রক্তপাতহীন করোনার লড়াইয়ে তাঁরা ‘ক্লান্তিহীন বীর’

প্রকাশিতঃ 8:13 pm | April 27, 2020

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

প্রতিষেধকহীন করোনার থাবায় গোটা বিশ্ব থমকে দাঁড়িয়েছে। সংক্রমণের আশঙ্কায় হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করে বিরোধী  দলের রাজনীতিকরাও। সতর্ক পা ফেলছেন সরকার দলের মন্ত্রীরাও। কোথাও কারও দেখা মিলছে না।

কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, স্বজনের মায়া ত্যাগ করে করোনার বিরুদ্ধে রক্তপাতহীন লড়াইয়ে কিছু মানুষ ছুটছেন ক্লান্তিহীন। সামনে থেকে তাঁরা লড়াই করে যাচ্ছেন। তারা প্রত্যেকেই জনপ্রতিনিধি। নিজ নিজ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সাহসী এসব মানুষ অন্যের জন্য সামনে থেকে লড়াই করে দেশজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

দেশের ক্রান্তিকালে পিছু না হটে, মানবসেবায় নিজেদের সঁপে দিয়েছেন দিনরাত। নির্ঘুম রাত, ব্যস্ত দিনে তারা রচনা করছেন মানবতার জয়গাঁথা। এসব জনপ্রতিনিধির কেউ নিজের ওয়ার্ডের অসহায় ও দুস্থ বাসিন্দাদের এক মাস যাবত বিনামূল্যে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। নিজের হাতেই জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটানোর কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

আবার কোন জনপ্রতিনিধি করোনাভাইরাস বা এর উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফন/সৎকারে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

কেউ কেউ করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই এলাকাবাসীকে ঘরে থাকতে উৎসাহিত করতে বাড়ি বাড়ি হরেক রকমের সবজি নিয়ে হাজির হচ্ছেন।  

ডিএনসিসির কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডবাসীর ভাগ্যে শিঁকেয় ছিঁড়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো তারা পেয়েছেন প্রকৃত অর্থেই ‘মানব দরদী’ একজন কাউন্সিলর। তাঁর নাম আসিফ আহমেদ।

তিনিই সেই কাউন্সিলর যিনি করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই এলাকাবাসীর সুরক্ষায় নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাঝে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ও সাবান বিতরণ করেছেন। আবার কারও জন্য অপেক্ষা না করে নিজ হাতেই জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটানোর কার্যক্রমও পরিচালনা করেছেন।

নিজের কাজে কর্মে স্বচ্ছতা রাখতে সব সময়ই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কাউন্সিলর আসিফ। সম্প্রতি ডিএনসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে প্রধানমন্ত্রী দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য তাঁর উপহার হিসেবে চাল পাঠান। আসিফ নিজের ফেসবুক ওয়ালে সেই বিষয়টি ঘোষণা দেন এবং চালের বস্তাসহ চালের পরিমাণের কথা উল্লেখ করেন।

আসিফ সেই সময় লিখেন : ‘ধন্যবাদ মাদার অফ হিউম্যানিটি, বঙ্গকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমার ওয়ার্ডের সাধারণ জনগণের জন্য এই দুর্যোগ মুহুর্তে অসামান্য উপহার দেওয়ার জন্য। মোট ৭ হাজার ২৫১ কেজি চাল পাঠানোর জন্য।’

তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা যেখানে ত্রাণের চাল আত্নসাতের নামে বারবার সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে ঠিক সেই সময়ে আসিফের মতোন কাউন্সিলররা উল্টো স্রোতে গা ভাসিয়ে সরকারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করেছেন।

শুধু তাই নয়, গত এক মাস যাবত নিজের ওয়ার্ডের প্রায় ৩’শ মানুষজনকে নিজের উদ্যোগে খাবার সহায়তাও দিয়ে আসছেন আসিফ। দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমে ইতোমধ্যেই সচিত্র সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আপনাদের খাবার পৌঁছাব আমি। জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি এবং ফোন নম্বর পাঠান’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) একটি সেল ফোন নম্বর (+৮৮০১৮৮৮২০০২০০) দিয়ে বার্তা দিচ্ছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ।

চার দিন আগে থেকে বলে দেওয়া হচ্ছে ভেন্যুর ঠিকানা। সে অনুযায়ী জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে দেওয়া হচ্ছে খাদ্য সহায়তা। এ বিষয়ে কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ বলেন, প্রায় এক মাস যাবত আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৩০০ জনকে ৫ কেজি চাল, ১ কেজি ডাল, এক কেজি সয়াবিন, সাবান এক প্যাকেট ও ৫ কেজি আলু দিয়ে আসছি। এখন সন্ধ্যার পর প্রতিদিন ৭০ জনকে খাদ্য সহায়তা দিবো।

আসিফের ঘনিষ্ঠরা জানান, ফেসবুকে দেওয়া ওই সেলফোন নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার এবং সিগনাল অ্যাপসে   এলাকাবাসী তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, পেশা এবং ফোন নম্বর পাঠাচ্ছেন।

পরবর্তীতে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে ত্রাণের জন্য তালিকা প্রস্তুত করেন কাউন্সিলর আসিফ। সেই তালিকা ধরেই বাসাবাড়ি, বস্তি, ঘাটারচর, বছিলা, বেড়িবাঁধ, কাঁটাসুর এলাকায় ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে মাঝে মাঝেই ফেসবুক লাইভে অংশ নেওয়ায় এলাকার সমস্যা সম্পর্কেও অবহিত হচ্ছেন।

কাউন্সিলর আসিফ আরও বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক বিত্তশালীর কাছ থেকে খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করেছি। কারও এনআইডি না থাকলে ড্রাইভিং লাইসেন্স কিংবা জন্ম সনদ নেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের ৭০ লাখ টাকার অপেক্ষা করছি আমি। ওই টাকা পেলেই তা এলাকাবাসীর মধ্যে বিতরণ করা হবে।

ডিএসসিসির কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান আসাদ
নিজ ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের ঘরে থাকতে উৎসাহিত করতে বাড়ি বাড়ি হরেক রকম সবজি নিয়ে হাজির হচ্ছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান আসাদ।

প্রয়োজনীয় দুই প্রকার সবজি যে কেউ বিনামূল্যে নিতে পারবেন। এমন উদ্যোগ নিয়ে তিনি আলোচনায় এসেছেন।

করোনাভাইরাসের দাপট শুরুর পর থেকেই নিজ এলাকার বাসিন্দাদের রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েন এই কাউন্সিলর। এলাকার প্রতিটি বাসায় নিজ উদ্যোগে জীবাণুনাশক স্প্রে করেন। প্রতিটি রাস্তা ও অলিগলিতেও স্প্রে করা হয় জীবাণুনাশক।

টানা কয়েকদিন দুই বেলা ছিন্নমূল ও নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করেন। একই সঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য ঘরে ঘরে চাল, ডাল, আলুসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করেন।

ইতোমধ্যে ওয়ার্ডটির প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে হাত ধোয়ার জন্য সাবান ও বাচ্চাদের জন্য বিস্কুট।

কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, নিয়ম অনুযায়ী আমি এখনও দায়িত্ব বুঝে পাইনি। তবুও দায়বদ্ধতা থেকেই করোনার শুরু থেকেই মানুষের পাশে নানা ধরনের সেবা নিয়ে হাজির হয়েছি।

তিনি বলেন, প্রথমে সচেতনতা তৈরি করেছি তার পর দুঃস্থদের মাঝে খাবার ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, বাড়ি বাড়ি জীবাণুনাশক ছিটিয়েছি। এখন বাসায় বিনামূল্যে সবজি দিচ্ছি। একটু কষ্ট হলেও যাতে মানুষ বাজারে যাতায়াত থেকে বিরত থাকে। কারণ বাজার এ করোনা সংক্রামিত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

নাসিক কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খোরশেদ
করোনাভাইরাস বা এর উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফন/সৎকার এখন স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই করোনা-উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ার খবরও গোপন রাখার চেষ্টা হচ্ছে। চিকিৎসক থেকে সন্তান-স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই যখন করোনা-সংক্রমণের ভয়ে আত্মরক্ষায় দূরে দূরে তখন এগিয়ে আসছেন একজন।

এসব লাশ দাফন/সৎকারে ত্রাতার ভূমিকায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তিনি। তাঁর নাম মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। তিনি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।

গত ৮ এপ্রিল নগরের জামতলা এলাকায় আফতাবউদ্দিন (৬০) নামে এক ব্যক্তির লাশ ঘরে ফেলে রেখে পরিবারের লোকজন অন্যত্র চলে যায়। খবর পেয়ে ছুটে যান খোরশেদ। লাশ মাসদাইর কবরস্থানে নিয়ে গোসল করানোর পর ৩ সহযোগীকে নিয়ে জানাজা পড়েন। নিজেরাই কবর খুঁড়ে দাফন করেন।

জানা যায়, করোনা এবং এর উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে ৩১ জনের দাফন/সৎকার হয়েছে খোরশেদের নেতৃত্বে। পরিবারের কোনো পুরুষ এগিয়ে না আসায় গত ১৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শ্মশানে এক ব্যক্তির মুখাগ্নি করেছেন তিনি। এ সময় মৃত ব্যক্তির এক মেয়ে উপস্থিত ছিলেন।  

দল মত নির্বিশেষে সবার প্রশংসা পাচ্ছেন খোরশেদ। স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমান তাকে ‘বীর বাহাদুর’ আখ্যা দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান খোরশেদকে ফোন করে তার কর্মকান্ডের প্রশংসা করেছেন ও উৎসাহ দিয়েছেন।

কুমিল্লার কাউন্সিলর সাদি
কুমিল্লার ১১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর আল আমিন সাদি। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই ওয়ার্ডের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষজনের মাঝে খাবার সামগ্রী বিতরণ করছেন। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও চলছে চাল ডাল তেল পেঁয়াজসহ কাঁচা সবজি বিতরণ।

কাউন্সিলর হাবিবুর আল আমিন সাদি জানান, করোনা মহামারি রূপে দেখা দিয়েছে। এ সময়ে আমার ওয়ার্ডের অনেকের কাজ নেই। তাদের মাঝে খাবার বিতরণ করা আমার দায়িত্ব।

আমি গত ৩৭ দিন আমার ওয়ার্ডের নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে খাবার সামগ্রী বিতরণ করছি। সরকারি সহায়তা ছাড়াও আমার ব্যক্তিগত অর্থায়নে খাবার সামগ্রী বিতরণ করছি। তিনি জানান, যতদিন করোনা সংক্রমণ থাকবে, আমার ওয়ার্ডবাসীর মাঝে ততদিন খাবার সামগ্রী বিতরণ করব।

কালের আলো/এসআর/সিএইচ