স্বাধীন ফিলিস্তিন কত দূর?
প্রকাশিতঃ 11:09 pm | May 18, 2018
:: সোহেল রানা ::
ইসরাইল এখনও তার মানচিত্র ঠিক করেনি, এ নিয়ে ইহুদি নেতাদের কোনো গরজও নেই। নিজেদের ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিরা বিতাড়িত হবেন, তারপর সেখানে ইহুদি সেটেলাররা হুমড়ি খেয়ে পড়বে এই অবৈধ কর্মটাই এখন সেখানকার রুটিন ওয়ার্ক! কেবল পূর্ব জেরুজালেমেই দুই লাখ ইহুদির বসবাসের জন্য বসতি গড়ে তোলা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ। এই জায়গাটি তারা দখল করেছিল ১৯৬৭ সালের তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময়।
এভাবে দখল-বেদখলেই স্ফীত হচ্ছে ইসরাইলের মানচিত্র। ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইনের (ফিলিস্তিন) প্রায় ৭৮ শতাংশ জায়গা নিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৯২ শতাংশের মতো। ইহুদি নেতারা বিশ্বাস করেন, নীল নদ থেকে শুরু করে ফোরাতের (ইউফ্রেটিস) মধ্যবর্তী যে ভূখণ্ড আছে পুরোটাই তাদের; আর এই ভূখণ্ডকেই তারা বলছেন ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ বা প্রমিজল্যান্ড। ভয়ংকর এই দাবি থেকে যদি তারা সরে না যান, তাহলে বর্তমান ইসরাইলের বাইরেও ইহুদি এলাকা বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বাদবাকি ফিলিস্তিন, মিসর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক এমনকি সৌদি আরবের একটা অংশেও!
প্রথম (১৯৪৮) ও তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ (১৯৬৭) এবং লেবাননে ইসরাইলি হস্তক্ষেপ ঘিরে ১৯৮২ সালের সীমিত যুদ্ধে যে জায়গা ইহুদিরা আরবদের কাছ থেকে দখল করতে পেরেছে, তাতে ইসরাইলের মানচিত্র কয়েকগুণ বেড়েছে। এর বাইরেও আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষুদ্র ও সীমান্ত লড়াই হয়েছে ইসরাইলের। এসব যুদ্ধে যে ভূখণ্ড তারা দখল করতে পেরেছে তার সামান্য অংশই পরে প্রকৃত মালিক তথা আরব রাষ্ট্রগুলোকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। ইসরাইল ১৯৬৭ সালে মিসরের সিনাই উপদ্বীপ দখল করলেও পরে জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে তা ফেরত দেয়। কিন্তু সিরিয়ার গোলান মালভূমি কিংবা জেরুজালেম সেই ’৬৭ সাল থেকেই দেশটির দখলে আছে। ১৯৭৩ সালে সিরিয়া ও মিসর ইয়ুম কিপুরের যুদ্ধে (এটি চতুর্থ আরব-ইসরাইল যুদ্ধ নামেও পরিচিত) ’৬৭-তে হারানো ভূখণ্ড উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
ইহুদিদের দাবি অনুযায়ী, ইসরাইল রাজা ডেভিডের [হজরত দাউদ (আ.)-কে ইহুদিরা রাজা ডেভিড বলে থাকে] কল্পিত ভূখণ্ড এখনও উদ্ধার হয়নি। ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধের তৃতীয় দিনে ইসরাইলি পার্লামেন্ট নেসেটে দেওয়া ভাষণে বেন গুরিয়ন বলেছিলেন, ‘তাদের লক্ষ্য হচ্ছে বাইবেলে রাজা ডেভিড এবং সলোমানের যে রাজ্যের সীমানা উল্লেখ করা আছে তা পুনরুদ্ধার করা।’
এ বছরের এপ্রিলে (১৯ এপ্রিল) প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পালন করেছে ইসরাইল, যদিও তারা স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়েছিল ১৪ মে প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হওয়ার ঠিক আগের দিন। ১৫ মে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার দিনটি ফিলিস্তিনিরা পালন করে ‘মহাবিপর্যয়’ বা ‘নাকবা’ দিবস হিসেবে। ১৯৪৮ সালের নাকবাতে সাড়ে সাত লাখের মতো ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়। পাঁচশ’র মতো ফিলিস্তিনি গ্রাম হয় ধ্বংস করা হয়েছে, আর না হয় প্রকৃত বাসিন্দাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ’৪৮-এর মে মাস থেকে ’৫১ পর্যন্ত তিন বছরে সাত লাখ ইহুদি সেটেলার প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে নতুন করে বসবাস শুরু করে। বর্তমানে ইসরাইলের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন ফিলিস্তিনি পালিয়ে ইসরাইলে থেকে যেতে পেরেছেন, কিন্তু নিজেদের ভিটেমাটিতে তাদের সবাই ফিরতে পারেননি। এরকম ফিলিস্তিনির সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৭ লাখের মতো। তারা বসবাস করছেন ইসরাইলের বিভিন্ন ক্যাম্পে। এর বাইরে লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও ইসরাইল অধিকৃত গাজা ও পশ্চিম তীরের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করছেন। ইসরাইলের অভ্যন্তরে যেসব ফিলিস্তিনি রয়েছেন, কিছু ব্যতিক্রম বাদে তারা ইসরাইল ভূখণ্ডের বাইরে যারা আছেন তাদের মতোই দিনযাপন করছেন।
ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে মিথোলজি, কল্পকাহিনি আর জোরজবরদস্তির ভিত্তিতে। না ধর্ম, না জাতিসত্তা, না ইতিহাস কোনোভাবেই ইসরাইলি দখলদারিত্ব বৈধ হয় না। ইহুদিরা বলে আসছে, তারা ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত (ইহুদি ধর্মগ্রন্থ) সেই জাতিগোষ্ঠীর সরাসরি উত্তরাধিকার, যারা মিসর থেকে সিনাই হয়ে কেনানে ফিরে এসেছিল এবং তারাই ঈশ্বরের ‘মনোনীত সম্প্রদায়’! কিন্তু মোজেশ বা মোশি [হজরত মুসা (আ.)-কে ইহুদিরা এই দুই নামে ডাকত] তাঁর অনুসারীদের নিয়ে কেনানে ফিরতে পারেননি, জর্ডান নদী অতিক্রম করার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। আর এজন্যই ইহুদি ধর্মকে অসম্পূর্ণ একটি ধর্ম হিসেবে দেখা হয়।
১৮৯৬ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিক থিওডর হার্জেল ‘ঞযব ঔবরিংয ঝঃধঃব’ নামে একটি বই লেখেন। এতে তিনি একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। প্রস্তাবনায় হার্জেল মূলত ইউরোপীয় ইহুদিদের জন্য স্বাধীন ভূখণ্ডের কথা বলেছেন (রাষ্ট্র শব্দটি ব্যবহার করেননি), অথচ তিনি চান এই ভূখণ্ড হবে প্যালেস্টাইনে, ইউরোপে নয়! হার্জেলের এমন বিপজ্জনক ঔপনিবেশিক পরিকল্পনা মূলত কতগুলো মিথের ওপর ভর করে নেওয়া হয়েছে। এই ব্যক্তিকেই আধুনিক জিয়নিজমের প্রবক্তা বলে মানে ইহুদিরা। ইসরাইল-সমর্থিত ইতিহাসবিদ ব্যানি মরিস ‘রাইটাস ভিকটিমস’ নামে একটি বই লিখেছেন, যেখানে তিনি দাবি করেছেন, হার্জেল কোনো ধরনের লোভ থেকে ইহুদিবাদ প্রতিষ্ঠা করেননি, এটা তিনি করেছেন গোটা ইউরোপে ইহুদিদের ওপর যে নিপীড়ন-নির্যাতন চলছিল তার সমাধান টানার জন্য। তবে মরিস সে সময়েই বলেছিলেন, ‘ইহুদি একত্রীকরণের চেষ্টা সমস্যার সমাধান করবে না, কারণ বিশ্বের অ-ইহুদিরা তা মেনে নেবে না।’ লেখকের মতে, ইউরোপজুড়ে ইহুদিদের ওপর যে নির্যাতন-নিপীড়ন চলছিল, এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ‘প্রতিশ্রুত ভূখণ্ডে’ তাদের ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।
বাইবেল অনুসারে ১৩৬ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা তাড়িয়ে দেওয়ার আগে প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে বসবাস করত ইহুদিরা। খ্রিস্টের জন্মের এক হাজার ৪০০ বছর আগে থেকেই ইসরাইলের বংশধররা [ইহুদিরা হজরত ইয়াকুব (আ.)-কে ইসরাইল বলে থাকে] সেখানে বসবাস করে আসছে বলেও দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন খোদ একজন ইহুদি শিক্ষাবিদ ও লেখক। তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক স্লোমো স্যান্ড তার ‘দ্য ইনভেনশন অব জুয়িশ পিপল’ ও ‘দ্য ইনভেনশন অব দ্য ল্যান্ড অব ইসরাইল’ নামক দুটি বইয়ে জায়নবাদীদের এসব দাবিকে ভুয়া প্রমাণ করেছেন। তিনি দাবি করেছিলেন, এখনকার ফিলিস্তিনিদের মধ্যেই আদি বনি ইসরাইলের বংশধরদের রক্ত বেশি প্রবাহিত, আর ফিলিস্তিনিরাই হলো মুসলমান হওয়া আদি ইহুদি। তার মতে, যিশুও ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি যুবক। রোমানরা ইহুদিদের তাড়িয়ে দেওয়ার পর সেখানে আরবরা বসবাস করতে শুরু করে। একসময় এ এলাকা অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তাদের নিযুক্ত আরব শাসকদের দ্বারা অঞ্চলটি শাসিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমানদের পতন হওয়ার আগ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকে।
এ সময় ব্রিটিশরা আরব, ফিলিস্তিনি ও ইহুদিদের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের হয়ে লড়াইয়ের আহ্বান জানায় এবং অটোমান নিযুক্ত আঞ্চলিক শাসকদের (গভর্নর) সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্ররোচনা দেয়। তাই ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ঘিরে যে সংঘাত-সংঘর্ষ চলছে তাতে ব্রিটিশদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ২০০২ সালে ডিউক ইউনিভার্সিটির সাবেক বিজনেস প্রফেসর Bernard Avishai ÔThe Tragedy of Zionism: How its Revolutionary Past Haunts Israeli Democracy নামে একটি বই লেখেন, যেখানে তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেন, বিশ্বজুড়ে ইহুদিবাদ আন্দোলনের পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন প্রসারে বেলফোর ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। লেখক বিশ্বাস করেন, ব্রিটিশরা ইহুদিদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল, কারণ তারা অটোমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের সেনাদের প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে রাখতে চেয়েছিল। তাই বেলফোর ঘোষণাকে ইহুদিরা নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখলেও আরবরা দেখেছিল ব্রিটিশদের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে। এ ঘোষণার দু’বছর আগে ব্রিটিশরা আরবদের কথা দিয়েছিল, তারা যদি অটোমানদের হটাতে ব্রিটিশদের সহায়তা করে তাহলে প্যালেস্টাইন ভূখণ্ড তাদেরই থাকবে। লেখক বলেন, আরবরা শেষ পর্যন্ত কথা রেখেছিল, কিন্তু ব্রিটিশরা রাখেনি। বেলফোর ঘোষণার পর ইহুদি নেতা ডেভিড বেন গুরিয়ন বলেছিলেন, Zionist claims to the existence of a Jewish nation and has acknowledged the Zionist right to settle in the whole of Palestine.
লিগ অব নেশনস থেকে প্যালেস্টাইন শাসনে ব্রিটিশরা যে ম্যান্ডেট পেয়েছিল, তার অবসান হওয়ার কথা ছিল ১৫ মে, ১৯৪৮ সালে। কিন্তু এই ম্যান্ডেট অবসানের আট ঘণ্টা আগেই ১৪ মে বিকাল ৪টায় ইহুদি জাতীয় প্রশাসনের প্রধান ও ওয়ার্ল্ড জিয়নিস্ট অরগানাইজেশনের নির্বাহী প্রধান বেন গুরিয়ন (পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী) ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র পাঠ শুরু করেন। মাত্র ১৬ মিনিট স্থায়ী হয় সেই অনুষ্ঠান। ঘোষণার ১১ মিনিটের মধ্যেই মার্কিন প্রশাসনের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেন হ্যারি ট্রুম্যান। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিক্রিয়ায় সম্মিলিত আরববাহিনী ইসরাইল অভিমুখে হামলা চালায়, যাতে আরববাহিনীই পরাজিত হয়। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় আরব নেতাদের মধ্যকার অনৈক্য ও আন্তঃকোন্দলকে। তারা ইসরাইলি বাহিনীকে হটাতে চেয়েছিল সত্য, একই সঙ্গে গাজা, পশ্চিম তীর আর জেরুজালেমকে দখলে নেবেন এ নিয়েও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন তারা।
১৯৪৮ সালের ১৫ মে’র প্রথম প্রহরে প্যালেস্টাইনে সংঘাত জিইয়ে রেখে হাইফা বন্দর দিয়ে বিদায় নেন প্যালেস্টাইনে সবশেষ ব্রিটিশ হাইকমিশনার কানিংহ্যাম। সেই যে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য ঝুলল, তার আর পরিবর্তন হয়নি। আরবরা সম্মিলিত জোট করে চার-চারটি যুদ্ধ করেও ইসরাইল রাষ্ট্র গুঁড়িয়ে দিতে পারেনি। উল্টো প্রায় নিয়ম করেই ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা। আরব লিগ হলো, ওআইসি হলো, কিন্তু ফিলিস্তিনিরা আর নিজেদের ভূখণ্ডে ফিরতে পারল না। এই লেখাটি যখন লিখছি তখনও জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থাপন নিয়ে গাজা সীমান্তে অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইলি বাহিনী।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
sohel.shalbanÑgmail.com
কালের আলো/ওএইচ
** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে কালের আলো’র ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: KalerAlo/Facebook