সর্বস্ব লুটে নেয়।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তালিকা মতে, নগরীর পাঁচ শতাধিক ছিনতাইকারীর বেশিরভাগই নগরের ‘অপরাধ জোন’ হিসেবে পরিচিত কৃষ্টপুর এলাকার। এর বাইরে শহরতলী দিঘারকান্দা, চর ঈশ্বরদিয়া, গলগণ্ডা, চর জেলখানা, চরপাড়া, ভাটিকাশর, বলাশপুর ও কাশরসহ বিভিন্ন এলাকার ছিনতাইকারী রয়েছে এ তালিকায়।

পুলিশের রেকর্ড মতে, গত দুই বছরে কোতোয়ালী মডেল থানায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ১৮টি। এ সময়টাতে অহরহ ছিনতাই হলেও এতো কম মামলার বিষয়ে জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ছিনতাইকালে কেউ আহত বা নিহত না হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলা হয় না।

ছিনতাইয়ের শিকার মানুষজনই ঝক্কি-ঝামেলা এড়ানোর জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশের শরণাপন্ন হন না। ফলে সহজেই চাপা পড়ে যায় ছিনতাইয়ের ঘটনা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম কালের আলো’কে বলেন, পুলিশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ছিনতাইয়ের ঘটনা অতীতের চেয়ে অনেক কমেছে। ছিনতাই প্রতিরোধ ও জনসাধারণের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ছিনতাই নির্মূলে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। ছিনতাইকারীদের কোনো আস্তানা ময়মনসিংহে থাকবে না।

কালের আলো/এমকে/ওএইচ