বস্তা কাঁধে নীরবে হাঁটছেন সেনারা, চেনা সেই হাসি অসহায়ের মুখে
প্রকাশিতঃ 7:59 pm | May 01, 2020
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
মাথার ওপর স্বচ্ছ আকাশ। জনমানবহীন দূরের এক বিল। সুনসান নীরব পরিবেশ। বিলের এপাশ থেকে ওপাশের দেখার সুযোগ নেই। পেছনে চোখ জুড়ানো সবুজের আস্ফালন।
বিলের মাঝখানে থাকা সাঁকো পেরিয়ে নীরবে হেঁটে যাচ্ছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সবার কাঁধে এক একটি বস্তা। বজায় রাখছেন সামাজিক দূরত্ব।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সদা দাপিয়ে বেড়ানো মানুষ ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিলেও সরকারের নির্দেশে জীবনবাজি রেখেই লড়াই করে যাচ্ছেন তারা।
গরিব, দুস্থ ও অসহায় মানুষের মুখে আহার তুলে দিতে তাদের দূয়ারে দূয়ারে গিয়ে কড়া নাড়ছেন। নিজেরা কষ্ট করে প্রাণচাঞ্চল্যতার হাসি ফুটাচ্ছেন তাদের মুখে।
ধ্বংস ঠেকিয়ে নতুন দিনের আভাস জাগিয়ে রাখার এ চিত্রটি কোন রঙতুলির আচড়ে নয়। বাস্তব এ চিত্রকর্মটি কক্সবাজারের একটি গ্রামের। শুক্রবার (০১ মে) বিকেলে কালের আলো’র হাতে এসেছে এমন ছবিটি।
আত্নবিশ্বাসী ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী সেনা সদস্যরা নিজেদের রেশন থেকে সাশ্রয় করে করোনায় কর্মহীন অভাবী মানুষদের কাছে তাদের ‘ভালোবাসার উপহার’ হিসেবে এসব খাদ্য সামগ্রী তুলে দিচ্ছেন নিত্যদিন। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের নাম।
অজানা অচেনা করোনাভাইরাসের ভয়াবহতায় হিমশিম বিশ্বে আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন, স্থবির ও অচল সবকিছু। মানুষের জীবনের মূল্যকেই সবাই বড় করে দেখছেন। কিন্তু এই মহাদুর্যোগেও মানবতার টানে অতীতের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই নির্ভীকচিত্তে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর করোনা সঙ্কটেও তাদের অবদান ঐতিহাসিক। সামাজিক দূরত্ব বা হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতের বৃত্তের ভেতরই নিজেদের বন্দি না করে মানবিক হৃদয় নিয়েই দেশের প্রতিটি জেলায় জেলায় করোনার ছোবলে নি:স্ব, অভাবী ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশে সেনারা নিজেদের সমর্পণ করেছেন।
করোনার সর্বনাশা আঘাতে বিশ্ব মানবতা এখন এক মোহনায় মিলিত হয়েছে। সরকারের নির্দেশে প্রায় এক মাস যাবত দেশের ৬২ টি জেলায় সক্রিয় রয়েছেন সেনা সদস্যরা। তারা বেসামরিক প্রশাসনকে সর্বাত্নক সহযোগিতা দিচ্ছেন।
মাঠে থাকা সেনা সদস্যদের ধৈর্য্য, সহনশীলতা ও সৎ সাহসের পরিচয় দিয়ে জনগণের পাশে থেকে তাদের আস্থা অর্জনের কঠোর বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।
নিজের ১৬ দফা নির্দেশনায় স্পষ্ট ভাষায় তিনি বলেছেন, ‘করোনা ভয়ে আমরা এক ইঞ্চিও পিছু হটবো না।
জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে আমরা আমাদের পেশাদারীত্ব, সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবো।’
আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের (আর্টডক) ২১ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহমুদুল হাসান কালের আলোকে বলেন, ‘মাননীয় সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ মহোদয়ের নির্দেশনায় এবং আর্টডকের (জিওসি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ মহোদয়ের গাইড লাইনে আমরা নিজেরা কম খেয়ে আমাদের রেশনের টাকায় গরিব ও অসহায় মানুষের মাঝে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছি।’
তিনি জানান, আর্টডকের ব্যবস্থাপনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে গত কয়েক দিনে প্রায় ৪ হাজার পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। অনায়েসে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ তারা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই খাবার খেতে পারছেন। খাবারের সন্ধানে এই সময়ে তাদের আর বাইরে বের হওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না।
করোনা মহাপ্রলয়ে ধ্বংস ঠেকিয়ে নতুন দিনের আভাস জাগিয়ে রাখছেন গর্বিত সেনারা। প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে ভয়কে জয় করার মানসে নতুন করে জেগে উঠার প্রেরণাও দিচ্ছেন অসহায় মানুষজনকে।
নিজেরা কখনও নৌকায় করে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিচ্ছেন। মানুষের তরে সর্বোচ্চ কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করলেও বিরক্তি নেই বিন্দুমাত্র!
আকাশের সাদা মেঘ উধাও হয়ে ছাইরঙা মেঘে ঢাকা পড়লেও ভ্রুক্ষেপ নেই সেনা সদস্যদের মাঝে। ঝড়-বৃষ্টি অন্ধকার রাতেও সব ঝক্কি মোকাবেলা করেই অভাবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের কুঠিরে খাবার পৌঁছে দিতে পেরেই পরম আত্নতৃপ্তি অনুভব করছেন, বলছিলেন গর্বিত এক সেনা সদস্য।
রাজধানীর ভাসানটেক এলাকায় ত্রাণের গাড়ি থেকে ত্রাণসামগ্রী নামাচ্ছিলেন সেনা সদস্যরা। এরপর একটি ভ্যানে সেই খাবার নিয়ে নিজেরা ভ্যান চালিয়ে দুর্গম এলাকায় ঢুকে পড়ছেন।
এবড়ো থেবড়ো সড়কে কোথাও ভ্যান আটকে গেলে পেছন থেকে অন্যরা ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দিচ্ছেন। মানবতার জন্য এমন পরিশ্রমেই সব সময় অভ্যস্ত সেনারা বলছিলেন, ভ্যান চালানোর দায়িত্বে থাকা সেনা সদস্যটি।
তিনি বলেন, ‘সেনাপ্রধান স্যারের নির্দেশে নিজেদের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জনকল্যাণের মানসিকতা নিয়েই আমরা কাজ করছি। করোনার ভেতরেও অপার সম্ভাবনার দিকে, স্বপ্নের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সাহস-শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছি।’
দেশের মানুষের জীবন সুরক্ষার মহান আদর্শের বাতি জ্বলে উঠেছে দেশপ্রেমিক সেনাদের হৃদয়ে-মননে। মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাতির জরুরি প্রয়োজনে নিজেদের মেধা দক্ষতা সৃজনশীলতার মহিমায় বরাবরই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
করোনা ক্রাইসিসেও যেন তারা একই সঙ্গে যোদ্ধা এবং শান্তির প্রবক্তা হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছেন। তাদের এমন গৌরবগাঁথা থাকবে চির অম্লান।
কালের আলো/এসআর/এমএএএমকে