কুয়েত-মালদ্বীপকে সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী; কেন চাওয়া হবে ভারতের সেনা?

প্রকাশিতঃ 10:25 pm | April 24, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

কোভিড-১৯ ‘ত্রাস’ ছড়াচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতেও। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও ভয়াল সংক্রমণ থেকে দেশটির মানুষকে রক্ষা করতে উদ্বিগ্ন কুয়েত সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ খালিদ আল-খদর ফোন করলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে। ঘটনাটি মাসখানেক আগের।

সেদিনের ফোনালাপে তিনি চিকিৎসা সরঞ্জামাদি, মেডিকেল টিম ও কোয়ারেন্টাইন সেন্টার পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বাত্নক সহযোগিতা চাইলেন।

বন্ধুপ্রতীম দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের এমন অনুরোধের কথা সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ পৌঁছে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে।

মানবিক প্রধানমন্ত্রীর বুদ্ধিমত্তার প্রখরতা আবারও চোখে পড়লো। বিশ্বনেতার মতোই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। ব্যস, কথা অনুযায়ী তড়িৎ কাজ।

১০০ জনের সেনা মেডিকেল টিম ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নিয়ে শুক্রবার (১০ এপ্রিল) বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে উড়ে গেলো বিমান বাহিনীর একটি স্পেশাল কার্গো বিমান।

দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যকার বন্ধুত্বের নির্দশনস্বরূপ তাদের কাছে ‘উপহার’ হিসেবে পাঠানো হলো প্রয়োজনীয় মেডিকেল কিট।

বিপদে বন্ধুর পরিচয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এমন বন্ধুত্বে আবেগে আন্দোলিত যেন কুয়েতের নিউজ চ্যানেলসমূহ। তারা সেদিন ফলাও করে প্রচার করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এমন মহানুভবতার কথা।

শুধু কী তাই? কুয়েতে দু’টি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারও পরিচালিত করছেন বাংলাদেশী সেনা চিকিৎসকরা। তাদের কর্মদক্ষতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার গল্পও সেখানকার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।

একই রকম ঘটনা ঘটেছে পর্যটন সম্ভাবনা জাগানিয়া দেশ মালদ্বীপের ক্ষেত্রেও। করোনার থাবায় আক্রান্ত দেশটির ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স’র চীফ অব ডিফেন্স ফোর্স মেজর জেনারেল আবদুল্লাহ সামাল দিন কয়েক আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের কাছে মেডিকেলসহ আনুসাঙ্গিক সহায়তার জন্য লিখিতভাবে অনুরোধ জানান।

সেনাপ্রধান বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের অনুরোধের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। বন্ধু রাষ্ট্রের আহ্বানে তাৎক্ষণিক সাড়া দেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে প্রয়োজনীয় জরুরি ওষুধ, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা সামগ্রী পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, জীবাণুনাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও নৌ বাহিনীর জাহাজে করে ৮৫ টন খাদ্য সামগ্রী গত বুধবার (১৫ এপ্রিল) পৌছে দেওয়া হয়।

বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্কের দৃষ্টান্ত থেমে নেই এখানেই। বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের কাছে অনুরোধের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মালদ্বীপে চিকিৎসা সহযোগিতার জন্য সেনাবাহিনীর ১০ সদস্যের মেডিকেল টিম পাঠানো হয়।

গত সোমবার (২০ এপ্রিল) বিমান বাহিনীর একটি সি-১৩০ জে পরিবহন বিমানে বাংলাদেশ ও নেপালে অবস্থানরত মালদ্বীপের ৭১ জন নাগরিককেও দেশটিতে পৌঁছে দেওয়া হয়।

এসবের মাধ্যমেই পাশের দেশের সঙ্গে ভাতৃত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়কসুলভ সুগভীর প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে বুধবার (২২ এপ্রিল) মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মুহাম্মদ সলিহ টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

এই দেশটিতেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১০ সদস্যের অভিজ্ঞ চিকিৎসক টিম করোনা সংক্রমণ রোধে তাদের নাগরিকদের সর্বোচ্চ সেবা দিচ্ছেন; স্থাপন করছেন মানবিকতার অনন্য নজির।

মরুর দেশ কুয়েত আর দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপকে করোনার মরণ ছোবল থেকে রক্ষা করতে যেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্যরা তাদের আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

এবং বিশ্বে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন সেই সময় বাংলাদেশে ভারতীয় সেনা সহায়তার আজগুবি ও বিভ্রান্তিকর এক খবরে হাস্যরসের পাশাপাশি জনমনে ক্ষোভও তৈরি হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) থেকে ইন্টারনেটের পর্দা ছেঁয়ে যাওয়া একটি খবর হচ্ছে- ‘প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সামর্থ্য বৃদ্ধিতে সহায়তার জন্য বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর দল পাঠাচ্ছে ভারত।’

এই খবরের সত্যতা ও সূত্র যাচাই না করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফেসবুক ও টুইটার ব্যবহারকারীদের অনেকেই সেটি প্রচার করছেন।

তবে প্রকৃত সত্য হচ্ছে, করোনা রোধে বাংলাদেশ এখনও প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছে এমন কোন মেডিকেল সহায়তাই চায়নি। একটি চিহ্নিত চক্র ভারতকে নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ‘জল ঘোলা’ করতেই পরিকল্পিতভাবেই এমন ‘ভূয়া’ খবর তৈরি করেছে।

আবার, দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের হৃদয়গ্রোথিত আবেগ-ভালোবাসার বিষয়টি মাথায় রেখেই সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিতভাবেই কোন বিশেষ মহল এমন খবর ছড়িয়ে দিচ্ছে কীনা সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে।

অবশ্য করোনাভাইরাসকে ঘিরে দেশে একের পর এক গুজবের মধ্যে মাথাচাড়া দেওয়া এমন নতুন গুজবের কোন ভিত্তি নেই বলেই মনে করছেন সরকারের নীতি নির্ধারকরা। ইতোমধ্যেই ভিত্তিহীন এই বিষয়টিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।

গণমাধ্যমকে তিনি সাফ সাফ বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসের আক্রমণ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীই অন্য দু’টি দেশকে সহায়তা করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য আসছে এমন কোনো তথ্যও আমার জানা নেই।’

জানা যায়, দেশের জনগণের অবিচ্ছেদ্য অংশ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময় প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলাসহ দেশের আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভয়-শঙ্কা ও প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে জাতিগত বিরোধে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পিছিয়ে পড়া দেশসমূহে সাধারণ মানুষের আস্থা-বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে ঠাঁই করে নিয়েছেন লাল-সবুজের দেশের গর্বিত সেনা সদস্যরা।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণ রোধে সরকারের নির্দেশে সামাজিক দূরত্ব ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতে দেশের ৬২ টি জেলাতেই কোমরবেঁধে মাঠে নেমেছেন সেনা সদস্যরা।

সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি নিত্য নতুন স্টাইলে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতাও দেশজুড়েই প্রশংসা কুড়িয়েছে।

একই সূত্র জানায়, করোনার মতোন মহামারি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পর্যাপ্ত চিকিৎসক, মেডিকেল কোর ও পর্যাপ্ত মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট রয়েছে। সক্ষমতা রয়েছে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরিরও।

আছে নিজস্ব ৫ টি মোবাইল হাসপাতাল। এছাড়া প্রয়োজনে ৩ ঘন্টার মধ্যে যে কোন জায়গায় ৫০ বেডের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠারও সক্ষমতা আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বিশ্বব্যাপী উদাহরণ হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার করোনা মোকাবেলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারস্থ হয়েছে আদতে এমন ফেক নিউজের নুন্যতম কোন ভিত্তিই নেই। এই বিষয়টিও মোটা দাগে প্রমাণিত হয়েছে।

বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আগমনের মিথ্যাচার সম্বলিত খবরের কড়া প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে কালের আলো’র নিউজরুমে ফোন করেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফেরদৌস আলম। তরুণ এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘সারা বিশ্বে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি বিনির্মাণ করেছেন দেশপ্রেমিক সেনারা।

আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ যে কোন সংকটময় মুহুর্তেই দেশ ও মানবতার স্বার্থেই তারা ‘ত্রাতা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন বারবার।

যেখানে আমরাই অন্যদের সহায়তা করছি, সেখানে আমাদের সেনাদের কর্মদক্ষতাকে হেয় করতেই উদ্দেশ্যেপ্রণোদিতভাবে এমন খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’

এই অপপ্রচারের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়ে সংক্ষুব্ধ রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে বাহাউদ্দিন হারুন কালের আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য এলাকায় পাহাড় ধস, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল, বজ্রপাত, ভূমিকম্পসহ সব রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশী সেনাদের অবদান অনস্বীকার্য।

এমন আধুনিক, যুগোপযোগী ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী থাকতে করোনা মোকাবেলায় পড়শি দেশের সেনাদের সহায়তার প্রয়োজন পড়বে এমন খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এটি শতভাগ ফেক পোস্ট।’

রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় বসবাসরত কলেজ শিক্ষক বদরুজ্জামান মিয়া কালের আলোকে বলেন, ‘আমরা আধুনিক যুগে বসবাস করলেও এখনও আমাদের চিন্তা আর মননে আধুনিকতার ছোঁয়া স্পর্শ করেনি। গুজব রটিয়ে অনেকেই গুজব খাচ্ছে।

নানা কায়দায় মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সারা বিশ্বে আমাদের সেনাবাহিনীর সক্ষমতা ও দক্ষতা প্রমাণিত। সেখানে সামাজিক মাধ্যমে এমন খবর হাস্যকর।’

রাজনৈতিক সুবিধা ও বিদ্বেষ ছড়াতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ঘিরে এমন ভূয়া খবর তৈরি করা হচ্ছে অভিযোগের মাধ্যমে নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বগুড়ার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে শামসুজ্জোহা সরকার কালের আলোকে বলেন, ‘গুজবের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে ফেসবুক।

অথচ ফেসবুকের কোন পোস্ট দেখেই অনেকেই অবলীলায় বিশ্বাস করে। নামসর্বস্ব বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালও ভূয়া, ভিত্তিহীন খবর প্রচার করে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে।’

দেশ গুজব নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় প্রতিনিয়তই এর বিস্তার ঘটছে বলেই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, ‘সব খবরই নির্ভরযোগ্য নয়, সেটা বুঝতে হবে।

টেলিভিশন কিংবা বিশ্বস্ত নিউজ পোর্টাল থেকে কোনো তথ্য না পেয়ে তা ফেসবুকে ছড়ানো যাবে না। গুজব প্রতিরোধে আমাদের এই কাজগুলো গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করতে হবে।’

কালের আলো/আরআইএ/এমএএএমকে