ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই: প্রধানমন্ত্রী
প্রকাশিতঃ 5:59 pm | May 17, 2018
বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো:
প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আতঙ্কিত না হতে সাংবাদিকদের পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, সাইবার ক্রাইম নীতিমালা করছি ক্রাইম রোধ করার জন্য। আমি সাংবাদিকদের বলতে চাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সরকার তাদের অসুবিধা হয় এমন কিছু করবে না।
এছাড়া অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা হওয়া উচিত বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।
বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) প্রতিনিধি সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সাংবাদিকদের কল্যাণে সরকার সাধ্যমতো কাজ করছে। আমরা ১২ হাজারের বেশি সাংবাদিককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বিভিন্ন ভাষা শেখা সাংবাদিকদের দায়িত্ব। এজন্য কয়েকটি অ্যাপস চালু করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে গত সাত বছরে সাতহাজারেও বেশি সংবাদপত্র নিবন্ধন পেয়েছে বলে জানান তিনি।
নিজেকে সাংবাদিক পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতাও সাংবাদিকতা করেছেন। যা তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। সে অর্থে আমিও আপনাদের পরিবারেরই একজন সদস্য। দাবি-দাওয়া ছাড়াই আমি সাংবাদিকদের কল্যাণে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমার দেশে ফিরে আসার পর আজ ৩৭ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু প্রেসের কাছ থেকে সহযোগিতা পাইনি। কিন্তু আমি সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কারণ আমি জানি আমি কী করছি। ন্যায় ও সত্যের পথে থাকলে সবই সম্ভব।
‘তবে যারা আমাদের পাশে থেকেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। আশা করি সরকারের অর্জনগুলো দেশের মানুষের কাছে আপনারা তুলে ধরবেন।’
পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের যেসব পত্রিকা নানা কথা লিখেছিল তাদের এখন কী করা উচিত, সে বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছেই প্রশ্ন রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এভাবে লেখাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কি না, সে প্রশ্নও রেখেছেন তিনি।
বাংলাদেশে সংবাদপত্রের বা বাক স্বাধীনতা নেই বলে বিএনপি নেতাদের অভিযোগের জবাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এমনও প্রশ্ন রেখেছেন, স্বাধীনতা না থাকলে তারা কথা বলছেন কী করে?
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে অন্যান্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে এসব নিয়েও কথা বলেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে একাধিকবার পদ্মাসেতুর প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এই সেতুটি আরও কয়েক বছর আগেই চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তোলার পর ঋণচুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা তোলা হয়।
সে সময় বাংলাদেশের মূলধারার বিভিন্ন দৈনিক বিশ্বব্যাংকের সুরেই কথা বলে। বিশেষ করে প্রথম আলো এবং একই মালিকানায় থাকা ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিয়ে নানা ব্যাঙ্গাত্মক লেখার পাশাপাশি সরকারের সততা নিয়েই প্রশ্ন তোলে।
২০১২ সালের ৩০ জানুয়ারি বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের পর এসব লেখনি আরও বাড়ে। এরপর সরকার নিজ অর্থে সেতুর কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও এই দুটি পত্রিকার পাশাপাশি আরও কিছু গণমাধ্যম এর বিরোধিতায় নানা লেখা ছাপে। নিজ অর্থে সেতু করলে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপ নিতে পারবে না বলেও দাবি করা হয় এসব লেখায়।
তবে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ যে বানোয়াট ছিল সেটি প্রমাণ হয়েছে কানাডা আদালতের একটি রায়ে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কানাডার ফেডারেল কোর্টে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে করা এক মামলার রায় আসে। এতে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তোলায় বিশ্বব্যাংকের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেন বিচারক। এই অভিযোগ ‘গালগপ্প’ ছিল জানিয়ে বিচারক বলেন উড়োকথার ভিত্তিতে এই মামলা করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সে সময় বিভিন্ন পত্রিকার লেখনির কথা স্মরণ করিয়ে বলেন, ‘পদ্মাসেতু নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছিল, কত পত্রিকায় এটা হয়েছে, ওটা হয়েছে বলে লিখেছিল। কিন্তু কী দুর্নীতি প্রমাণ হয়েছে? যারা এ সমস্ত কথাগুলো লিখেছিল, তদের কী করা উচিত আপনারাই এখন চিন্তা করে দেখুন। এটাই কি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা?’
‘আমি তো চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম, কিসের দুর্নীতি প্রমাণ করতে হবে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রমাণ করতে পারেনি। ফেডারেল কোর্ট, কানাডা নিজেরাই বলেছিল, এটা সব বানোয়াট কথা। আমি যেটা বলেছিলাম সেদিন সেটাই সত্য হয়েছিল। তারপর আমরা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকা না, নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু বানাচ্ছি।’
এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থানটা ঘুরে গেছে বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘এটা আপনাদের বুঝতে হবে। আগে মনে করত, বাংলাদেশ একটা দরিদ্র দেশ, হাত পেতে চলবে। আমরা কেন হাত পেতে চলব। আমাদের মধ্যে কেন এই আত্মবিশ্বাস থাকবে না?’
‘গণমাধ্যম বরাবর আমার প্রতি বৈরী’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ছয় বছর পর ১৯৮১ সালে আজকের দিনে দেশে ফিরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ৩৭ বছরে প্রেসের কাছ থেকে কখনও খুব বেশি সহযোগিতা পাননি বলেও অনুযোগ করেন তিনি। বলেন, ‘সব সময় একটা বৈরিতা নিয়েই আমাকে এগুতে হয়েছে। সমালোচনার মুখোমুখি হয়েই আমাকে এগুতে হয়েছে।’
‘কিন্তু সমালোচনা নিয়ে আমি কখনও মাথা ঘামাই না। আমি জানি আমি কী কাজ করছি। ন্যায় ও সত্যের পথে থাকলে, সৎ পথে থাকলে ফলাফল পাওয়া যায়, এটা আমি বিশ্বাস করি।’
২০০১ সালে নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সারাদেশে যে অত্যাচার-নির্যাতন করেছিল সেগুলো বেশ কিছু গণমাধ্যমে আসেনি। বিশেষ করে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার কয়েক মাস সেগুলো চেপে যায়।
এই বিষয়টির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকেই বিএনপির অত্যাচার নির্যাতনের কথাটা লিখতে চায়নি। এমনও বলেছে তিন মাসের সময় দেয়া উচিত। তিন মাসে মেরে সব সাফ করে দিক। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলা, চোখ তুলে ফেলা, বাড়ি দখল করা, কী না করেছে?’
‘অনেকে সাহসিকতার সাথে সংবাদ দিয়েছে। যারা দিয়েছে তাদেরকে ধন্যবাদ, যারা দেয়নি তাদেরকে করুণা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
প্রথম আলো ও ডেইলিস্টারের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুটি পত্রিকা আমি পড়িও না, রাখিও না, গণভবনে ঢোকা নিষেধ। দরকার নাই আমার। ওই সার্কাসের গাধার মতো যারা বসেই থাকে দড়ি ছিঁড়বে কবে আর পতাকা পাবে কবে, যাদের দিয়ে আমার দেশের জন্য কল্যাণকর কাজ হবে না, তাদের আমার দরকার নাই।’
প্রধানমন্ত্রী তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, বিএফইউজের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু জাফর সূর্য প্রমুখ এই সম্মেলনে যোগ দেন।
কালের আলো/এমডিআর