‘বাঁকবদল’ করেই ‘ইতি’ আইজিপি ড.জাবেদ পাটোয়ারী!

প্রকাশিতঃ 11:00 am | April 12, 2020

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:

প্রাণসংহারি নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবের কারণেই কিনা জমকালো কোনো আয়োজন নেই। তবুও সবার কানে কানেই বেজেছে তার বিদায়ের সুর! কী আবেগ-হাহাকারই না খেলে যাচ্ছে সহকর্মী-সতীর্থদের হৃদয়ে।

আর মাত্র দুইদিন বাদেই তার পদবীর আগে বসবে ‘সাবেক’ শব্দটি। ফলত শেষ মুহূর্তে সময় যেন এভাবেই লিখে যাচ্ছে সফল পুলিশ প্রধান ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর বিদায়ের কাব্য!

হ্যাঁ, একটা কথা ঠিক যে, দীর্ঘ চাকরি থেকে তার বিদায়ের ক্ষণে অজস্র আলোকরেখার বিচ্ছুরণে প্লাবিত হচ্ছে বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যর হৃদয়ের জমিন। এই মানুষটি-ই তো নিজ বাহিনীতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে অনড় থেকেছেন শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত। বদলি বাণিজ্যের রাশ টেনে পুলিশে ফিরিয়ে এনেছিলেন ইতিবাচক ধারা।

কখনও গায়ে লাগতে দেননি বিতর্কের পূতিগন্ধময় পানি। নিজের নেতৃত্বের সময়ে দু’টি কনস্টেবল ও সাব ইন্সপেক্টর নিয়োগেও ‘অনিয়ম-দুর্নীতি’ শব্দযুগলকে যেন রীতিমতো ‘হিমাগারে’ পাঠিয়ে ছেড়েছেন তিনি।

মাত্র দুই বছর তিন মাস সময়েই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার শক্ত ভিত রচনা করেই অর্জনের চূড়ায় নিয়ে গেছেন নিজের প্রিয় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে।

ইলিশের রাজধানী চাঁদপুরে জন্ম নেওয়া ক্ষণজন্মা এ মানুষটি নিজের বর্ণাঢ্য চাকরি জীবনে এক রকম নির্মল-নিষ্কলুষ রেখেই বাহিনীকে ‘গুডবাই’ বলতে পারার পরম সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। যিনি বাংলাদেশ পুলিশকে পরিণত করতে পেরেছেন ‘জনতার পুলিশে’।

মঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল) শেষ হতে যাচ্ছে পুলিশ প্রধান হিসেবে তার দুই বছর তিন মাসের পথচলা। ইতি টানতে হচ্ছে দীর্ঘ ৩৪ বছরের পুলিশ ক্যারিয়ারের কঠিন এক মঞ্চেরও!

চলতি বছরের পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বিদায়ী আইজিপি ড.জাবেদ পাটোয়ারী।

আলো বিলিয়ে দেওয়া সূর্যকেও যেমন দিন শেষে অস্ত যেতে হয় তেমনি সব কিংবদন্তিকেও একদিন বিদায় বলতে হয়। তবে এই কিংবদন্তিরা নিজ নিজ আকাশে তারা হয়ে বিকিরণ ছড়িয়ে যান অর্জনে; সবার হৃদমাঝারে।

ঠিক তেমনি সেরাদের সেরা পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবেই বিউগলের করুণ সুরে নয়, কৃষ্ণচূড়ার রঙিন আভাতেই হচ্ছে ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর চাকরি জীবনের সূর্যাস্ত।

পুলিশ সম্পর্কে জনমনে ধ্যান-ধারণা বদলে দেওয়ার কারিগর, অসাধারণ বাঁকবদলের নেতৃত্ব দেওয়া এই কাপ্তানের সোয়া দুই বছর বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে নতুন করে লেখা থাকবে- সোনালী অক্ষরে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তার নেতৃত্বের দূরদর্শিতা আলো ছড়িয়ে যাবে বর্ণিল হয়ে!

ফিরে দেখা সেই দুই বছর তিন মাস
২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ পুলিশের ২৯ তম আইজিপি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার)। সেদিনই পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভায় তিনি সরকারের জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র নীতি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।

পুলিশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট থানাকে সেবা প্রদানের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষার কথা জানান। প্রতিটি সদস্যকে পরামর্শ দেন, সাধারণ মানুষের সাথে ভালো আচরণের।

সম্প্রতি পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে গণভবনে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। সেই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন আইজিপি।

কামনা করেন, পুলিশের ইমেজ পরিবর্তনের জন্য সবার সম্মিলিত প্রয়াসের। আর এসবের মাধ্যমেই বাংলাদেশ পুলিশকে একটি ব্যতিক্রমী উচ্চতায় পৌঁছাতে পেরেছেন তিনি।

আক্ষরিক অর্থেই নিজের আইজিপি পদে দায়িত্বের এই সময়ে দুর্নাম ও অপবাদ ঘুচিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনায় গড়ে উঠা পুলিশ বাহিনীকে মর্যাদার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে কৃত্রিমতা ও লোক দেখানো কাজ বর্জন করে সরল, সোজা ও সত্যের পথই বেছে নেন ড. জাবেদ পাটোয়ারী।

জাতির জনকের স্বপ্নের পুলিশের দীপ্ত পদযাত্রার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গাইড লাইন’ আর জাদুকরী স্পর্শে তিনি অটল-অবিচল থেকেছেন। নতুন করে ক্লিন ইমেজে গোটা পুলিশ বাহিনীকে উদ্বেলিত করেছেন পুনরুজ্জীবনের মহামন্ত্রে।

অপূর্ব দক্ষতায় তিনি পুলিশের প্রতিটি সদস্যের মাঝে এনেছেন ‘টিম স্পিরিট’।

প্রথাগত কাঠামোর মধ্যে থেকেই তিনি নিজের বাহিনীর পেশাগত উৎকর্ষ ও বিকাশকে উচ্চতর পর্যায়ে উত্তীর্ণ করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার বিশ্বস্ততার ঐতিহ্য লালিত হয়ে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি নিরঙ্কুশ থেকেছেন। সব মহলেই পুলিশের নতুন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা নিয়েছেন বিদায়ী এই পুলিশ প্রধান।

এমন কর্মের মাধ্যমেই সোয়া দুই লাখ সদস্যের বিশাল পুলিশ বাহিনীর সব পর্যায়ের সদস্যের নিখাদ ও অকৃত্রিম ভালবাসা পেয়েছেন।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, পুলিশ প্রধান হিসেবে ব্যতিক্রমধর্মী এক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন ড. জাবেদ। প্রথমবারের মতো তিনি কথা বলেছেন প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে। আইজিপির সঙ্গে ওসিদের এই ‘ওয়ান টু ওয়ান’ সংযোগের প্রভাব হচ্ছে খুবই ইতিবাচক।

মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার। তিন মাস আগে পুলিশ সপ্তাহের ছবি।

পুলিশ সদর দপ্তরে পর্যায়ক্রমে রেঞ্জভিত্তিক সব থানার ওসিকে নিয়ে বসেছেন। জনবান্ধব পুলিশিং এর লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যেই আয়োজন করা এ বিশেষ বৈঠক বা কর্মসূচি পুলিশে গুণগত পরিবর্তনেরই একটি কার্যকর প্রয়াস বলেই মনে করছেন অনেকেই।

একই সূত্র বলছে, ‘থানা হবে সেবার কেন্দ্রবিন্দু’ এই থিমকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতেই পুলিশ প্রধান কাজ করছেন নিবিষ্টমনে। তাঁর মূল টার্গেট ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘জনগণের পুলিশ’ বাস্তবায়নের।

জনবান্ধব পুলিশ গড়তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ‘পুলিশবান্ধব’। এবারের পুলিশ সপ্তাহের মূল থিম ছিল- মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার। আর এই রূপকল্প বাস্তবায়নে পুলিশের বিদায়ী মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার) বিশদ কর্মপরিকল্পনা হাতে নেন। জনবান্ধব পুলিশিংকে অর্থবহ ও সফল করতে তিনি বিদ্যমান বাস্তবতার গভীরে আলোকপাত করেছিলেন।

ড. জাবেদ পাটোয়ারীর মতে, ‘দেশের প্রতিটি থানার ওসি যদি ভালো হন তবেই সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে কাঙ্ক্ষিত ও উন্নত সেবা পাবে। তখনই পুলিশ হবে জনতার।’

এই ধারণাকে মাঠ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেই ‘আইজিপি-ওসি’ ‘ওয়ান টু ওয়ান’ কন্টান্ট হয়েছে। ইতোপূর্বে যা কখনও হয়নি।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও একই লক্ষ্যে ভূমিকা রেখেছেন। গড়ে তুলেছেন টিমওয়ার্কের নতুন রোল মডেল। পরিবর্তন সূচিত হয়েছে পুলিশের কার্যক্রমে। সত্যিকার অর্থেই বদলে যাচ্ছে পুলিশ।

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপির সাথে ওসিদের বৈঠকে উদ্ধুদ্ধকরণ কার্যক্রম সম্প্রসারণে নয়, আইজিপি এক্ষেত্রে তার বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বে গ্রহণ করেছেন বহুমাত্রিক উদ্যোগ।

তিনি গোটা দেশ সফর করেছেন। তৃণমূলের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে থানা পর্যায়ে প্রচলিত ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

৩৬ তম বিসিএস (পুলিশ) প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে কেক কাটেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বিদায়ী আইজিপি ড.জাবেদ পাটোয়ারী ও সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত আইজিপি ড.বেনজীর আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।

তার মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন কার্যক্রম, ওসিদের সাথে সরাসরি কথা বলার ফলে ইতোমধ্যেই থানা পুলিশের মাঝে ব্যাপক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

বিদায়ী আইজিপি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, ‘মানুষ নির্ভয়ে থানায় যাবে, হাসিমুখে থানা থেকে বের হয়ে আসবে। পুলিশী সেবার প্রতি মানুষের আস্থা ও নির্ভরতার মূল্যবোধ বিকশিত হবে।’

প্রায় সোয়া দুই লাখ সদস্য নিয়ে গর্বিত দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনী। অস্বীকার করা যাবে না, অপরাধ দমনে নিয়োজিত পুলিশের কিছু সদস্যের মধ্যে অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া, অনৈতিকতা, ঘুষ-দুর্নীতির প্রবণতা রয়েছে। সুদূর অতীত থেকে পুলিশ সম্পর্কে মানুষের মাঝে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে।

অনেকক্ষেত্রে সেবার বদলে জুটেছে হয়রানি। এসবই মান্ধাতা আমল থেকে চলে আসা বৈশিষ্ট্য। যা পুলিশের ইমেজ ক্রাইসিসের কারণ। এখানেই নেতিবাচক পরিস্থিতি থেকে পুলিশকে বের করে আনার লক্ষ্যে সমূহ উদ্যোগের বাস্তবায়ন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বলেন, পুলিশকে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। তখনই পুলিশ আস্থাহীনতার সংস্কৃতিকে বিদায় করে বিবর্তনের মধ্যে যাত্রা শুরু করেছে জনবান্ধব নীতিতে। মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে পুলিশ শূন্য সহনশীলতা নীতি নিয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা সুরক্ষা, অপরাধ দমন, জননিরাপত্তা, সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা, তদন্ত ও রহস্য উদঘাটন, গোয়েন্দা নজরদারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে পুলিশ জোরদার ভূমিকা পালন করছে।

নভেল করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অগ্রসৈনিক হিসেবে দেশবাসীর সুরক্ষায় নিজেদের জীবনবাজি রেখে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

পুলিশ সদস্যদের বদলির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনার চেয়ে পেশাগত দক্ষতা, মেধার গুরুত্ব দিয়েছেন বিদায়ী এ পুলিশ প্রধান। অপরাধ করলে যথাযথ শাস্তির মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলা নিশ্চিতেও কাজ করেছেন জাবেদ পাটোয়ারী।

পুলিশ সদর দপ্তরে উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দ্যেশ্যে দিক নির্দেশনামুলক বক্তব্য রাখছেন পুলিশ প্রধান ড.জাবেদ পাটোয়ারী।

চলতি বছরের ০৫ জানুয়ারি গণভবনে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আপনাকে (প্রধানমন্ত্রী) এখন আর হয়তো পুলিশের দুর্নামের কথা শুনতে হয় না। এখন পুলিশ যে এগিয়ে যাচ্ছে সেই কথাই হয়তো শুনেন। মাঝেমধ্যে দুই চারটি কথা অবশ্যই শুনেন। সেগুলো পুলিশের আইজিপি সরাসরি অ্যাকশন নেন বলেই এই বাহিনীতে শৃঙ্খলা অটুট রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।’

কনস্টেবল ও এসআই পদে নিয়োগ যেন ইতিহাস!
অতীতে পুলিশের চাকরি বাণিজ্যের নজিরবিহীন অভিযোগ ছিল। কিন্তু আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর জামানায় গত দুই বছরে দু’টি কনস্টেবল নিয়োগে স্বচ্ছতার রেকর্ড গড়ে পুলিশ। ঘুষ বাণিজ্য বা তদবিরের জোরে নয়, গরিব ও অসহায় পরিবারের সন্তানদের চাকরি জুটে কেবলমাত্র মেধা ও যোগ্যতার নিরিখেই।

দুদক চেয়ারম্যান এ বিষয়ে পুলিশ প্রধানকে ‘থ্যাঙ্কস লেটার’ পাঠান। সারা দেশের মিডিয়ায় পুলিশের নিয়োগের স্বচ্ছতার বিষয়টি উচ্চকিত হয়ে উঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একাধিকবার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের প্রশংসা করেছেন। পাশাপাশি এই মডেল অন্যদেরও অনুসরণ করতে উৎসাহিত করেছেন।

কনস্টেবলের মতোই এসআই পদে নিয়োগেও ঘুষমুক্ত ও সম্পূর্ণ স্বচ্ছতায় দরিদ্র পরিবারের মেধাবী তরুণদের চাকরি দিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে অপরাধ দমন ও জননিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ বাহিনীটি।

২০১৮ সালের বহিরাগত এসআই (নিরস্ত্র) পদে ২ হাজার ও ২০১৯ সালে বহিরাগত ক্যাডেট এসআই (নিরস্ত্র) পদে ১ হাজার ৪০২ জনকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। যেখানে কাঠমিস্ত্রি, নরসুন্দর, কৃষক, শিক্ষক, শ্রমিক, জেলে, খেটে খাওয়া দিনমজুর বা অতি দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তানরা নিয়োগ পেয়েছেন।

এ নিয়োগের ক্ষেত্রে শতভাগ স্বচ্ছতার নজির সৃষ্টি হয়েছে। যা অভূতপূর্ব ও কল্পনাতীত। পুলিশের মহাপরিদর্শক যা নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশে। ফলে পুলিশে পেশাদারিত্বের মূল্যবোধ বিকশিত হচ্ছে।

পুলিশে নিয়োগে স্বচ্ছতার স্বীকৃতি প্রধানমন্ত্রীর
কোনো প্রকার অর্থ লেনদেন, দুর্নীতি, অনিয়ম ও তদবির ছাড়াই স্বচ্ছতা ও মেধার ভিত্তিতে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে অকপটে কমপক্ষে তিনবার নিজের মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০২৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর)গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের মালকানাধীন কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ’র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ দুর্নীতির একটি বদনাম ছিল। পুলিশ সেখানে এবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’

একটি অনুষ্ঠানে পুলিশের আইজি জাবেদ পাটোয়ারীকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম।

‘ঘুষ, দুর্নীতিমুক্তভাবে যেভাবে নিয়োগ হয়েছে অতি সাধারণ পরিবারের গরিব ছেলে-মেয়েরা চাকরি পেয়েছেন। প্রত্যেকে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করে বিশেষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সকলের এ বিষয়টি অনুসরণ করতে হবে।’

নিজের এই বক্তব্যের চারদিনের মাথায় ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ৩৬তম বিসিএস ব্যাচের সহকারী পুলিশ সুপারদের (এএসপি) পাসিং আউট প্যারেড অনুষ্ঠানের বক্তৃতাতেও পুলিশ বাহিনীর মনখোলা প্রশংসা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।

পুলিশ বাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিন স্পষ্ট ভাষায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের পুলিশ বাহিনী যে এবার নতুন রিক্রুট করেছে সেখানে একটি লোকও কোন দুর্নীতি বা ঘুষ দেওয়ার কথা বলতে পারেনি। এ নিয়োগে এতো স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়েছে। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করার জন্য এ পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দিনেও এ ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই আপনারা (পুলিশ) এগিয়ে যাবে।’

গত ৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স মাঠে পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের প্রশংসা করে আবারও বলেন, ‘আমি মনে করি পুলিশ বাহিনী একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’

ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি টিআইবি’রও
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আগে পুলিশের দুর্নীতি নিয়ে সরব ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে টিআইবিরও পুলিশ সম্পর্কে যেন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষ, সুশীল সমাজ, নাগরিক নেতৃবৃন্দ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে এখন পুলিশ পজেটিভ।

জনগণের পুলিশ, মানবিক পুলিশ হচ্ছে পুলিশ সম্পর্কে বিদ্যমান ধারণাকে পাল্টে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ। এলক্ষ্যে কাজ করতে গিয়ে পুলিশ ইদানিং অর্জন করেছে জনগণের ইতিবাচক মূল্যায়ন।

উন্নত বিশ্বের পুলিশের সাথে এবং পরিবর্তিত বিশ্ব ও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ যুগান্তকারী পরিবর্তন ধারার সূচনা করেছে।

পুলিশ বাহিনীর অগ্রযাত্রার সূচনায় আইজিপি ড. জাবেদ সাসটেনেবল পুলিশিং ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেছেন। বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে সচেতন ও সক্রিয় করেছেন।

চিরাচরিত অনিয়ম ও দুর্নীতির বদনাম থেকে পুলিশ ক্রমশ বেরিয়ে আসার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। জবাবদিহিতা, নৈতিকতার মানদণ্ড, সেবার মনোবৃত্তি, অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতায় পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা প্রাধান্য পাচ্ছে।

সিআইডির একটি অনুষ্ঠানে আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীকে ক্রেস্ট উপহার দিচ্ছেন সিআইডি প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। বর্তমানে তাকে র‍্যাবের ডিজি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সরকার প্রধানের ইচ্ছায় সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত
পুলিশের আইজি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদানের কোনো নজির নেই। ফলে ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীকেও চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ বাড়ানো হয়নি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া না হলেও তার ভালো কাজের উপহার হিসেবে তাকে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত করছেন প্রধানমন্ত্রী।

ওই দেশের বর্তমান রাষ্ট্রদূত হিসেবে গত ৫ বছর যাবত দায়িত্ব পালন করছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম মসীহ। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি।

এবার এ পদে সরকার প্রধান বেছে নিয়েছেন বিদায়ী আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারীকে। এর মাধ্যমে জাবেদ পাটোয়ারীর দুই বছর তিন মাস ১৫ দিন সময়ের কাজের মূল্যায়ন করা হয়েছে বলেই মনে করছে ওই সূত্রটি।

তবুও বলতে হয় ‘হে বন্ধু বিদায়’
অমোঘ নিয়মে একজনকে চাকরি থেকে একদিন ‘বিদায়’ বলতে হয়। ঠিক সময়ে ‘বিদায়’ বলতে পারাটাও আবার নেতৃত্বেরই একটি বড় গুণ। কালে কালে পুলিশের আইজি হিসেবে এসেছেন অনেকেই। কিন্তু একজন ড. জাবেদ পাটোয়ারী যেন সবার চেয়ে আলাদা।

দ্রোহ ও প্রেমের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়/চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী/চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে/আমার না-থাকা জুড়ে।’

কবির সঙ্গে কণ্ঠ না মিলিয়ে বরং বিদায়ী আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারী সব সময় ধারণ করেছেন স্বদেশী আন্দোলনের যুগের কবি রজনীকান্ত সেনকে।

নিজের হৃদয়তন্ত্রিতে গাঁথা কী না রজনীকান্তের বিখ্যাত সেই গান-

‘আমি অকৃতি অধম বলেও তো
কিছু কম করে মোরো দাওনি
যা দিয়েছো তারই অযোগ্য ভাবিয়া,
কেড়েও তো কিছু নাওনি
তব আশিষ কুসুম ধরি নাই শিরে
পায়ে দলে গেছি, চাহি নাই ফিরে
তবু দয়া করে কেবলই দিয়েছো
প্রতিদান কিছু চাওনি।’

সময়ের আহ্বানে জীবনকেই একদিন ছাড়তে হয়। আইজিপি পদটি জীবনের বড় সেই ক্যানভাসেরই হয়তো বা একটি অংশ।

তখন সদ্য আইজিপি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ড.জাবেদ পাটোয়ারী। ওই সময় পুলিশ সদর দপ্তরে তার সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন কালের আলোর অ্যাকটিং এডিটর এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান।

পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সব শ্রেণি পেশার মানুষের মনের মন্দিরে যেন জায়গা করে নিয়েছেন এ দায়িত্ব পেয়েই।

পুলিশ প্রধান হিসেবে তার বিদায়ের ‘দুঃখ’ হয়তো পদ্মা-মেঘনা, যমুনায় বহমান। তবে বঙ্গোপসাগরের অতল সাক্ষী এই বিদায়ে কোনো খেদ নেই।

তবুও আনমনেই হয়তো বা তার কণ্ঠ গুঞ্জরিত হচ্ছে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার অমর পঙক্তিমালা-

‘আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়
হে বন্ধু, বিদায়।’

পুলিশের নেতৃত্বে সৎ ও চৌকস ড. বেনজীর আহমেদ
বাংলাদেশ পুলিশের ৩০ তম আইজিপি হিসেবে ইতোমধ্যেই নিয়োগ পেয়েছেন আরেক মেধাবী, সৎ ও চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত, এলিট ফোর্স র‌্যাবের ইতিহাসের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাপরিচালক (ডিজি) ড. বেনজীর আহমেদ।

পূণ্যভূমি গোপালগঞ্জের এই কৃতি সন্তান র‌্যাব ডিজির দায়িত্ব পালনের আগে প্রায় সাড়ে চার বছর ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন।

সেই সময়ে রাজধানীসহ দেশজুড়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দল হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব শক্তভাবে দমন করেন বেনজীর আহমেদ। পরে তাকে র‌্যাব ডিজি করা হয়। গুলশানের স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা প্রতিরোধেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তিনি।

একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাবেদ পাটোয়ারী। পাশেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বিভাগে চিফ অব মিশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট সার্ভিসেস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদেও কাজ করেছেন পুলিশের নয়া প্রধান।

কর্মদক্ষতার জন্য তিনবার অর্জন করেছেন জাতিসংঘ শান্তি পদক। এছাড়া পুলিশের পেশাগত সর্বোচ্চ পদক বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) তো উঠেছেই কর্মঠ এই শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার গলায়।

সরকার প্রধান শেখ হাসিনাসহ সবার গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেই পরবর্তী আইজিপি হিসেবে তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।

কালের আলো/এমএএএমকে