বাংলাদেশের বাণিজ্যে করোনার প্রভাব

প্রকাশিতঃ 10:19 am | March 10, 2020

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ববাণিজ্যে তো বটেই, প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশেও। চীন থেকে এখনো কাঁচামাল আমদানী সেভাবে শুরু না হওয়ায় তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী বিভিন্ন খাতের পণ্য উৎপাদন নিয়ে দু:শ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি হয় এমন দেশগুলোতেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় রপ্তানিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা তৈরি হয়েছে।

কিন্তু করোনার কারণে ঠিক কতটা সংকটে পড়তে পারে এদেশের বাণিজ্য? রাজধানী উত্তরার কাছে নলভোগ এলাকা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রপ্তানির আগে প্যাকিংয়ের জন্য কাঁকড়া এবং কুঁচে মাছ আনা হয় এখানে। এয়ারপোর্টের কাছেই এই এলাকায় প্রায় ৬০টির মতো কাঁকড়া ও কুঁচে প্যাকিং সেন্টার গড়ে উঠেছে।

কিন্তু বর্তমানে মাত্র ১০-১২টি সেন্টার চালু রয়েছে। বাকি সব বন্ধ। যেগুলো চালু আছে সেগুলোতেও কাঁকড়া নেই বললেই চলে। কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান গাজী আবুল কাশেম জানান, জানুয়ারির ২০ তারিখ থেকে এই অবস্থা। কারণ কাঁকড়া ও কুঁচের ৯০ শতাংশই রপ্তানি হয় চীনে। সে দেশের ক্রেতারা কেনা বন্ধ করাতে এখন তাদের রপ্তানি বন্ধ।

আবুল কাশেম বলেন, ‘বছরে আমাদের রপ্তানির বেশিরভাগটাই হয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে। চীনা নববর্ষের কারণে এর চাহিদা বেশি থাকে। আমাদের ব্যবসায়ীরা প্রায় চারশ কোটি টাকার কাঁকড়া ও কুঁচে রেডি করে রেখেছিল। সব নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা অনেকেই মূলধন হারিয়ে ফেলেছেন। এখান থেকে সরকারি অর্থ সাহায্য ছাড়া ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।’

বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের বিবেচনায় কাঁকড়া ও কুঁচে খাত হয়তো বড় কিছু নয়। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছেন। এটা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ চীন থেকেই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্যগুলোর কাঁচামাল আমদানি করা হয়।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান তপন কান্তি ঘোষ জানান, ‘করোনার কারণে এরইমধ্যে চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি কমেছে। গেল অর্থবছরের ডিসেম্বর-জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত মোট ৭৫ দিনের সঙ্গে চলতি অর্থবছরের একই সময়ের ৭৫ দিনের আমদানি তথ্য মিলিয়ে ট্যারিফ কমিশন বলছে, চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি কমে যাবার পরিমাণ ১৫ শতাংশ।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, চীন থেকে যদি সারাবিশ্বে কাঁচামাল রপ্তানি ২ শতাংশও কমে যায়, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতি হবে ৫০ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশে ক্ষতি হবে ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

এর মধ্যে তৈরি পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি। এর আগে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে রপ্তানির ১৩টি খাতকে চিহ্নিত করেছে, যেগুলো করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতির মধ্যে পড়তে পারে। বলা হয়েছে, এসব খাতে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

খাতগুলোর মধ্যে আছে প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এছাড়া ওষুধ শিল্প, পাট সুতা, ইলেক্ট্রনিক্স, সামুদ্রিক মাছ, প্রসাধনী ইত্যাদি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এসব খাতের পণ্য উৎপাদনের জন্য কমবেশি নির্ভর করেন চীন থেকে আনা কাঁচামাল কিংবা যন্ত্রাংশের উপর। এর মধ্যে সবার আগেই আছে বাংলাদেশের রপ্তানির মূল খাত তৈরি পোশাক।

কারণ ইতোমধ্যেই এই খাতের অনেক কারখানা কাঁচামালের সংকটে পড়েছে কিংবা পড়তে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ফলে এ খাত যদি সংকটে পড়ে তাহলে দেশের পুরো রপ্তানি খাতই সংকটে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিজিএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদ জানান, তার নিজের পোশাক কারখানাতেই চীন থেকে কাঁচামালের কয়েকটি চালান আটকে গেছে। যেগুলো ফেব্রুয়ারির শুরুতেই আসার কথা ছিল। তিনি বলেন, ‘বেশ কিছু কারখানাতেই কাঁচামালের সংকট তৈরি হচ্ছে। ক্রেতাদেরকে বিলম্বিত শিপমেন্টের সম্ভাব্য সময় জানানো হচ্ছে, কেউ রাজি হচ্ছে নিতে, কেউ হচ্ছে না। সুতরাং আমরা ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।’

কাঁচামালের অভাবে যখন পণ্য উৎপাদন নিয়ে সংশয় তখন পণ্য উৎপাদনের পর সেটা রপ্তানি নিয়েও সতর্ক থাকতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। কারণ চীনের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী করোনার বিস্তারে পর্যটন এবং কেনাকাটার পরিমাণ কমে আসছে। ফয়সাল সামাদ বলেন, ইতালিতে যে তৈরি পোশাকের অর্ডার কমবে বা বাতিল হবে তার কিছু সিগন্যাল তারা ইতোমধ্যেই পেয়েছেন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা