দেশজুড়ে স্বাস্থ্য সেবাতেও এখন ভরসার নাম সেনাবাহিনী

প্রকাশিতঃ 10:15 am | April 05, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

‘সবার ভালোর কথা ভাইবা একলা রয়, ঘরে একলা রয়’ কন্ঠশিল্পী মমতাজের জনপ্রিয় একটি গান এখন মানুষের মুখে মুখে। এ গানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ঘরের ভেতর বন্দি থাকাই রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন: সহায়তায় আর্মি এভিয়েশন; আকাশপথে সেনা সদস্যদের হাতে যাচ্ছে মেডিকেল সরঞ্জামাদি

গোটা দুনিয়ার মতোই বাংলাদেশেও মানুষ মানুষ থেকে এতো দূরত্ব বজায় রাখেনি কখনও। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস গোটা দুনিয়ার মানুষ ও অর্থনীতির জন্য নিয়ে এসেছে চরম বিপর্যয়।

আরও পড়ুন: সামাজিক দূরত্ব বজায়ে কঠোর সেনাবাহিনী, বদলে গেছে দৃশ্যপট (ভিডিও)

জাতীয় জীবনে কঠিন এমন অন্ধকারে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য দেশজুড়ে কঠোর হয়েছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী।

আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বে এক মোহনায় দেশ, মানুষকে ‘সুরক্ষার যুদ্ধে’ সেনাবাহিনী

সড়কে সড়কে টহল দিয়ে সাধারণ মানুষকে যেমন সতর্ক করছেন তেমনি ‘সঙ্গনিরোধ’ নিশ্চিতেও তেড়েফুড়ে না ছুটে ইতিবাচক পদক্ষেপে জয় করেছেন দেশের মানুষের হৃদয়।

আরও পড়ুন: করোনার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত যুদ্ধে সেনাবাহিনী, সেনাপ্রধানের বক্তব্যে আশার সঞ্চার

দেশের প্রতিটি জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোর বাজার, পাড়া-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিবিষ্টমনে কাজ করছেন।

আরও পড়ুন: প্রখর খরতাপেও পথে পথে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সেনাবাহিনী (ভিডিও)

শুধু কী তাই? করোনার সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার অজুহাতে যখন রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মিলছে না চিকিৎসা সেবা।

চরম ভোগান্তির মুখে পড়ে কষ্ট আর ক্ষোভের অনলে পুড়তে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের। ঠিক এমন সময়েও বিপদে শেষ ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

আরও পড়ুন: প্রকৃতিতে ফিরেছে প্রাণ, আতঙ্ক নয় প্রতিরোধের ডাক সেনা সদস্যদের (ভিডিও)

বুধবার (০১ এপ্রিল) করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলা ও দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এই করোনাভাইরাসকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

আরও পড়ুন: বৃত্তের মাধ্যমে দূরত্ব চিহ্নিত; সেনাবাহিনীর কর্মযজ্ঞে দেশজুড়ে স্বস্তির সুবাতাস (ভিডিও)

আমরা সৈনিক, আমরা সব সময় যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং সেই প্রস্তুতি নিয়ে আমরা আছি। সবাইকে সহযোগিতা করবো।’  

রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়, সাভার, লালমনিরহাটসহ দেশের প্রতিটি এলাকাতেই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে সেনা সদস্যরা। দেশপ্রেম আর মানবিকবোধ থেকেই মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নিজেরা বিনামূল্যে ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন।

আরও পড়ুন: সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বেচাবিক্রি, অনুসরণ হচ্ছে ‘সেনাবাহিনী মডেল’ (ভিডিও)

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশে তাদের এ সামাজিক কার্যক্রম ‘সিমিক’র সুনাম রয়েছে। নিজেদের চিরায়ত সেই ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটছে এবার দেশের প্রতিটি এলাকায়।

এতে করে চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত প্রতিটি মানুষের আস্থা আর ভালোবাসার অপর নাম হয়ে উঠেছেন সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরা। সবাই একবাক্যে সেনা চিকিৎসকদের আন্তরিকতায় নিজেদের সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সেবা পাচ্ছে না রোগীরা, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে একই চিত্র
করোনাভাইরাসের ভয়ঙ্কর প্রভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের বেশিরভাগ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে নুন্যতম সেবাও পাচ্ছে না সাধারণ রোগীরা। করোনার উপসর্গের সঙ্গে নুন্যতম মিল না থাকলেও রোগী ভর্তি অথবা চিকিৎসাসেবা দিতে চরম অনীহা প্রকাশ করছেন চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।

গত ক’দিন সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর গ্রিনরোড, পান্থপথ, মগবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় এই তো ক’দিন আগেও চিকিৎসকদের রাত অবধি রোগী সামলাতে হিমশিম খেতে হতো। এখন এসব হাসপাতালে সুনসান নীরব পরিবেশ। নেই নিরাপত্তারক্ষীদের হুইসেল বা গাড়ির জটলা।

চিকিৎসকরাও নিজেদের চেম্বার বন্ধ করে বাসায় অবস্থান করছেন। হাসপাতালের মূল ফটকেও ঝুলছে তালা। ভেতর থেকেও সাইনবোর্ডে জায়গা করে নিয়েছে ‘ক্লোজ’ শব্দটি। প্রায় অভিন্ন চিত্র রাজধানীর সরকারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব  মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম হাসপাতাল ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেও।

ভয়ঙ্কর এমন চিত্র রাজধানীর বাইরের সরকারির হাসপাতাসমূহেও। খুলনায় চারটি হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে রিফাত নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যুর খবরটি এখন ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’।

জ্বর, সর্দি-কাশির রোগীর বাইরে হৃদরোগ কিংবা কিডনি রোগে ভুগলেও মিলে না চিকিৎসা। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে করতেই বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

ইতোমধ্যেই এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও প্রাইভেট চেম্বারগুলোর বিষয়ে কড়া বার্তা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। রোগীরা সেবা না পেয়ে ফিরে গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

চিকিৎসা বঞ্চিত বিপন্ন মানুষের পাশে সেনাবাহিনী
দেশের প্রতিটি দুর্যোগে-দু:সময়ে সাধারণ মানুষের ‘প্রাণভ্রোমরা’ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সব সময় বলে আসছেন, ‘দুর্যোগ মোকাবেলাসহ সব কাজে সুনাম অর্জন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। শুধু সামরিক অফিসার হিসেবে নয়, মানবিক গুণাবলীর কারণে বাংলাদেশের সেনারা মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে।’

বাঙালি জাতির এমন সংকটময় মুহুর্তেও নিজেদের জীবনের কথা না ভেবে, নিজেদের পরিবার-স্বজনদের মায়া পেছনে ফেলে অন্ধকারে আশার আলো জ্বালিয়েছেন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি জেলায় জেলায় যখন চিকিৎসা সেবা হয়ে উঠেছে ‘সোনার হরিণ’ তখন উল্টো পিঠেই যেন চড়েছেন গর্বিত সেনা সদস্যরা।

তারা দাঁড়িয়েছেন অসহায় বিপন্ন মানুষের পাশে। বিনামূল্যে দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা সেবা।

প্রায় প্রতিদিনই দেশের প্রতিটি এলাকায় এলাকায় জ্বর, ডায়াবেটিস, পেটের পীড়া ও পুষ্টিহীনতায় ভোগা রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দিচ্ছেন সেনা চিকিৎসকরা।

বগুড়ায় সেনাবাহিনীর ১১ পদাতিক ডিভিশনের ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা সেবাসহ বিভিন্ন জেলায় অসহায় সাধারণ রোগীদের জন্য চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেনা সদস্যরা।

কালের আলো’র চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রতিবেদক জানিয়েছেন, এ জেলাতে বাড়ি থেকে বের হওয়ার নিষেধজ্ঞার মধ্যে গ্রামে গ্রামে গিয়ে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পৌঁছে দিতে কাজ করছে সেনা সদস্যরা। শনিবার (০৪ এপ্রিল) দুপুরের পর সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মেডিকেল ক্যাম্প বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।

সাধারণ মানুষ যাতে চিকিৎসাবঞ্চিত না হোন, সেজন্য বাড়ির কাছেই চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ পৌছে দেয়ার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মেডিকেল ভ্যানে ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন তৃণমূল জনগোষ্ঠীকে।

স্থানীয় বারোঘরিয়া, গোহলাবাড়ির এলাকার প্রায় শতাধিক মানুষকে চিকিৎসা সেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হয়। সেনাবাহিনীর এমন উদ্যোগে সন্তুষ্ট এ জেলার বাসিন্দারা।

আমাদের খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, খাগড়াছড়িতে হামসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত শতাধিক রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছে সেনাবাহিনী। এখানকার সদর উপজেলার দুর্গম রবিধানপাড়া এলাকায় হামসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ৭৩ শিশুসহ শতাধিক নারী-পুরুষের সেবায় কাজ করছেন সেনাবাহিনীর চিকিৎসক দল।

আমাদের কুমিল্লা প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, কুমিল্লা জেলায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। কুমিল্লায় বিভিন্ন স্থানে বিনামূল্যে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাসেবা চালু করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কুমিল্লা এরিয়া।

কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় টাউনহল মাঠ, ইপিজেড ও কালিয়াজুড়িতে প্রায় ৫ শতাধিক রোগীকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। রোগিদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন ডা.ক্যাপ্টেইন আয়েশা সিদ্দিকী।

৩৫ ফিল্ড অধিনায়ক কর্নেল মো. নাজমুল হুদা খান জানান, কুমিল্লা জেলাসহ বৃহত্তর কুমিল্লার ৬টি জেলায় সেনাবাহিনীর ৮টি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দৌড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে কাজ করছে।

যারা অতি প্রয়োজনে বাইরে বের হচ্ছেন তারাই এ সেবা পাচ্ছেন। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে আমরা যাচ্ছি যেখানে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দিনমজুর, পথশিশু, অসহায়রা আছেন তাদের সেবা দিচ্ছি।

গাজীপুর সংবাদদাতা জানান, টঙ্গীর এরশাদ নগরের মজিদা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা সেবা ও বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনীর ১১ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। সাধারণ চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি তারা করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে স্থানীয়দের করণীয় নিয়ে আলোচনা ও পরামর্শ দিচ্ছেন।

পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলার বোদা উপজেলার বালাভীড় আদিবাসী আশ্রয়ণ প্রকল্পে সেনাবাহিনীর ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়েছে। রংপুর অঞ্চলের সেনাবাহিনীর ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের উদ্যোগে করোনা ভাইরাসের কারণে দূরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে না পারা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য এই ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা সেবার আয়োজন করা হয়।

ভ্রাম্যমাণ এ চিকিৎসা সহায়তা ক্যাম্পে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য, আদিবাসী শিশু ও এলাকার গরিব দুস্থ নারী-পুরুষদের ব্যবস্থাপত্র ও বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হয়। সেনাবাহিনীর ভ্রাম্যমাণ এই স্বাস্থ্য ক্যাম্প থেকে মাইকে করোনা জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রচারণাও চালানো হয়।

আমাদের লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, লালমনিরহাটের তিস্তা-ধরলার নদীর চরাঞ্চলের অসহায় গরীব মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন সেনাবাহিনীর মেডিকেল ক্যাম্প।

রংপুর ৩৪ ইস্ট বেঙ্গল সেনাবাহিনীর (সিএমএইচ) চিকিৎসক ডা. মেজর কাওসার জানান, চরাঞ্চলের অসহায় গরীব মানুষরা যাতে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়, এ লক্ষ্যেই প্রত্যেকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বিনামূল্যে ওষুধসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে।

কালের আলো/এমএএএমকে