জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দায়িত্বে আনসার সদস্যরা, সঙ্কট নেই সুরক্ষা সামগ্রীর

প্রকাশিতঃ 10:19 am | April 10, 2020

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

কোন কিছুতেই থামছে না করোনাভাইরাসে প্রাণহানি। গোটা বিশ্বে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে প্রতি মিনিটে সংক্রমিত হচ্ছেন ৫৯ জন। ফলে পরিস্থিতি মোকাবেলায় হার্ডলাইন গ্রহণ করেছে সরকার। দেশ কার্যত থমকে গেলেও করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি নিজেদেরও সামিল করেছেন ৬১ লাখ সদস্যের বিশাল বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী।

সরকারের নির্দেশে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই করোনা যুদ্ধে অগ্রসৈনিক হিসেবে মাঠে রয়েছেন তারা। দায়িত্ব পালনে পরিবারের মায়া ত্যাগ করেই রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত পল্লীতেই সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ দিয়েই দায়িত্ব পালন করছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি হাসপাতালে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভসসহ মানসম্মত পিপিই (পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট) দিয়েছে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর।

সংক্রমণ ঠেকাতে ইতোমধ্যে তাদের প্রায় চার শতাধিক পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও আইসোলেশন ইউনিটে দায়িত্বরতদের আলাদা আলাদা পিপিই দেওয়া হয়েছে। নিজেদের সুরক্ষিত করেই ডিউটিতে থাকা আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।

এরপরেও স্পর্শকাতর স্থানে দায়িত্ব পালনকারী সদস্যদের জন্য আরও প্রায় এক হাজার পিপিই সরবরাহের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ।

কালের আলো’র সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, ‘করোনা সতর্কতায় হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর জায়গায় দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্যদের কোন সুরক্ষা সামগ্রীর সঙ্কট নেই। তারা কোন রকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও নেই।

রাজধানীর বিভিন্ন উদ্যান, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, ভিআইপিদের বাড়ির নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্যরা নিজেদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী নিয়েই অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিদিনই আমাদের একাধিক টিম পুরো কার্যক্রম নিবিড়ভাবে মনিটরিং করছে। এসব নিয়ে কোন বিভ্রান্তির সুযোগ নেই।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, সারা দেশে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬১ লাখ। বর্তমানে একটি গার্ড ব্যাটালিয়ন ও দু’টি মহিলা আনসার ব্যাটালিয়নসহ মোট ৪২টি ব্যাটালিয়ন রয়েছে।

এর মধ্যে ৪১টি ব্যাটালিয়নে ১৮ হাজার ব্যাটালিয়ন আনসার নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করছেন। দেশের বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও ইপিজেডসহ গুরুত্বপূর্ণ ৪ হাজার ২১৪টি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় প্রায় ৫০ হাজার অঙ্গীভূত আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।

আর ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যরা হচ্ছেন র‌্যাব বা বিজিবির মতোই একটি প্যারামিলিটারি ফোর্স। তারা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। এসবের পাশাপাশি পার্বত্যাঞ্চল, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলসহ সারাদেশের সমতল এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সন্ত্রাস দমন, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, মৌলবাদ ও মাদক নিয়ন্ত্রণে ব্যাটালিন আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া রেলস্টেশন ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণসহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আনসার সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন। করোনা মোকাবেলায় রাজধানীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এবং পুলিশের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন।

আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিচালক (অপারেশন) মোহাম্মদ সাইফুর রহমান কালের আলোকে বলেন, ‘ব্যাটালিয়ন আনসার কমান্ডারের পাশাপাশি প্রতি জেলায় জেলা কমান্ডার, উপজেলায় উপজেলা কমান্ডার, ইউনিয়ন আনসার কমান্ডার, প্রতি গ্রামে ভিডিপি (গ্রাম প্রতিরক্ষা) লিডার আছেন। মার্চের শুরুর দিকেই তাদের কাছে সুরক্ষা সরঞ্জাম হিসেবে মাস্ক ও গ্লাভস পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’

দেশের জরুরি পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে ডিউটি করছেন আনসার সদস্য শাহাবুদ্দিন ও সাদির আলী। করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা পেতে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘আমরা মুখে মাস্ক ব্যবহার করছি। সাবান পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার রাখছি নিয়মিত।

সরকারিভাবে আমাদের অফিস থেকেই এসব ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ তবে এর বাইরেও অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগেও মাস্ক কিনছেন এমন তথ্যও জানান তারা।

একই রকম চিত্র দেখা গেলো রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি মল ও ফার্মগেটের মেট্রোরেল প্রকল্পে। বসুন্ধরায় দুই আনসার সদস্য আবু ইউসুফ ও আনোয়ারুল ইসলাম ড্রেস পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের হাতে-মুখে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম। কেমন চলছে আপনাদের, সাংবাদিক পরিচয়ে এমন প্রশ্ন করতেই ইউসুফ ও আনোয়ারুলও জবাব দিলেন।

হাসিভরা মুখেই বললেন, ‘সবাই ঘরে থাকলেও আমাদের তো ওপায় নাই। বউ-বাচ্চারা টেনশন করে। কিন্তু ডিউটি তো করতেই হবে। দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য কাজ করতাছি, শান্তি এইটাই।’

রাজধানীর শিশু হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও সোহরাওয়ারর্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, ফটক ও বিভিন্ন ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় চার শতাধিক আনসার সদস্য। তাদের সবাইকে পিপিই (পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট) দিয়েছে আনসার সদর দপ্তর।

শিশু হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় আনসার সদস্য মিনহাজুল ইসলামের সঙ্গে। তার শরীরে পিপিই (পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট) চোখে পড়লো। জীবন সচেতন মিনহাজুল বলেন, ‘আমরা সবার নিরাপত্তা দিচ্ছি। আমাদের স্যারেরাও (কর্তৃপক্ষ) আমাদের নিরাপত্তাকেই সবার আগে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে গরমের কারণে পিপিই ব্যবহার অনেক কঠিন।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বরত আনসার সদস্য মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ‘সবার কাছেই নিজের প্রাণ সবচেয়ে মূল্যবান। আমরা পিপিই পেয়েছি বলেই কষ্ট হলেও ডিউটি করতে পারছি। আমাদের ওপর আমাদের স্যারদের নজরও আছে। তারা প্রতিনিয়ত আমাদের নানাভাবে সচেতন করছেন। আমরাও সাধ্যমতো দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করছি।’

বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ.কে.এম.আসিফ ইকবাল কালের আলোকে বলেন, ‘সংক্রমণের ঝুঁকি এড়িয়েই দায়িত্ব পালন করতে প্রতিটি সদস্যকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ।

নিজেদের নিরাপদ রেখে সবাই যেন ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করতে পারে এজন্য আমাদের বাহিনীর পক্ষ থেকে সবাইকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে।’

রাজধানীর বড় হাসপাতালে ও ওয়ার্ডের সামনে যারা ডিউটি করেন তাদের প্রত্যেককে পিপিই দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মহাপরিচালক অত্যন্ত কর্মতৎপর ও মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ।

তার কাছে বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের জীবনই মূল্যবান। স্পর্শকাতর স্থানসমূহে ডিউটিরত সদস্যদের পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত এক্ষেত্রে কোথাও কোন ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি।’

কালের আলো/এসএম/আরআর