প্রচলিত ধ্যান-ধারণা পাল্টে কালজয়ী মানবতার উজ্জ্বল আভায় সেনাবাহিনী

প্রকাশিতঃ 12:57 pm | May 17, 2020

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো :

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই চোখের সামনে ভেসে আসে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবনবাজি রাখা দেশপ্রেমিক এক বাহিনী। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা কিংবা ভোটের মাঠে সরকারি নির্দেশে ভয়-শঙ্কা দূর করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতেই তৎপরতা চালানোরও নজিরও রয়েছে জাতির এই সূর্য সন্তানদের।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আভিযানিক দক্ষতা ও সক্ষমতাতেও দু:সাহসী এ সেনারাই সেরাদের সেরা। দেশের সেবায় আত্ননিয়োগের সংকল্পে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল এই বাহিনী হাল সময়ে প্রচলিত সব ধারণা পাল্টে কালজয়ী নতুন চেহারায় নিজেদের উপস্থাপন করেছেন।

অতীতে বন্দুক উঁচিয়ে কঠোর মানসিকতার সেনাবাহিনী এবার করোনার মহাদুর্যোগে নিজেদের সম্পর্কিত প্রচলিত সব ধ্যান-ধারণাই আমুল বদলে দিয়েছেন। ‘মানবতার জননী’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই সৃজন-মননের সন্নিবেশে বহুমাত্রিক কাজের মাধ্যমেই মানবতার উজ্জ্বল আভায় বিনির্মাণ করেছেন নিজেদের।

সুবিশাল মহাসমুদ্রের ঔদার্য্যে সমাজ জীবনে পুরনো প্রচলিত রীতি ভেঙে নতুন নতুন কনসেপ্ট সামনে এনেছেন। হৃদয় দিয়েই যেন কিনেছেন দু:খ ভারাক্রান্ত, জীবন যুদ্ধে থমকে দাঁড়ানো অর্ধাহার-অনাহারে থাকা মানুষের হৃদয়।

মানবতা, মনুষ্যত্ব আর নিজেদের ঐক্যের মহান ঐতিহ্য ধারণ করেই নীরবে পথ চলেছেন ৫৬ হাজারের বর্গমাইলে। করোনা সঙ্কটেও মানবতার টানে অসহায়, দুস্থ ও কর্মহীন মানুষকে পরম মমতার চাদরে পরশ বুলিয়েছেন।

গরিব ও অভাবী মানুষের জীবনের কঠিন বিপদসংকুল সময়ে পাশে থেকে মানবতা ও মনুষ্যত্বের মহোত্তম সঙ্গীতে কন্ঠ মিলিয়ে মহাকালের বিশাল ক্যানভাস রাঙিয়েছেন।

দেশ-কালের গন্ডি পেরিয়ে নিজেদের কীর্তি ও কৃতিত্বে বিশ্ব মানবতার ইতিহাসের পাতায় কীভাবে ঠাঁই করে নিতে হয় সেটিও চোখ বরাবর আঙুল রেখেই যেন দেখিয়ে দিয়েছেন সবাইকে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের কূশলী-বিচক্ষণ নেতৃত্ব, নিবিড় মনিটরিং আর দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনায় মানবিক মূল্যবোধের অপূর্ব সমন্বয়ে করোনা দুর্যোগে নতুন নতুন ভাবনা চিন্তার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিকেও কাজে লাগিয়েছেন।

অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সম্মিলিত প্রয়াসে সুরক্ষিত করেছেন সতের কোটির বাংলাদেশকে।

দেশজুড়ে সামাজিক দূরত্ব আর হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতের নিয়মতান্ত্রিক কাজের বাইরেও হুড়োহুড়ি বা বিশৃঙ্খলার যবনিকাপাত ঘটিয়ে ছেড়েছেন।

নির্জন রাতে দরজায় দরজায় গিয়ে খাবার পৌঁছে দেওয়ার নতুন প্রথাও চালু করেছেন দেশের প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত মানুষের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ানো বাহিনীটির গর্বিত সদস্যরা।

নিজেদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন নানা দিকে, নানা প্রান্তে।

শারীরিক দূরত্ব বজায়ে বৃত্তের মাধ্যমে দূরত্ব চিহ্নিত, বাজারে বা গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জীবাণুনাশক ট্যানেল, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেটিফিকেশনের (আরএফআইডি) মাধ্যমে খাবার সহায়তা, বিনামূল্যে পছন্দনীয় সব সবজির সমাহারে এক মিনিটের বাজার, প্রান্তিক কৃষকের লোকসান ঠেকাতে সবজি কিনে আবার দুস্থদের সরবরাহ করা ইত্যাকার থিউরিরও উদ্ভাবক সেনাবাহিনীই।

নিজেদের সৃষ্টিশীলতা, অদম্য মনোবল, সাহস, কর্মদক্ষতা, নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে প্রায় দেড় মাসে সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন, কুতুবদিয়া থেকে তেতুলিয়ায় সেনাবাহিনী জাতির প্রয়োজনে বেসামরিক প্রশাসনকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তার পাশাপাশি কার্যকর ভূমিকারও সুনাম ছড়িয়েছে।

দেশমাতৃকার সার্বিক সেবায় মহান ব্রত নিয়েই করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে বীরদর্পেই।

গরিব, কর্মহীন ও অসহায় মানুষের মুখে আহার তুলে দিতে ত্রাণ বিতরণে বিশৃঙ্খলাই যখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন এ মানবিক সহায়তা কার্যক্রমেও নতুন কর্মপদ্ধতি চালু করে সেনাবাহিনী। সুশৃঙ্খলভাবে ত্রাণ বিতরণের জন্য জেলায় জেলায় গ্রহণ করে পাইলট প্রকল্প।

মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেটিফিকেশনের (আরএফআইডি) কার্ডের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করে সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের পদ্মা সেতুর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড।

নিজেদের রেশনের টাকায় তালিকা অনুযায়ী নিত্যপণ্য সামগ্রী কখনও নদী পেরিয়ে আবার পিচঢালা সড়ক বা গ্রামীণ আঁকাবাঁকা সড়ক মাড়িয়ে নীরবে-নিভৃতে দিনমান বা রাতে বাড়ির চৌহদ্দিতে পৌঁছে দিয়েও সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

মাত্র এক মাসেই কমপক্ষে ২০ হাজার অসহায় মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। ইতোমধ্যেই দুই দিনে প্রায় দুই হাজার গরিব অসহায় মানুষ ‘এক মিনিটের বাজার’ থেকে চাল, ডাল, সবজিসহ সবকিছুই পেয়েছেন উপহার হিসেবে।

বন্দর নগরী চট্টগ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষজনকে ডাটাবেইজের আওতায় আনা হচ্ছে প্রথমে। পরে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে টোকেন। সেই টোকেনের মাধ্যমেই মাত্র এক মিনিটেই পাচ্ছেন সবজিসহ রকমারি পণ্য। পরম মমতায় আপনজনের মতোই তাদের হাতে দেওয়া হচ্ছে এসব সামগ্রী।

অনন্য এ আয়োজন প্রকৃত অর্থেই জীবন বাস্তবতার কঠিন এই সময়ে বেঁচে থাকার নিয়ামক। হুইল চেয়ারে বন্দি জীবনের মানুষজনও পাচ্ছেন পেটের দায় মেটানোর পণ্য সামগ্রী।

সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানোর পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করা ও সামাজিক দূরত্বের কঠোর অনুশাসন মানার মডেলও হয়ে উঠেছে এক মিনিটের বাজার।

চট্টগ্রামের এ মডেল প্রশংসিত হওয়ার পর রাঙ্গামাটিতে সাড়া ফেলেছে অভিনব এ বাজার। এতে খুশি সেখানকার অসহায় মানুষও। এসব বাজারের মাধ্যমে আবার কৃষকদেরও স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। করোনায় সবজির বাজারে ধ্বস নামার ঘটনায় ক্ষোভের অনলে পুড়তে থাকা কৃষকদেরও স্বস্তির উপলক্ষ্য এনে দিয়েছে সেনা সদস্যরা।

কারণ, এক মিনিটের বাজারের কেজি কেজি সবজি কেনা হচ্ছে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকেই, ন্যায্যমূল্যে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রংপুর, যশোরসহ প্রায় প্রতিটি জেলাতেই কৃষকদের বাঁচাতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে দেশের আস্থা ও গর্বের প্রতীক বাহিনীটির সদস্যরা।

সম্প্রতি সেনাবাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিংদের (জিওসি) সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও কনফারেন্সে গরিব, দুস্থ ও অসহায় মানুষের মাঝে নিজেদের রেশনের একাংশ বাঁচিয়ে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন বাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ে ফসলের মাঠের নায়কদের আর্থিকভাবে লাভবান করতেই তাদের কাছ থেকে সবজি সংগ্রহ করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অসহায়ের হাতে তুলে দেওয়ারও ‘গাইড লাইন’ দিয়েছেন।

সময়োপযোগী এসব নির্দেশনার মাধ্যমে কৃষকের সঙ্গে অভাবী মানুষজনও উপকৃত হচ্ছে। যুগান্তকারী এমন পদক্ষেপ আরও একবার জনমানসে সেনাবাহিনীর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকাকেই মোটা দাগে উপস্থাপন করেছে।

সৃজনশীলতা, মানবিকতা ও মূল্যবোধের মাধ্যমে করোনার দহন দিনে টালমাটাল দেশকে অন্ধকার সরিয়ে আলোর পথে নিয়ে যেতে ক্লান্তিহীনভাবেই কাজ করে যাচ্ছে আপোসহীন ও রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত মানুষকে সুরক্ষার এই যুদ্ধে সেনারা ঋজু ও অমল কন্ঠেই অবিচল রয়েছেন। দেশ ও দেশের মানুষের প্রশ্নে তাদের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সততা প্রাণিত করেছে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে।

আশা-নিরাশার সকাল, দোলাচলের দুপুর পেরিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর সোনালী সন্ধা বা গহীন রাতেও বাঙালির চিত্ত, মন ও মানসিকতায় গভীরভাবেই প্রোথিত হয়ে থাকবে দেশপ্রেমিক সেনাদের নাম।

কবির ভাষায় কন্ঠে কন্ঠেই যেন গুঞ্জণ-গুঞ্জরিত হবে- ‘বল বীর/বল উন্নত মম শির!’ চৌকস ও সুশৃঙ্খল সেনাদের জন্য ভালোবাসা অবিরাম।

কালের আলো/এমএএএমকে