‘করোনা যোদ্ধা’ সেনা সদস্যদের এ যেন মানবতারই জয়গান! (ভিডিও)

প্রকাশিতঃ 12:36 pm | April 06, 2020

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো :

মৃত্যু যেন হাতের মুঠোয়! তবুও চোখে স্বপ্ন, বুকে প্রত্যয়।সবাইকে সুরক্ষার মন্ত্র গ্রোথিত নিজ নিজ হৃদয়ে। দিনের পর দিন বিশ্বময় অধরা নীলাকাশ জুড়ে ছড়িয়েছেন নিজেদের কর্মের দ্যুতি। 

আরও পড়ুন: দেশজুড়ে স্বাস্থ্য সেবাতেও এখন ভরসার নাম সেনাবাহিনী

মাটি, বায়ু, জল শরীরে মেখে বেড়ে উঠেছেন যেখানে সেই মাতৃভূমির ‘মলিন বদন’ মুছে মানুষকে সচেতন করে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার জন্যই ত্যাগের সমুদ্রে এবার ভাসিয়েছেন সৈনিক জীবনের তরী। দিন-রাত্রি গাড়িতে বা পায়ে হেঁটে বের হচ্ছেন টহলে।  

হাতে হাতে শোভা সচেতনতামূলক প্ল্যাকার্ড। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে অদৃশ্য ভয়ংকর জীবাণু করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝায় ভরা কঠিন এক লড়াইয়ে নিজেদের সমর্পণ করেছেন।

আরও পড়ুন: সহায়তায় আর্মি এভিয়েশন; আকাশপথে সেনা সদস্যদের হাতে যাচ্ছে মেডিকেল সরঞ্জামাদি

তারা বাঙালির অপূর্ব আবেগ, ভালোবাসা আর মায়ায় জড়ানো, বীরত্ব, সাহস, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর সংগ্রামের প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য। 

ভয়াবহ ছোঁয়াচে করোনার কালো থাবায় যখন গোটা বিশ্বে ধারাবাহিক বিপর্যয় নেমে এসেছে তখন নিজের দেশের মানুষকে ঘরে থাকতে উৎসাহী করতে প্রায় সপ্তাহ দুয়েক যাবত কোমরবেঁধেই মাঠে রয়েছেন। সময় বা ঘন্টার হিসাব না করে  ছুটোছুটি করছেন ক্লান্তিহীন। 

আরও পড়ুন: সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বেচাবিক্রি, অনুসরণ হচ্ছে ‘সেনাবাহিনী মডেল’ (ভিডিও)

চিতাবাঘের মতো বিদ্যুৎ গতির পরিবর্তে সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন করোনা সতর্কতা প্রচারণায়। জাতীয় জীবনে কঠিন এক সংগ্রামে একেকজন ‘করোনা যোদ্ধা’ কোটি কোটি মানুষকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ করতে এসবের মাধ্যমেই যেন প্রকারান্তরে গেয়ে চলেছেন মানবতার জয়গান।

জীবন সংকটে নিজের মাতৃভূমির মানুষকে জেতাতে তাদের প্রচেষ্টা হার মানিয়েছে রূপকথাকেও!

আরও পড়ুন: বৃত্তের মাধ্যমে দূরত্ব চিহ্নিত; সেনাবাহিনীর কর্মযজ্ঞে দেশজুড়ে স্বস্তির সুবাতাস (ভিডিও)

তাদের এই অবিচল পথচলায় সম্পৃক্ত হয়েছেন দেশের অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। একাত্তরের পর বাঙালি জাতির নতুন এ সংগ্রামের ইতিহাসে তারাও নিয়েছেন ঠাঁই। 

সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের টহলে টহলে যেমন সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছেন তেমনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকার তীব্র অভিপ্রায় হৃদয়তন্ত্রিতে গেঁথে দিতে প্ল্যাকার্ডের লেখা বাক্য নিজের কন্ঠে উচ্চারণ করছেন।

‘আতঙ্ক না ছড়াই, সতর্ক থাকি, সাহায্য করি’ কিংবা ‘ঘন ঘন হাত ধুই করোনা থেকে নিরাপদ রই।’ তাদের টহল গাড়িতেও দেখা মিলছে ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করুন’ লেখা স্টিকার।

আরও পড়ুন: প্রকৃতিতে ফিরেছে প্রাণ, আতঙ্ক নয় প্রতিরোধের ডাক সেনা সদস্যদের (ভিডিও)

সেনা সদস্যদের দেশ মাতৃকার সেবায় ক্লান্তিহীন মুগ্ধমনে পথচলা; নিশিথে-দিবসে আলোর ঝরনাধারায় অমাবস্যার ঘনিয়ে আসা ঘন কালো অন্ধকার যেন ধুয়ে-মুছে দিচ্ছে।

রাজধানীর শাহবাগ, ধানমন্ডি, মতিঝিল, গুলশান, মগবাজার, গুলশান, বনানী, মিরপুর থেকে শুরু করে ইট-পাথরের এক সময়কার যান্ত্রিক নগরী ছাপিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে তাদের কর্মপ্রয়াস নজর কেড়েছে। সমানতালে ভাসাচ্ছে প্রশংসাতেও। 

হাল সময়ের সরকারি বিধি নিষেধ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সর্বাত্নক সহযোগিতা দিচ্ছেন সরকারি প্রশাসনকে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন।

শৃঙ্খল জীবনাদর্শ আর নিয়ম কানুন মেনে চলার সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন সবাইকে। 

আরও পড়ুন: করোনার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত যুদ্ধে সেনাবাহিনী, সেনাপ্রধানের বক্তব্যে আশার সঞ্চার

করোনাভাইরাস বিশ্বে মৃত্যুর মিছিলে নিত্যদিন হাজার হাজার নাম যোগ করায় দেশের ৬২ টি জেলায় ৫৪৬ টি দলে বিভক্ত হয়ে নানা কায়দায় ঘর থেকে বের হওয়া মানুষকে সচেতন করছেন।

তাদের সচেতনতামূলক বার্তায় জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষজনের মুখে মাস্ক যেমন চোখ পড়ে তেমনি বুক বা প্যান্টের পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখার প্রবণতাও তৈরি করেছে।

সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের মাধ্যমে করোনার ভয়াল থাবা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করতে এসব সেনা সদস্যরা নিয়মিত টহল জোরদার করে সড়কে বা অলিগলিতে সাধারণ মানুষের জটলা ভেঙে দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন: প্রখর খরতাপেও পথে পথে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সেনাবাহিনী (ভিডিও)

ঘর থেকে বের হওয়া মানুষজনকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনছেন। গাড়ি থামিয়ে কথা বলছেন তাদের সঙ্গে। নির্ধারিত পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে সড়কে বের হওয়া গাড়ির চারপাশে তাদের জীবাণুনাশক ছিটানোর দৃশ্যও চোখে পড়েছে হরহামেশাই। 

মরণঘাতী এই ভাইরাসের মধ্যেও নিজেরা পেশাগত দায়িত্ব পালনে অনড় অবস্থানে রয়েছেন। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করতে ব্যবহার করছেন সাধারণ নিরাপত্তা সামগ্রী। দূরত্ব মেনে  চলাচল ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাতেও নিজেরা জোর দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: সহায়তায় আর্মি এভিয়েশন; আকাশপথে সেনা সদস্যদের হাতে যাচ্ছে মেডিকেল সরঞ্জামাদি

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত করোনা ঝুঁকি বা প্রাণহানি কোথায় গিয়ে ঠেকে এ সম্পর্কে এখনও আগাম মূল্যায়নের সময় আসেনি। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও দিন কয়েক। তাদের মতে, দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত ধরা পড়েছিল গত ৮ মার্চ।

এরপর ২৬ মার্চ দেশ অলিখিত লকডাউনে যাওয়ার পর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৪ জন। ইতোমধ্যেই সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়েছে। আগামী ৭ এপ্রিলের পর থেকে দেশে করোনার প্রকৃত চিত্র মিলতে পারে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষের ঘরে থাকতে বাধ্য করতে তাই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গোটা বিশ্বেই মানবিকতার অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে। বিশ্বজুড়ে কুড়িয়েছে যশ-খ্যাতি।

আরও পড়ুন: সামাজিক দূরত্ব বজায়ে কঠোর সেনাবাহিনী, বদলে গেছে দৃশ্যপট (ভিডিও)

মুক্তিযুদ্ধের গৌরব আর শৌর্যকে অন্তরে ধারণ করে পথচলা এই বাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ সম্প্রতি নিজেও বলেছেন, ‘আমরা সৈনিক। আমরা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। সরকারের নির্দেশে দেশের মানুষকে সব রকমের সহযোগিতা করতে চাই। 

তাঁর এই প্রবল আত্নবিশ্বাসী উচ্চারণ প্রমাণ করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করেই দেশের মানুষকে সুরক্ষার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বে এক মোহনায় দেশ, মানুষকে ‘সুরক্ষার যুদ্ধে’ সেনাবাহিনী

তাদের এমন মানবিকবোধ আমাদের ঘরে থাকার সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে প্রতিনিয়ত’ বলছিলেন রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক জুলফিকার ইসলাম (৪০)।

অতীতেও দেশের কোন দুর্যোগ বা সংকটময় মুহুর্তে ‘ত্রাতা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। করোনা মোকাবেলাতেও সরকারের ডাকে নিজেদের জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েই মানবতার সেবায় নিজেদের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করেছেন।

বাজার বা জনসমাগমের পয়েন্টে তারা বৃত্তের মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনের দূরত্ববিধি মেনে চলার অভূতপূর্ব ফর্মুলার প্রয়োগ ঘটাতে সাধারণ মানুষকে উৎসাহী করছেন।

করোনার উপসর্গের বাইরে জ্বর, সর্দি, কাশি থেকে শুরু করে পেটব্যাথা, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত অসহায় ও নিপীড়িত মানুষকে সাধ্যমতো চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছেন।

দেশের সাধারণ চিকিৎসকরা যেখানে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার অজুহাতে ‘ইউটার্ন’ নিয়েছেন সেখানেই জীবনের জয়গান গেয়ে চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষকে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিচ্ছেন এই সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরাই। বিতরণ করছেন কাঙ্খিত ওষুধ।  

কোনো কূপমণ্ডূকতা সেনা সদস্যদের এ মানবিক কর্মের উজ্জ্বলতম  দীপ্তিকে ঢেকে রাখতে পারেনি। অদম্য সাহস আর মানবিক মনের দ্যুতি ছড়িয়ে তারা নিশ্চিত সেবা উপহার দিয়ে প্রশান্তির পরশ বইয়ে দিয়েছেন শহর থেকে গ্রামের মানুষের হৃদয়ে।

স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমেই কেন্দ্র থেকে প্রান্ত তৃণমুলের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রীতিমতো যেন সম্পৃক্ত হয়েছেন ভাব-ভালোবাসার অচ্ছেদ্য বন্ধনে।

সাধারণ মানুষকে ঘরে রাখার কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করার সব রকমের উদ্যোগ সফল করতে নিম্ন আয়ের মানুষজনের খাদ্য সংকটেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সেনা সদস্যরাও।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রকৃত খেটে খাওয়া দিনমজুর অসহায়দের হাতে তুলে দিচ্ছেন খাদ্য সামগ্রী। দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের মানবিক কার্যক্রমের এমন আরেকটি নজিরের প্রশংসা করছেন দেশের নানা প্রান্তের খেটে খাওয়া দিনমজুর ও ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষেরা।

‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে যারা না খেয়ে আছে অথবা যারা একদমই অস্বচ্ছল জীবন-জীবিকার তাগিদে বের না হওয়া ছাড়া উপায় নেই, তাদের হাতে খাবার পৌঁছে দেয়ায় জোর দেওয়া হয়েছে’, কালের আলো’র সঙ্গে আলাপে বলছিলেন ঢাকার একজন সেনা কর্মকর্তা। 

‘মেঘ দেখে তুই করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’ কবির কবিতার মতোই এমন উচ্চারণ করে গাজীপুরে টহলরত এক সেনা সদস্য এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘কোনো মা-ই তার সন্তানকে ‘উৎসর্গ’ করতে চান না। কিন্তু আমাদের মা আমাদেরকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছেন।

দেশপ্রেমের যে শপথ নিয়ে সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম জীবনের বাকীটা সময়েও একই পথে নিজেকে অবিচল রাখতে চাই। এটাই আমাদের সৈনিকদের মূলমন্ত্র।’ 

আবেগী বর্ণনার আর্দ্র আবেশে বাঙালির নতুন সংগ্রামে অগ্নিমশাল হয়ে উঠা এ সৈনিকের অবিনাশী এই উচ্চারণ যেন দিগন্ত প্রসারী, ব্যাপক, বিস্তৃত ও মুল্যবোধ জাগানিয়া। এ যেন সবাইকে ঘরের ভেতরে রাখার মানসিকতার ভিত মজবুতেরই কার্যকর, শৌর্যবান এক বার্তা। 

কালের আলো/এমএএএমকে