করোনা মোকাবেলায় সরকার কতটা প্রস্তুত, জানালেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব
প্রকাশিতঃ 10:06 am | March 24, 2020
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সর্বোচ্চ কঠোর হয়েছে সরকার। ভয়ানক এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয়ভাবে ১০ দিন গণছুটিসহ ১০ দফা গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন। পাশাপাশি এই ভাইরাসের ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’ রুখে দিতে কার্যকর নানা পদক্ষেপও গ্রহণ করেছেন।
গোটা বিশ্বের মতো করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের কী প্রস্তুতি এবং কতটুকু মনোবল দরকার সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড.আহমদ কায়কাউস।
সোমবার (২৩ মার্চ) সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের সামগ্রিক প্রস্তুতির বিষয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন তিনি। তার এই বক্তব্যে উঠে আসে দেশের মানুষের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভালোবাসা, সরকারের প্রস্তুতি, ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি, গার্মেন্টস সেক্টরসহ নানা দিক।
এ সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম, তথ্য সচিব কামরুন নাহার, জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সবার সঙ্গে আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী
চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার সঙ্গে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড.আহমদ কায়কাউস। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস জাতীয় নয়, এটি একটি বৈশি^ক প্রাদুর্ভাব। এটি কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সেজন্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রটোকল অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এটি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সরকারের সমস্ত কিছু যুক্ত হয়েছে। চীনের উহানে এই প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমাদের দেশে এ নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ হচ্ছে।
সরকার প্রস্তুত কীনা?
মনের মধ্যে উৎকন্ঠা কিছুটা লাঘব করে কীভাবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবেলা করবো এখন সেই সময় এসেছে-এমন মন্তব্য করেন ড.আহমদ কায়কাউস। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই মুখ্য সচিব বলেন, ‘সরকার প্রস্তুত কীনা এটা বিভিন্ন সময় প্রশ্ন আসে। এটা ব্যাখ্যা করতে চাই।
গত ২০ মার্চের আপডেট অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯৫ টি দেশের মধ্যে ১৭৪ টি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে জাতীয়, বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি করা হয়েছে। হেলথের ফোর ফ্রন্টের সঙ্গে বেসামরিক, সামরিক প্রশাসন, পুলিশ বাহিনীর সদস্য ও সর্বোপরি জনপ্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত রয়েছেন। সর্বক্ষেত্রে এটাই আমরা পর্যালোচনা করছি।’
আপডেট নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ কনসার্ন রয়েছেন বলে জানান মুখ্য সচিব। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এতোটা কনসার্ন থাকেন যে তিনি সব সময় ডিপার্টমেন্ট ওয়াইজ ডেকে ডেকে আপডেট নেন। সেই মোতাবেক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজকে (২৩ মার্চ) সেনাপ্রধানের সঙ্গে বসে আমাদের সঙ্গেও বসেছেন। স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিনিয়ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রটোকল মেইনটেইন করে চলেছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মহোদয় ও আমি জেলা ও বিভাগ পর্যায়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মনিটরিং করছি সব সময়।’
বাংলাদেশের ন্যাশনাল স্ট্রাটেজি কী হওয়া দরকার?
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এই পর্যায়ে বলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গ্রাম পুলিশকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আমাদের ন্যাশনাল স্ট্রাটেজি কী হওয়া দরকার? আমরা প্রায় সময়েই শোনি লক ডাউন। আপনি যদি কোন হেলথ প্রফেশনালকে জিজ্ঞাসা করেন এটা কোন সাইন্টিফিকেলি শব্দ নয়। মূল বিষয় সামাজিক দূরত্ব। সরকার এই বিষয়ে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়ে সব সময় কাজ করেছে।
নারায়ণগঞ্জে ৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারাও ভালো হয়ে গেছেন। আমাদের পজেটিভ সাইড হচ্ছে অতি দ্রুত ভালো হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশ কিন্তু এটা তৈরি করতে পেরেছে। প্রথম যিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন তিনি ৭০ বছরের ওপর। সবল কোন মানুষ হলে তাকে সুস্থ করে তোলার সক্ষমতা আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে।
প্রত্যেকের উচিত সম্মিলিত মনোবল বৃদ্ধি করা
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দেশের চিকিৎসকদের সেবা-পরিশ্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেন মুখ্য সচিব ড.আহমদ কায়কাউস। তিনি বলেন, ‘আমাদের ডাক্তার সাহেবরা দিন-রাত পরিশ্রম করছেন। নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের প্রত্যেকের উচিত তাদের সম্মিলিতভাবে মনোবল বৃদ্ধি করা।
তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা। যেটা আমাদের সরকারি দপ্তর, বেসরকারি এমনকি এনজিও প্রতিনিধিরাও আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এখন সময় এসেছে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে কাজ করার। আমাদের সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রীর কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার জনগণ
আমাদের কিন্তু সর্বদিকে হোম মিনিস্ট্রির পুলিশ বাহিনী, আনসার বাহিনী সবাই একযোগে কাজ করছেন, জানান মুখ্য সচিব। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা নিরলস কাজ করছেন। আমাদের সহযোগিতা করছেন। আমি যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তাই বলতে চাই, জনগণের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত কথা বলেছেন।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে এমনকি প্রধানমন্ত্রী মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করে ২৬ মার্চের অনুষ্ঠান বাদ দিয়েছেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে তিনি যে পুস্পস্তবক প্রদান করে থাকেন সেটা তিনি বাতিল করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার জনগণ।
তাই এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা প্রতিহত করতে সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একযোগে কাজ করলে আমাদের প্রত্যাশা সফল হবে। অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় আল্লাহ আমাদের ভালো রেখেছেন।
আরও একটি জিনিস বলে রাখি, প্রধানমন্ত্রীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ তৎপরতার মনিটরিং সেল ২৪ ঘন্টা চালু রয়েছে। আপনারা তথ্য দিলে মনিটরিং আরও জোরদার করবো। সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে কাজ করবো। আমাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন বাদ দিয়ে স্বাধীনতা দিবসের স্পিরিটে আমাদের দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারবো।
লক ডাউন ইটস নট অ্যা সাইন্টেফিক ওয়ার্ড
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, ‘লক ডাউন ইটস নট অ্যা সাইন্টেফিক ওয়ার্ড। এটা কমন একটি ওয়ার্ড হয়ে গেছে। গণপরিবহন ছুটির সময় সীমিত আকারে চালু থাকবে। দুইদিন যখন ছুটি থাকবে না তখন সীমিত আকারে থাকবে। গণপরিবহন বন্ধ হচ্ছে না।
কেউ যদি গ্রামের বাড়িতে বা শহরে থাকে তার চলাচলের প্রয়োজন হতে পারে। এজন্য গণপরিবহন বন্ধ করা হবে না। সবাইকে বাড়িতে থাকার কথা বলা হয়েছে। সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আমি এবং আপনি সবার সচেতন থাকার দায়িত্ব রয়েছে। গণপরিবহন সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষজনের ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে। সাবধানতা থাকলে ইনফেকশন বহন করা বা ছড়িয়ে দেওয়ার রিস্কটা সীমিত করতে পারি।
সরকারের ক্লোজ মনিটরিংয়ে গার্মেন্টস
‘গার্মেন্টস কারখানা বন্ধের বাধ্যবাধকতা নেই’ এক প্রশ্নের উত্তরে এমনটিই বলছিলেন ড.আহমদ কায়কাউস। তিনি বলেন, ‘গার্মেন্ট কারখানাগুলো সরকারের ক্লোজ মনিটরিংয়ের মধ্যে রয়েছে। তাছাড়া এগুলো পিপিই তৈরির কাজও করছে। গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকরা বাসা থেকে কারখানায় যায়, আবার বাসায় ফিরে যায়।
তারা ঝুঁকির মধ্যে নেই। এখন যদি কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে কেউ যদি আক্রান্ত হন তাহলে সেই ব্যক্তির মাধ্যমে আরও লোক আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’
২৪ মার্চ থেকে না দিয়ে ২৬ মার্চ থেকে কেন ছুটি দেওয়া হলো জানতে চাইলে মুখ্য সচিব বলেন, ‘আজ ও আগামীকাল দুই দিন সময় দেওয়া হয়েছে যাতে লোকজন তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে পারে। এরপর যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে যাবে।’
কালের আলো/এসএকে/এমএস