কর্মগুণেই যাদের ‘পছন্দ’ করেন প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিতঃ 9:30 am | April 22, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ধাপে ধাপে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই কনফারেন্সে যুক্ত হচ্ছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, মসজিদের ইমাম, ব্যবসায়ী নেতাসহ গুরুত্বপূর্ণ পেশার লোকজন।

প্রতিটি জেলার বাস্তব চিত্র সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যেমন জানছেন তেমনি প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও প্রদান করছেন। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহেই জনপ্রতিনিধি বা অন্যদের কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। প্রতিটি ভিডিও কনফারেন্স সঞ্চালনা করছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস।

এই ভিডিও কনফারেন্সে প্রত্যেকের বক্তব্যই অনেক ধৈর্য্য নিয়েই শোনছেন প্রধানমন্ত্রী। এজন্য কম করে হলেও তিন ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হচ্ছে তাকে। প্রতিটি ধাপেই বক্তার সংখ্যা দীর্ঘ হলেও কোন কোন বক্তা আবার প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা পেয়েছেন।

প্রতিটি ভিডিও কনফারেন্সে মন্ত্রী, সংসদ সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব দিয়েছেন তৃণমূলকে। সোমবারের (২০ এপ্রিল) ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৮ জেলার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সেও প্রধানমন্ত্রী নিজেই জামালপুরের উদাহরণ টেনে বিষয়টি পরিস্কার করেছেন এভাবে- ‘জামালপুরে আমাদের অনেক কেন্দ্রীয় নেতারাই আছেন।

কাজেই কোন অসুবিধা নাই। না, আমি এখন তাদের সঙ্গে কথা বলবো না। তাদের সঙ্গে আমার সব সময়ই কথা হয়। যাদের সঙ্গে কথা হয় না, তাদের সঙ্গে কথা বলছি।’

তিন ঘন্টাব্যাপী এই ভিডিও কনফারেন্সে রসিকতা করেও অনেক বক্তাকেই প্রধানমন্ত্রী কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। কোন কোন বক্তার নাম প্রধানমন্ত্রী নিজেই আবার প্রস্তাব করেছেন। বক্তব্য না রাখলেও প্রধানমন্ত্রী কোন কোন জনপ্রতিনিধির নামও গুরুত্বের সঙ্গেই উপস্থাপন করেছেন।

এতে করে তাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর প্রগাঢ় স্নেহই প্রকারান্তরে সামনে চলে এসেছে। আবার কারও কারও সাহসী বক্তব্যও প্রধানমন্ত্রী মুগ্ধ হয়েই শোনেছেন।

হুইপ আতিউর রহমান আতিক
শেরপুর-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে চারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক। দশম জাতীয় সংসদে তিনি হুইপ নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে কলেজ ছাত্র সংসদে ভিপি নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। টানা তিনবার নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। প্রধানমন্ত্রী তাকে স্নেহ করেন।

নিজ জেলা শেরপুরে ভিডিও কনফারেন্সে জেলা প্রশাসক (ডিসি) আনার কলি মাহাবুব যখন প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের হুইপ মহোদয় একটু কথা বলতে চান।’ উত্তরে হেসে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শনিবার কথা বললাম। আধা ঘন্টা কথা বলেছি।’

তখন হুইপ আতিক হাত তুলে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দলের পক্ষ থেকে একটু বলি।’ এরপর প্রধানমন্ত্রী রসিকতা করে বলেন, ‘আচ্ছা বলো। ও তো (হুইপ) কথা না বলে থাকতে পারে না।’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনেকেই তখন হেসে উঠেন।

প্রধানমন্ত্রীকে প্রথমেই মুজিববর্ষ ও নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে আতিউর রহমান আতিক এমপি বলেন, ‘আমি সংক্ষিপ্ত কথা বলেছি। শনিবারও আপনার (প্রধানমন্ত্রী) কাছে অনেক কথা বলে এসেছিলাম।’ এবারও প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘লিখে দিছো প্রস্তাব, চিঠি দিয়েছো তো।’

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু
ময়মনসিংহ পৌরসভার ইতিহাসের ‘সেরা মেয়র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় মো. ইকরামুল হক টিটুকে। টানা সাড়ে ৯ বছর ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র হিসেবে দায়িত্বে থেকে নগরবাসীর কাঙ্খিত ও স্বপ্নের শহর বিনির্মাণে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।

এ সময়ে নগরীতে পরিকল্পিত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের সেতুবন্ধন রচনা, তাদের মূল্যায়নসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনেও তিনি নজির স্থাপন করেন। ফলশ্রুতিতে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে কোন হেভিওয়েট আমলার পরিবর্তে তাকেই বেছে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের এই সহ-সভাপতিকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দলীয় মনোনয়নও দেন তিনি। বরাবরই মেয়র টিটুর ইতিবাচক নানা পদক্ষেপ ও কর্মকান্ডে সন্তুষ্ট প্রধানমন্ত্রী। পূর্ণ আস্থাও রেখেছেন সব সময়। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আপত্য স্নেহই ময়মনসিংহের রাজনীতিতে টিটুকে ‘ফ্যাক্টর’ করে তুলেছে।

সোমবারের (২০ এপ্রিল) ময়মনসিংহ জেলার সঙ্গে যখন সংযুক্ত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তখন হঠাৎ করেই মেয়র ইকরামুল হক টিটুর নাম উচ্চারিত হয় গণভবন প্রান্তে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মেয়রের সাথে ফোনে কথা বলেছি। মেয়র সাহেবের সঙ্গে সেদিনই কথা হলো।’ প্রধানমন্ত্রী তিন দফা মেয়রের বিষয়ে নিজের ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেন।

এর আগে গত মাসে মুজিববর্ষ উপলক্ষে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে কথা বলেন মেয়র ইকরামুল হক টিটু। এ সময় নগরীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্য টিটু’র প্রশংসা করেন তিনি।

টাঙ্গাইলের জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ফারুক
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক টাঙ্গাইলের জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ফারুক। তিনি টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। ছিলেন সংসদ সদস্যও। ইতিহাসের মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সরাসরি রাজনীতি করেছেন। নিজের জীবন সায়াহ্নেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগকে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাকে সম্মান ও পছন্দ করেন। ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী টাঙ্গাইলে যুক্ত হলে নিজেই জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ফারুকের সঙ্গে কথা বলতে চান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক ভাই আছেন। ফারুক ভাই একটু কথা বলেন।’ এরপর ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, ‘মহামান্য প্রধানমন্ত্রী, আমার বয়স হয়ে গেছে। আমি বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য পেয়েছি, ধন্য হয়েছি। এই বয়সে আপনার দুরদর্শীতা, তেজোদীপ্ত সাহস বিশ্ব নেতৃত্বের দরবারে যে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে গেলো, আমি মরার আগে এটা দেখে অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি।’

‘আপনি যে পরিমাণ দীপ্ততা নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন সারা দেশের কোন পৃথিবীর কোন নেতা এটা করেনি। এজন্য আপনাকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা।’ এরপর কবির ভাষায় ‘জয় হবে জয় হবে, হবে জয়, মানবের তরে মাটির পৃথিবী, দানবের নয়, কবিতা উচ্চারণকালে প্রধানমন্ত্রী তার প্রশংসা করেন।

গাজীপুরের এসপি শামসুন্নাহার
চাঁদপুরের এসপি হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন শিল্পায়নের জেলা হিসেবে পরিচিত গাজীপুরের জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) শামসুন্নাহার। বাংলাদেশ পুলিশ প্যারেডে নেতৃত্বদানকারী প্রথম নারী পুলিশ কর্মকর্তা তিনি। নিজের পুলিশ বাহিনীতেও তিনি স্বনামে খ্যাত।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনে বাস্তবচিত্র তুলে ধরে তিনি প্রশংসা পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী গাজীপুরে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে এসপি শামসুন্নাহারের সঙ্গে কথা বলতে চান। এসপি তার বক্তৃতায় জেলায় লকডাউনের বাস্তব চিত্রগুলো তুলে ধরেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোযোগ দিয়ে এসপির কথাগুলো শোনেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তাকে আশস্ত করেন। গাজীপুরের লকডাউন নিশ্চিত করতে গিয়ে জেলা পুলিশ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে উল্লেখ করে পুলিশ সুপার (এসপি) শামসুন্নাহার বলেছেন, ‘যে কারখানাগুলো খোলা রয়েছে তারা কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। অনেক ব্যবসায়ী সুযোগ নিচ্ছেন।

পিপিই বানানোর কথা বলে শ্রমিকদের ডেকে এনে অন্য পণ্য বানাচ্ছেন। আবার এমনও অনেক মালিক রয়েছেন, যারা বেতন দেবেন বলে শ্রমিকদের ডেকে নিয়ে আসছেন। গাজীপুরে অনেক ভাসমান মানুষ রয়েছে। এটা লকডাউন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেক বড় অন্তরায়। তাদের ঘরে রাখতে হলে অবশ্যই ত্রাণ সঠিকভাবে বিতরণ করতে হবে।’

দীর্ঘ ভিডিও কনফারেন্সে গাজীপুর পুলিশ সুপারের বক্তৃতাই সেরা বলে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মত প্রকাশ করেছেন। অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারীর ওয়ালেই দেখা গেছে গাজীপুর পুলিশ সুপারকে নিয়ে প্রশংসামূলক মন্তব্য। সবাই তার সাহসিকতারও বিষয়টিকেও ফোকাস করেছেন।

কালের আলো/এমসি/আরআর