উপেক্ষা ‘ঈদ আনন্দ’; আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলবাসীর পাশেই থাকছে সেনাবাহিনী
প্রকাশিতঃ 9:26 am | May 24, 2020
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা মরিয়ম বেগমের দুনিয়ায় আপন বলতে নেই কেউ। অনেক আগেই হারিয়েছেন স্বামীকে। ছেলেরা থেকেও নেই যেন! এখানকার সবার মতো তাকেও প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করেই টিকে থাকতে হচ্ছে বছরের পর বছর।
নিস্তরঙ্গ জীবনে নিজের ভিটেমাটির শেষ সম্বল ঘরটিতে থাকেন একাই। এরই মধ্যে ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড় আম্পান উড়িয়ে নিয়েছে তাঁর মাথাগোঁজার ঠাঁই। জীবনের গোধূলী বেলায় এক রাতের তান্ডবেই ‘গৃহহীন’ হতে হয়েছে মরিয়মকে।
চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরটি ঠিকঠাক করে দেওয়ার জন্য অনেকের দূয়ারেই ধর্ণা দিয়েছেন। হয়নি সমস্যার সমাধান। হতভাগ্য বয়োবৃদ্ধার কঠিন এমন বাস্তবতার বিষয়টি সেনা সদস্যদের কর্ণকুহরে পৌঁছেছে।
‘দশে মিলে করি কাজ’ নীতি নিয়ে তারা নিজেদের উদ্যোগেই বাঁশ ও নতুন টিন কিনে হাতে হাতে নির্মাণ করে দিয়েছেন ঘর।
চিত্রটি নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার কেতকিবাড়ী গ্রামের। মাত্র দুই দিনেই নিজের বসতঘরটি ফিরে পেয়ে আপ্লুত কন্ঠস্বরে মরিয়ম বেগম কালের আলোকে বলেন, ‘বিপদে কেউ পাশে থাকে না, এই কথা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
সেনাবাহিনীর সৈনিকরা আমার ঘর বানিয়ে দিয়েছে। আমাকে বাঁচার পথ দেখিয়েছে। আল্লাহই ওদের সহায় হবেন।’
প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে বাগেরহাটের শরণখোলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুলনার কয়রাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে।
এসব এলাকায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের জন্য পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছেন সেনা সদস্যরা। ইতোমধ্যেই এলাকাগুলোতে বাঁধ মেরামত প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন প্রায় হাজারখানেক সদস্য।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে তুমুল তান্ডব চালিয়ে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেওয়া ‘সুপার সাইক্লোন’ আম্পান পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় এলাকাসমূহে দুর্গতদের ঘরদোর মেরামত থেকে শুরু করে বাঁধ মেরামত, মেডিক্যাল টিমের মাধ্যমে দূয়ারে দূয়ারে স্বাস্থ্যসেবা, পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন ও ত্রাণ বিতরণ সবকিছুই এক হাতে সামাল দিচ্ছে প্রশিক্ষিত, নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক সেনারা।
বিশেষ করে ঈদকে ঘিরে যখন করোনার ভয়াবহতার মাঝেও নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার হিড়িক পড়েছে তখন অসহায় উপকূলবাসীর সহায় হয়েই নিজেদের
‘ঈদ আনন্দ’ উপেক্ষা করেই মাঠে সক্রিয় থাকবেন সেনা সদস্যরা। এ যেন সেবাতেই এক রকমের ঈদ আনন্দের ‘পূর্ণতা’!
উপকূলীয় এলাকায় ‘রাউন্ড দ্যা ক্লক’ কর্মযজ্ঞ
ক্ষেতের ফসল, মাছের ঘের, ঘরবাড়ি, হাঁস-মুরগি- সব হারিয়ে নি:স্ব উপকূলের এসব মানুষকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকেই আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাতে সেনা সদস্যরা তাদের নিরন্তর সংগ্রামে সহযাত্রী করেছেন নিজেদের।
করোনা সঙ্কটের ধারাবাহিকতায় বুকে প্রত্যয় আর সাহস নিয়ে আবারও আম্পান দুর্যোগ মোকাবেলাতেও ত্যাগের সমুদ্রে ভাসিয়েছেন সৈনিক জীবনের তরী।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও সার্বক্ষণিক নির্দেশনায় মানবতা, মনুষ্যত্ব আর ঐক্যের মহান ঐতিহ্য ধারণ করেই উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ‘রাউন্ড দ্যা ক্লক’ এমন কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন সেনা সদস্যরা।
যশোর সদর উপজেলার ফুলবাড়িয়া এলাকার আব্দুর রহিম কিংবা জরিনা বেগমের পাশেও সৎ সাহসের পরিচয় দিয়ে মানবিক হৃদয় নিয়েই দাঁড়িয়েছেন যশোর ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা। ঝড়ে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত ঘর কেবল মেরামতই নয়, আহারের জন্য খাবারও দিয়েছেন তারাই।
সেনা সদস্যদের এমন মানবিকতায় জরিনার চোখ জলে টইটুম্বর। আঁখি মুছতে মুছতে কালের আলোকে বলছিলেন এমন-‘প্রতিবন্ধী নাতিকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকতো হতো।
আল্লাহ রহমত করছে, বিপদের বন্ধু হিসেবে সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে। আমার ঘর ঠিক করে দিয়েছে। এই উপকার কোনদিন ভুলবো না।’
মরিয়ম, জরিনা বা আব্দুর রহিমেরই ভাষ্যই কী কেবল এমন? বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, নোয়াখালী, নীলফামারী, যশোরসহ গোটা উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে মহাঘূর্ণিঝড় আম্পানের ভয়ঙ্কর থাবায় পর্যদুস্ত হয়ে এখানকার বেশিরভাগ মানুষই গৃহহীন হয়েছেন।
কাঁচা-পাকা লক্ষাধিকের বেশি ঘরবাড়ি হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। আবার কোথাও তলিয়ে গেছে বাঁধ, ফসলের ক্ষেত, মাছের ঘের এমনকি বিস্তীর্ণ এলাকা। শক্তিশালী আম্পান শক্তি হারিয়ে বিদায় নিয়েছে। তবে এক রাতের ঝড় কেড়ে নিয়েছে, ডুবিয়ে দিয়েছে কোটি মানুষের স্বপ্ন।
সেনাপ্রধানের নির্দেশে অন্য রকম এক লড়াই
গোটা উপকূলীয় এলাকাসমূহে এখন কেবলই আম্পানের ভয়ঙ্কর ক্ষতচিহ্ন। বিষাদে ভরেছে উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মন। সবার মাঝেই যেন ভয়, হতাশা আর হারানোর যন্ত্রণা।
কিন্তু সেই ক্ষত কাটিয়ে তুলতে নব উদ্যমে উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের জাগিয়ে তুলতে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের নির্দেশে অন্য রকম এক লড়াইয়ে নিজেদের সমর্পণ করেছেন সেনা সদস্যরা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তেজোদীপ্ত, নির্ভীক ও লড়াকু সৈনিকরা কাজ করছেন দিন-রাত একাকার করেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র কালের আলোকে জানিয়েছে, সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের সার্বক্ষণিক নির্দেশনায় মানবতা, মনুষ্যত্ব আর ঐক্যের মহান ঐতিহ্য ধারণ করেই পরিশ্রমী ও বুদ্ধিদীপ্ত সেনারা উপকূলীয় এলাকাগুলোতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছেন।
দক্ষতার সঙ্গেই অসহায় মানুষের ঘরবাড়ির পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও মেরামত করে দিচ্ছেন, মানবিকবোধে জাগ্রত হয়েই।
দুর্গত এলাকায় ইতোমধ্যেই সেনাবাহিনী প্রায় ১১ হাজার পরিবারকে খাবার সহায়তা যেমনি দিয়েছে তেমনি ভবিষ্যতের সহায়তার জন্যও প্রস্তুত করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৮১৪ প্যাকেট খাবার।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা
অতীতেও বন্যা, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৎ ও গর্বিত সদস্যদের।
দেশের সীমানা ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও নিজেদের কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রেখে স্থাপন করেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত। নিজেদের একাগ্রতা, কর্মদক্ষতা ও নানাবিধ জনসেবামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন সার্বজনীন আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা।
করোনাকালে উপকূলের ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের কাছে আক্ষরিক অর্থেই তারা হয়ে উঠেছেন ‘বিপদের বন্ধু’।
আবারও সামনে থেকে নেতৃত্বে সেনারা
বিষাদে ভরপুর উপকূলের বাসিন্দাদের আড়মোড়া ভেঙে পুরোপুরি চাঙ্গা করতেই চলমান এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রশিক্ষিত ও সৃশঙ্খল সেনা সদস্যরা।
পাশাপাশি অসীম ধৈর্য্য ও শতভাগ পেশাদারিত্বের মাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতেও মানুষকে উৎসাহিত করছেন।
নিজেদের রেশনের একাংশের টাকায় খাবার ও আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি দুর্গত এলাকায় দিচ্ছেন চিকিৎসা সেবাও। প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে। কোথায় কী সমস্যা হচ্ছে সবকিছুই খোঁজ খবর রাখছেন সমান তালেই।
পুরো কর্মতৎপরতা মনিটরিং করে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের প্রয়োজনীয় ‘গাইড লাইন’ দিচ্ছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।
এক নজরে তৎপরতার সারসংক্ষেপ
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, আম্পান দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনীর ১৪৬টি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দল স্বল্প সময়ে মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
দুর্যোগ উপদ্রুত এলাকাগুলোতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত রয়েছে এ বাহিনীর ৭৬টি মেডিক্যাল টিমও।
সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুলনার কয়রা ও বাগেরহাটের শরণখোলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতে কার্যক্রম শুরু করেছে সেনাবাহিনী। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ১০ হাজার ৭৫০ টি জিও ব্যাগ সংগ্রহ করা হয়েছে।
স্থানীয় কয়রায় ভেঙে যাওয়া হরিণখোলা, উত্তরবেদকাশি গাজীপাড়া ও রত্মাঘেরি এলাকার বাঁধ মেরামতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নসহ দুটি ব্যাটালিয়নের ৩৫০ জন সদস্য।
বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করতে খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালীতে একটি করে পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে। একই সঙ্গে দুর্যোগ উপদ্রুত এলাকাসমূহে বিশুদ্ধ খাবার পানি প্রদানের জন্য ১৩টি ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্ল্যান্ট ও ১৪টি ওয়াটার বাউজার প্রস্তুত সেনারা প্রস্তুত করেছেন।
একই সূত্র মতে, বগুড়া, পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, মেহেরপুর ও জয়পুরহাটে ৮ টি, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, চাঁদপুর, নোয়াখালীসহ উপকূলীয় এলাকাসমূহে ২০ টি মেডিকেল টিম বিনামূল্যে মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছেন।
প্রায় এক হাজার ৩’শ মানুষকে দুর্যোগ উপদ্রুত এলাকায় দেওয়া হয়েছে চিকিৎসা সহায়তা। এসব এলাকায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সহায়তা প্রদানে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আরও ৭৩টি মেডিক্যাল টিম।
কালের আলো/এসআরএস/এমএএএমকে