ঈদের দিনেও ‘রুটিন ওয়ার্কে’ সেনাবাহিনী, ছড়িয়েছে প্রীতি ও ভালোবাসার পরাগ

প্রকাশিতঃ 9:29 am | May 26, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

আনন্দ আর খুশির পরিবর্তে বিষাদময় এক দিন। ভীষণ অন্য রকম এক ঈদ। একদিকে করোনার ভয়াল সংক্রমণ অন্যদিকে মহাঘূর্ণিঝড় আম্পানে সব হারানোর ক্ষত।

আনন্দের বদলে বেদনা, উৎসবের পরিবর্তে রীতিমতো টিকে থাকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ দেশ।

‘বিবর্ণ’ ঈদের জামাত শেষে কোলাকুলি, করমর্দন না করার কাজে তদারকি, পথচারীদের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত, যানবাহনে তল্লাশি, গরিব ও দুস্থ মানুষের আহারের বন্দোবস্ত, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, লন্ডভন্ড উপকূলের বাসিন্দাদের ঘরদোর মেরামতের কাজ- সবকিছুই সমান তালেই সামলেছেন।

অভাবী ও অসহায় মানুষের চোখের কোণে সামান্য হলেও হাসির ঝিলিক দিতেই অন্য দিনগুলোর মতোই তাদের পাশে থেকেছেন। সহমর্মিতা ও হৃদ্যতার আলো বিলিয়েছেন।

নিজেদের পরিবার ছেড়ে রাজধানী থেকে শুরু করে তৃণমূলের নিভৃত পল্লীতেও ছুটেছেন; ছড়িয়েছেন প্রীতি ও ভালোবাসার পরাগ।

‘ঘরবন্দি’ এবারের ঈদে সোমবার (২৫ মে) সকাল থেকে মধ্যরাত করোনাকালের এমন রুটিন ওয়ার্কেই নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

দেশের ঘোর দু:সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জেলায় জেলায় চষে বেড়িয়ে সহমর্মিতা ও মানবতার মাধ্যমেই প্রতিটি প্রান্তেই মলিন চেহারায় ফুটিয়েছেন অনাবিল আনন্দের আবহ। ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর করেছেন নিজেদের।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ সব সময়ই বল এসেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ‘টিম স্পিরিট’ নিয়েই লড়াই চালিয়ে যাবে সেনা সদস্যরা।

ঈদের শুভেচ্ছাতেও বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আসুন আমরা সুস্থ থাকি, অপরকে সুস্থ থাকতে সহায়তা করি।’

নিজের ঈদের দিনটিও সার্বক্ষণিক দুর্গত মানুষের খোঁজ খবর নিয়েছেন সেনাপ্রধান। আবার গরিব ও অসহায় মানুষের উনুনে আগুন জ্বালাতে সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের।

ঈদের দিনেও আত্নত্যাগের অনুশীলনে দেশবাসীকে সুরক্ষা আর উপকূল অঞ্চলের ভাগ্যবিড়ম্বিতদের সহযোগিতার হাত বাড়ানোর দায়িত্বে অনড় থেকে মানুষে মানুষে কল্যাণের বার্তাই বিলিয়ে দিতে নিজ বাহিনীর দায়িত্বশীল সদস্যদের সৎনিষ্ঠ চেতনাবোধকেই পুনরায় প্রজ্বলিত করেছেন জেনারেল আজিজ আহমেদ।

ঈদের দিনেও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত
দেশের লাখো মানুষের ‘আমিন’ ধ্বনিতে প্রতি ঈদেই মুখরিত হতো যে জাতীয় ঈদগাহ, এবার প্রথম বারেরর মতোই বন্ধ রইলো তাঁর দরজা। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় রাজধানীর এ ময়দানে হয়নি দেশের প্রধান ঈদ জামাত।

তবে মসজিদে মসজিদে অনুষ্ঠিত ঈদ জামাতের আগে-পরে রাজধানীতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে ঠিকই অন্য দিনের মতোই কাজ চালিয়ে গেছে সেনা সদস্যরা।

একই রকম চিত্র ছিল বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। নিজেরা মাইকিং করে নামাজে আসা মুসল্লি ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করেছেন।

ঈদের নামাজ পড়তে আসা এবং শেষে বাড়ি ফেরা মুসল্লিরা যাতে কোনো রকম করমর্দন কিংবা কোলাকুলি না করে সেটি তদারকি করতে সকাল থেকেই বিভিন্ন জেলায় টহল তৎপরতা চালিয়েছে সেনাবাহিনীর একাধিক টিম।

যানবাহনে থাকা চালক বা যাত্রীদের মাস্ক পরতে বাধ্য করেছেন। শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করেই ঈদ আনন্দ উপভোগে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন।

বাড়ি বাড়ি ত্রাণ তৎপরতা
উপকূলীয় জেলা বরিশালেও রীতিমতো তান্ডব দেখিয়ে গেছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। বিধ্বস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি, সড়ক। বিষাদের ঈদে অনেকের ঘরে জ্বলেনি চুলো। সেই দিকেও ঈদের দিনে নিজেদের দৃষ্টি দিয়েছেন সেনা সদস্যরা।

সড়কবিহীন গ্রামে উপড়ে পড়া কলাগাছের ফাঁকে হেঁটেই কাঁধে খাবারের বস্তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ‘উপহার’ যেমন দিয়ে এসেছেন তেমনি কোথাও বাড়ির সামনে কোমর সমান পানিতে ডুবে অসহায় ও দু:খী মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন নিজেদের রেশনের একাংশের টাকায় বন্দোবস্ত করা খাবার।

রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষজনও একইভাবে পেয়েছেন এ মানবিক সহযোগিতা। ‘দুর্গতদের পাশে সর্বদা সেনাবাহিনী’ স্লোগানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশনের উদ্যোগেও দুই বেলা আহার জোগানো, চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা মানুষজনের হাতে নিত্যপণ্য সামগ্রী তুলে দেওয়া হয়েছে।

সবমিলিয়ে গরিব ও অসহায়রা সেনাদের সহায়তায় সাধ্যমতো ভালো রান্না করে সন্তানের মুখে তুলে দিতে পেরেছেন তৃপ্তির খাবার। আবার পটুয়াখালীতে বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে চিকিৎসা সেবা।

কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের পরিচালনায় ও এডহক ১৬ প্যারা পদাতিক ব্যাটালিয়নের উদ্যোগে রোববার (২৪ মে) দ্বিতীয় দিনের মতো ঈদ বাজারের মাধ্যমে ৫’শ অসহায় মানুষকে খাবার ও নতুন কাপড় দেওয়া হয়েছে।

পঞ্চগড়ে বিভিন্ন রকম সচেতনতামুলক কাজের পাশাপাশি ঈদের দিনেও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এদিনেও অসহায় মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী ও দুস্থদের মাঝে ঈদ উপহার হিসেবে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেন সেনা সদস্যরা।

দুপুরে জেলা শহরের রামের ডাংগা ও পুরাতন ক্যাম্প এলাকায় শতাধিক মানুষের মাঝে এই খাদ্য সহায়তা বিতরণ করেন সেনা সদস্যরা। এ উপহারের প্যাকেটে ছিল- চাল, ডাল, তেল, চিনি, সেমাইসহ বিভিন্ন খাদ্য পণ্য। ঈদের দিনে সেনাবাহিনীর এমন উপহার পেয়ে খুশি স্থানীয় গরিব ও দুস্থরা।

মাথায় টিন বহনে সেনারা নিজেরাই
করোনায় এমনিতেই বিবর্ণ ঈদ। এরই মধ্যেই আম্পানের ভয়ঙ্কর থাবা উপকূলবাসীর জন্য ঈদকে পরিণত করেছে বিষাদে। নেই নতুন পোশাক বা ঈদের খাবার। খুলনার কয়রা এলাকায় তো পানির ভেতর ঈদের নামাজ আদায় হয়েছে।

ঘর বাড়ি জমি টিকিয়ে রাখতে ঈদের দিনেও চালানো হয়েছে বাঁধ রক্ষার কাজ। অনেকের ঘরে ছিল না সেমাই কেনার টাকা।

সেখানে নতুন পোশাক কেনার চিন্তাও যেন এক রকম বিলাসিতাই। ঠিক সেই সময়েই তাদের মাঝে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়েছেন সেনা সদস্যরা।

উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ঘরদোর মেরামতে নিজেরাই কাঁধে করে টিন বহন করে ছুটেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬৬ পদাতিক ডিভিশনসহ বিভিন্ন ডিভিশন নিজেদের উদ্যোগেই বাঁশ ও নতুন টিন কিনে হাতে হাতে নির্মাণ করে দিয়েছেন ঘর।

কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে