সিন্ডিকেটের কূটকৌশলেই ‘বদলী’ সিএমএসডি পরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বিএমএ-স্বাচিপ
প্রকাশিতঃ 8:36 am | May 29, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এখনও দৌরাত্ন কমেনি চিহ্নিত সেই মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু সিন্ডিকেটের। মন্ত্রণালয়টিতে সরকারি অর্থ লোপাটের মিশন নিয়ে আদাজল খেয়েই তৎপরতা চালাচ্ছে দীর্ঘদিনের সুবিধাভোগী ঘাপটি মেরে থাকা সিন্ডিকেটটি।
এমনকি কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) উচ্চমূল্যে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ কাজে বিশেষ সুবিধা করতে না পারায় এবার তাদের ‘টার্গেট’ হয়েছেন সংশ্লিষ্ট পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহিদ উল্লাহ।
দায়িত্বের মাত্র ৬ মাসের মাথায় ‘রহস্যময়’ বদলীর ‘দুর্ভাগ্য’ বরণ করতে হয়েছে তাকে। এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির দায়সারা ও অসম্পূর্ণ তদন্ত নিয়েও চলছে চরম বিতর্ক।
এসবের ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার পরিবর্তে জনপ্রশাসন থেকে একজন অতিরিক্ত সচিবকে পরিচালক নিয়োগ দেওয়ায় রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
অযৌক্তিক, অবাস্তব ও অনাকাঙ্খিত এ বদলী প্রত্যাহারের পাশাপাশি পদটিতে চিকিৎসক কর্মকর্তাকেই নিয়োগ দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)। ইতোমধ্যেই তারা জনপ্রশাসন সচিবকে এ বিষয়ে চিঠিও দিয়েছেন।
চিঠিটির অনুলিপি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবকেও দেওয়া হয়েছে। নিজেদের যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য দাবি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন বিএমএ ও স্বাচিপ নেতারা।
তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার বদলে চিকিৎসক কর্মকর্তাই সিএমএসডিতে বহাল থাকবেন।
জানা যায়, দেশে করোনা মহামারি আকার নেওয়ার আগে থেকেই প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু শুরু থেকেই এ যুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভূমিকা মোটা দাগে জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি করে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রথম দিকে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে পিপিই, মাস্কসহ অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রীর চাহিদা বা সরবরাহের পরিকল্পনার বিষয়েও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কোন ‘মাথাব্যাথা’ বা তোড়জোড় না থাকায় এক পর্যায়ে এসব সামগ্রী সরবরাহই বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
ওই সময়ে বেগতিক পরিস্থিতিতে যাতে সুরক্ষা সামগ্রীর কোন সঙ্কট তৈরি না হয় এজন্য নিজেদের উদ্যোগেই সুরক্ষা সামগ্রী মজুদ শুরু করে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)। পরে গত ১০ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক প্রায় ১৫ কোটি টাকার একটি চাহিদা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পিপিইসহ অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী পাঠাতে বলা হয় সিএমএসডিকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বাছাইকৃত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকেই মৌখিকভাবে পিপিইসহ অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী কিনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দেশের সব হাসপাতালে পাঠায় সিএমএসডি।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই একইভাবে ওইসব হাসপাতালে পাঠানো হয় ২০ টি নতুন পিসিআর ল্যাবের যন্ত্রপাতিও।
সেই সময় প্রতিদিন পিপিই’র গড় চাহিদা ছিল ৪০ হাজার থেকে ৭০ হাজার। মান নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক মনিটরিং টিম গঠন করে সিএমএসডি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোন পদ্ধতিতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে সুরক্ষা সামগ্রী কিনতে হবে, অর্থের সংস্থান আছে কীনা, স্পেসিফিকেশন কী হবে, কী পরিমাণ কিনতে হবে তার কোন নির্দেশনা দেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
পুরো বিষয়টিতে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মাঝে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
সুরক্ষা সামগ্রীর চাহিদা লাফিয়ে বাড়ার পর একেবারেই শেষ মুহুর্তে সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে পিপিআর-২০০৮’র আলোকে ডিপিএম পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী কেনার জন্য স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব সিএমএসডি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেন।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, কোভিড-১৯ যুদ্ধে সম্মুখ যোদ্ধা চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের জন্য মৌখিকভাবে ৯০০ কোটি টাকার সুরক্ষা সামগ্রী কেনা হলেও এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে মাত্র ১০০ কোটি টাকা। বারবার চিঠি চালাচালি হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় এখনও পর্যন্ত বাদ বাকী টাকার ব্যবস্থা করেনি।
সূত্র মতে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যকার দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ হয়ে উঠে স্বাস্থ্য সেক্টর জিম্মি করে রাখা মিঠুসহ তিনটি সিন্ডিকেট। মন্ত্রণালয়ের একজন প্রভাবশালী চেনা মুখকে ম্যানেজ করে উচ্চমূল্যে বিভিন্ন নিম্নমানের যন্ত্রপাতি মিঠুর পছন্দে কেনার একটি তালিকা মাস কয়েক আগে মন্ত্রণালয় থেকে অধিদপ্তরের অধীনস্থ সিএমএসডিতে পাঠানো হয়েছিল।
কিন্তু বেঁকে বসেন সিএমএসডি কর্তৃপক্ষ। ডিপিএম পদ্ধতিতে মিঠুর মেডিটেক ইমাজিং লিমিটেড মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বাদ পড়ে। এতে চরমভাবে ক্ষুব্ধ হন মিঠুসহ মন্ত্রণালয়ের সুবিধাভোগী সিন্ডিকেটটি।
তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বাছাইকৃত জেএমআই’র সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ককে ভুলবশত এন-৯৫ মাস্ক প্যাকেটে সরবরাহ করার বিষয়টিতে সিএমএসডি পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো.শহিদ উল্লাহকে জড়ানোর চেষ্টা করেন।
অভিযোগ রয়েছে, সিএমএসডি পরিচালক জেএমআই’র বিরুদ্ধে একাধিকবার কার্যকর অ্যাকশনে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদনে সেই বিষয়টি রীতিমতো আড়াল করা হয়েছে।
এমনকি অভিযুক্ত জেএমআই কোম্পানিতে না গিয়েই কেবলমাত্র মুগদা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য শুনেই দায়সারাভাবে সিন্ডিকেটের ‘ছকে’ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে বলেও বলাবলি হচ্ছে।
এর মাধ্যমে একজনের দোষ আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও মত দিয়েছেন অনেকেই। সিএমএসডি পরিচালককে ‘সাইজ’ করার জন্যই এমন ‘কূটকৌশল’ ফর্মুলা বাস্তবায়ন হয়েছে কীনা এ বিষয়টিও তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখার জোর দাবি উঠেছে।
অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তদন্ত কমিটির প্রধান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমান কালের আলোকে বলেন, ‘আমরা ৫ দিন সময় বেশি নিয়ে তদন্ত সম্পন্ন করেছি। তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই বুঝে শুনেই আমরা তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করেছি।’
এদিকে, মাত্র ৬ মাসের মাথায় সিএমএসডি পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো.শহিদ উল্লাহকে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে বদলী ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে সিএমএসডির পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়ায় চরম ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)।
এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তারা ইতোমধ্যেই জনপ্রশাসন সচিবকে চিঠি দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাচিপ সভাপতি ডা. এম ইকবাল আর্সলান কালের আলোকে বলেন, ‘সিএমএসডির পরিচালক পদটি একটি টেকনিক্যাল পদ। এটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠান।
নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী অধিদপ্তরের যত পরিচালকের পদ আছে সব টেকনিক্যাল পদ। এই পদগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে টেকনিক্যাল লোকদের নিয়োগ দিয়ে আসা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে একটি উদাহরণ টেনে ইকবাল আর্সলান আরও বলেন, ‘এর আগে ২০১৪-১৫ সালের দিকে এমন একটি আদেশ হয়েছিল। এইচআইভি এইডস কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর পদে একজন যুগ্মসচিবকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
সেটিকেও আমরা অশনিসংকেত হিসেবে মনে করেছিলাম। পরে আমাদের প্রতিবাদে আদেশটি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল।’
অভিন্ন মত পোষণ করেন স্বাচিপের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা: এম.এ.আজিজ। কালের আলোর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডার থেকে সিএমএসডির পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টিকে আমরা অশনি সংকেত হিসেবেই মনে করছি। অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে।’
একই বিষয়ে বিএমএ’র সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন কালের আলোকে বলেন, ‘সরকার যে কোন সময় যে কাউকে বদলী করতে পারে। কিন্তু এরপরেও একটি হিসাব থাকে কত বছর হলে কাকে বদলী করা যায়। আমি মনে করি সেই অর্থে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবেই বর্তমান পরিচালককে বদলী করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বদলী করে আবার প্রশাসন ক্যাডারকে দেওয়া এটি ঠিক নয়। আমরা আশাবাদী সরকার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে। আমরা এজন্য প্রধানমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে আছি। আমাদের বিশ্বাস এ পরিস্থিতি নিরসনে অতীতের মতোই বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন ।’
কালের আলো/এসআর/এমএইচ