বাংলার রাজনৈতিক বিস্ফোরণ ও মুজিবনগর সরকার

প্রকাশিতঃ 11:40 am | April 17, 2020

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ :

মাতৃভূমি আমাদের বাংলাদেশ; টানা ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই মাতৃভূমি। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করাটাও এক বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। একাত্তরে এ সুযোগ পেয়েছিলেন বাঙলার সূর্যসন্তানেরা। যা আমাদেরও গর্বিত করে।

স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে দেশমাতৃকার সম্মান রক্ষায় একাত্তরে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তারা। ফলশ্রুতিতে শত্রুমুক্ত হয় বাংলাদেশ।

একাত্তরের ২৫শে মার্চের কালরাতে নিরীহ বাঙালির ওপর আকস্মিক ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ওই রাতেই বাঙালির প্রাণের নেতা শেখ মুজিবকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। তারা ভেবেছিল হয়তো শেখ মুজিবকে বন্দী করলেই বাঙালিকে রুখে দেওয়া যাবে। কিন্তু একাত্তরে মুক্ত মুজিবের চেয়েও বন্দী মুজিব বাংলার মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন পাহাড়সম প্রেরণার উৎস।

তাই তো ধর্ম-বর্ণ, নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক দাবি-বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দৃপ্ত শপথ নেয় বাঙালি জাতি। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের এক নিভৃত আমবাগানে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ঘটে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মাঝে যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে কানাচে।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সমর্থনের জন্য গঠিত হয় এ সরকার। যা ইতিহাসে ‘মুজিবনগর সরকার’ হিসেবেই পরিচিত। অনেকেই একে প্রবাসী সরকারও আখ্যা দিয়ে থাকেন।

১৪ এপ্রিল ১৯৭১, বুধবার। যুদ্ধাবস্থার মাঝেই বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, শনিবার। ওইদিন সকালে মেহেরপুরের সীমান্ত এলাকা বৈদ্যনাথতলা গ্রামে নিভৃত আম্রকাননে উপস্থিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ আরো অনেকে। যোগ দেন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরাও।

এরই মাঝে অতিথিদের জন্য গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে কিছু চেয়ার আনা হলো। যার অধিকাংশেরই হাতল ভাঙা। আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া পাহারায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। খবর পেয়ে আশপাশের লোকজনও জড়ো হয়েছেন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে’র প্রথম সরকার গঠনের ইতিহাসের সাক্ষী হতে।

খোলা আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হলো শপথের মঞ্চ। সকাল ১১টার দিকে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। একে একে মঞ্চে উঠলেন বঙ্গবন্ধুর চার খলিফা; সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ অন্যরা।

শুরুতেই বাংলাদেশকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রূপে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই ঘোষণাপত্রটিই হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান আইনি দলিল, যা আমাদের সংবিধান এবং সরকার গঠনের মূল ভিত্তি। এরপর অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান।

এ সরকারের রাষ্ট্রপতি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

শপথগ্রহণ শেষে তিনি একে একে এ ভূখণ্ডের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামানসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন।

মন্ত্রিসভার দপ্তর বণ্টন করা হয় ১৮এপ্রিল ১৯৭১। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন কর্নেল (অব) এমএজি ওসমানী।

শপথ নেওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট) একটি দল গার্ড অব অনার দেয়। পাশাপাশি এ রাষ্ট্রের সরকার গঠনের কথা জনসম্মুখে আনুষ্ঠানিকভাবে সেখানে ঘোষণা করা হয়। শপথ অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত সমাবেশে স্বাধীনতার মূল ঘোষণা আদেশটিও ১০ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে প্রচার করা হয় এবং এর কার্যকারিতা ঘোষণা করা হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল থেকে। (সূত্র: লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মেজর রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম)।

এ সময় সাংবাদিকদের সামনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই সরকারকে ‘মুজিবনগর সরকার’ হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে এই সরকারের বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে বিশ্বমানচিত্রে জন্ম লাভ করে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটি।

এর মাঝে ভারতের তৎকালীন সরকার ও জনগণ এবং বিশ্বের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের অকুণ্ঠ সাহায্য ও সমর্থন এদেশের মানুষকে সাহস জুগিয়েছে।

যুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংগ্রাম করেছে এদেশের মানুষ। ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি মেলে তাদের। পাশাপাশি দুই লাখ মা বোন হয়েছেন ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘৃণ্য ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার।

মুজিবনগরে বাংলাদেশের যে সরকার গঠন করা হয় তা ছিল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই গঠিত সরকার। ফলে এটি ছিল সম্পূর্ণ বৈধ সরকার। যুদ্ধের উপরও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। তাই বলা উচিত- এই সরকারের শপথ শুধু একটি সরকার গঠনের শপথ ছিল না। এই শপথ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার শপথও।

এর মাধ্যমে মূলত ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে বাংলার যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার ঠিক ২১৪ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আরেক আম্রকাননে যেন বাংলার সেই অস্তমিত সূর্য আবারও উদিত হয়।

যা বাংলার নির্যাতিত মানুষের মনে আশা জাগিয়েছিল। পথ দেখিয়েছিল নতুন দিনে, নতুন সূর্যের। এই সরকারের প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতার কথা উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম তার ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’- বইয়ে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন একটি আইনানুগ সরকার না থাকলে ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশ আমাদের রাজনৈতিক এবং নৈতিক সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক না হলেও খুবই সতর্ক থাকতো। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন দেশগুলো ভারতের অস্ত্র সরবরাহের পদক্ষেপকে আন্তজাতিক আইনের লংঘন হিসেবেও আখ্যায়িত করার সুযোগ নিতে পারতো অনেকে।

‘ওই অবস্থায় যুদ্ধে লিপ্ত আমরা হয়ে পড়তাম পরিত্যাক্ত এবং অসহায়! কেননা জনগণ আমাদের যতই প্রশংসা করুক না কেন, আন্তর্জাতিকভাবে আমরা সবাই বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিপন্ন হয়ে পড়তাম। ওই পরিস্থিতিতে আমাদের কার্যক্রমের কোনো বৈধতা থাকতো না।’

এছাড়া কূটনৈতিক অঙ্গনে সমর্থনের অভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে যেকোনো বিষয় ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এ সমস্ত কিছু বিবচেনায় এনেই ওই সময় বাংলাদেশের আইনানুগ সরকার গঠনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

একাত্তরের আগেও অর্থাৎ ’৪৭- এ দেশ ভাগের পর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত মানুষের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে, তাদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে বারবার জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে অসহযোগ আন্দোলন এরপর মুক্তিযুদ্ধ। এর মাঝে ১৯৬৬ সালে তিনি ঘোষণা করলেন ৬ দফা, বাঙালির মুক্তির সনদ।

ছয় দফাভিত্তিক কর্মসূচিতে জনবিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। যা এরই মধ্যে আইয়ূব খানকে বিচলিত করে তুলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবসহ কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা সাজানো হয়। তবে বাঙালির অব্যাহত আন্দোলন ও বিক্ষোভে মিথ্যা এ মামলা ঠেকেনি। ঊনসত্তরে তাকে এ মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

এরপর আসে সত্তুরের নির্বাচন। ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন ছিল ইয়াহিয়া খানের জন্য চরম হতাশার। রীতিমতো বিপর্যয়। নানা চলচাতুরীর পরও পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়ে যায় ১৬০টি আসন। গণপরিষদে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৭টি সংরক্ষিত আসনেও জয় পায় আওয়ামী লীগ। (সূত্র: লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মেজর রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম, পৃষ্ঠা-৫২)।

এরপর ভোটে নিরঙ্কুশ জয়ের ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো মানুষের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রতিনিধিদের ছয় দফাভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নে অনুগত থাকার জন্য শপথ পাঠ করান। একই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় বঙ্গবন্ধুকে গণপরিষদের নেতা এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপনেতা নির্বাচিত করা হয়।

একই সভায় অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে চিফ হুইপ এবং আবদুল মান্নান ও এম আমীর-উল ইসলামকে নির্বাচিত করা হয় হুইপ। এ অবস্থায় ইয়াহিয়া খান ঢাকায় ৩ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন।

তবে ১ মার্চ ঢাকার সময় ১টা ৫ মিনিটে আকস্মিকভাবে রেডিও পাকিস্তান ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা প্রচার করলো যে, ‘পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের নেতাদের মধ্যে দুঃখজনক মতবিরোধের কারণে পরবর্তী তারিখ ঘোষণা না করা পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হলো।’ (সূত্র: লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মেজর রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম, পৃষ্ঠা-৫৯)।

মূলত শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা না করেই ভুট্টোর দাবি মেনে নিয়ে ইয়াহিয়া খান গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন। যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণেও বলেছেন। এদিকে ইয়াহিয়ার প্রতারণামূলক এ ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে হাজার মাইলে দূরে থাকা পূর্ব পাকিস্তান। অনেকে রাস্তায় নেমে পড়ে।

এরই মাঝে বাঙালি জাতির মাঝে রচিত হলো অভূতপূর্ব এক ঐক্যের ভিত। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গড়ে উঠলো অটুট বন্ধন। তখন ছয় দফা নয়, এক দফা-বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ে গর্জে ওঠে সবাই। তখন বাঙালির মুখে মুখে স্লোগান-

‘ছয় দফা না এক দফা/ এক দফা, এক দফা
পিন্ডি না ঢাকা/ ঢাকা, ঢাকা
তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা
তুমি কে আমি কে/ বাঙালি বাঙালি
বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’

এ অবস্থায় ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ওই সমাবেশে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন। পাশাপাশি জনগণকে সার্বিক আন্দোলন, অসহযোগ এবং যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। (সূত্র: একাত্তরের মার্চ থেকে প্রবাসী সরকার, এম আমীর-উল ইসলাম, প্রকাশ ২৬ মার্চ ২০১৫)।

ঐতিহাসিক সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘… রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে এবং বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করে। ফলে একাত্তরে মুক্ত মুজিবের চেয়েও বন্দী মুজিব আরও অনেক বড় অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিলেন। তাই তো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নানা সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনায় রণাঙ্গণে যুদ্ধ করে বাঙলার দামাল ছেলেরা একেকটি বড় বড় অপারেশনে সাফল্য পেয়েছেন। ‘জয় বাংলা স্লোগানে’ পত পত করে উড়িয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা।

সীমিত সামর্থ্যের মাঝে মুজিবনগর সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রশাসন পরিচালনা করেছে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওই সরকার এক কোটির বেশি শরণার্থীর জন্য ত্রাণ, দেশের অভ্যন্তর থেকে লাখ লাখ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা-যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে; যা পাকিস্তানিদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করেছিল।

একই সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখা, বিশ্ব জনমত গঠনসহ বিভিন্ন অবিস্মরণীয় কীর্তি সম্পন্ন করেন ওই সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা; যা সমকালীন বিচারে অতুলনীয় ও অবিস্মরণীয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর অবস্থিত ছিল কলকাতার ৯ সার্কাস এভিনিউয়ে। সেখান থেকেই মূলত কূটনীতিক কার্যাবলী সম্পাদিত হতো। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের এইড অ্যান্ড অ্যাডভাইজার ছিলেন ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম।

যুদ্ধদিনের সরকার পরিচালনার নানা কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেছেন তার বিভিন্ন স্মৃতিচারণামূলক লেখায়ও। তিনি লিখেছেন, … বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতির আবেদন জানিয়ে সে সময়কার ১০৭টি দেশের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠির সঙ্গে পাঠানো হয় তিনটি করে সংযুক্তি – বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং লস কন্টিনিউয়েন্স অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট অর্ডার।

‘… পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। যুত্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স ও যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটসহ সর্বত্র তাঁর (বঙ্গবন্ধু) নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় স্থান পায়। বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তা সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি থেকে শুরু করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে যে দাবি ও চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সে ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত।’

২০২১ সালে মুজিবনগর সরকারের পঞ্চাশবছর পূর্তি হবে। চলতি বছর ২০২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। যা বাঙালির জীবনের একটি আনন্দঘন ও গৌরবময় বিষয়।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০-২১ সালে সরকার ঘোষিত ‘মুজিববর্ষে’ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এড়াতে এসব অনুষ্ঠানমালা স্থগিত করা হয়েছে।

গতবছরের ডিসেম্বরের দিকে চীনের উহান শহরে দেখা দিলেও এখন তা বৈশ্বিক আতঙ্কের নাম। পাশ্চাত্য কী প্রাচ্য-সবাই আক্রান্ত। দেশে দেশে লকডাউন। পৃথিবীর মানুষ আজ ঘরবন্দি। পুরো পৃথিবী যেন স্থবির হয়ে আছে। মৃতের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে বেশ আগেই। বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি।

বাংলাদেশেও বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। অনেকে মারাও গেছেন। এ অবস্থায় সঙ্কটে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। তবে বাংলাদেশে শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর ও নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার।

কোভিড-১৯ এর কারণে এরই মধ্যে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের কথা বিবেচনা করে মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়েছে এবং তা সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে এসব কার্যক্রম তিনি নিজে তদারকি করছেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১০ এপ্রিল এই দুযোর্গে মানবিক সহায়তার জন্য আরও সাড়ে নয় হাজার মেট্রিক টন চাল, সোয়া ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এর আগে ৬৪ জেলায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ৫৬ হাজার ৫৬৭ মেট্রিক টন চাল এবং ২২ কোটি ১৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়।
একাত্তরে জীবন বিপন্ন করে বাঙলার দামাল ছেলেরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ফলে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। এবার এই দুর্যোগ মুহূর্তে জীবন বিপন্ন করে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের সেবা-চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন নার্স-ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা।

দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, স্বাস্থ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়-বিভাগ এবং অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান।

এ অবস্থায় আমাদের উচিত হবে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। পাশাপাশি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলা, ঘরে অবস্থান করা এবং মনোবল ধরে রেখে এেেক অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ ও সহযোগিতা করা।

এছঅড়া আমাদের অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনার আলোকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি ও শিষ্টাচারসমূহ। চীন

আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অবশ্যই এই মহামারির অবসান ঘটবে। আবারও চিরাচরিত নিয়মে জেগে ওঠবে বিশ্ব অর্থনীতি। চাঞ্চল্য ফিরে আসবে শহর-নগরে। নতুনভাবে আসবে বিশ্ব। নতুন সেই পৃথিবীতেও হেসে-খেলে জীবনের জয়গান গেয়ে যাবে মানুষ।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় আমরা মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনায় যেভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, এ মহামারিতেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তার যুগোযোপযোগী পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমরা করোনামুক্ত বাংলাদেশ গড়বো, ইনশাল্লাহ।

লেখক: শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।