ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিনকে সরাতে আর কত ডেটলাইন?
প্রকাশিতঃ 1:17 am | June 26, 2018
বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো:
সরকারি হাসপাতালে সুচিকিৎসা নিশ্চিতের স্বপ্নের নকশা প্রথমত নিজের মস্তিষ্কেই এঁকেছিলেন তিনি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন। উন্নতি ঘটিয়েছেন সেবার মানে। আচার-আচরণেও অনেক বেশি মানবিক হয়েছেন চিকিৎসকরা।
এক্সরে, আল্ট্রা, এমআরআইসহ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নেই বাইরে ছুটোছুটি। হাসপাতালের চার দেয়ালেই মিলছে সব। এবং নামমাত্র মূল্যে। কাঙ্খিত সেবায় ঝিকঝিকে হাসি নিয়েই রোগীরা ছাড়ছেন হাসপাতাল। এই অঞ্চলের প্রায় তিন কোটি মানুষকে চিকিৎসা সেবায় সাফল্যের সোনালি সূর্যোদয় দেখিয়েছেন তিনিই।
সাধারণ রোগী থেকে শুরু করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বাসিন্দাদের কাছে ‘ম্যাজিশিয়ান’ হিসেবে পরিচিত এ মানুষটির নাম নাছির উদ্দিন আহমেদ। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের পরিচালক। মাত্র দুই বছর আট মাসে পরিবর্তনের নায়ক এ ঝানু সেনা কর্মকর্তার কর্মযজ্ঞে অবশ্য অসন্তুষ্ট মহলও রীতিমতো করিৎকর্মা!
পরিচালকের শরীরে কথিত পনের কোটি টাকার দুর্নীতির কলঙ্ক কালিমা লেপনের মিশন তাদের। এক্ষেত্রে মোক্ষম হাতিয়ার তথ্য সন্ত্রাস। নিজেদের বাণিজ্যের স্বার্থে আঘাত করা পরিচালককে ঘায়েলে তাদের অস্ত্রের ভান্ডারে এবার শেষ কার্ড ‘লম্ফঝম্ফ’। ২১ জুন ডেটলাইন।
চিকিৎসক বদলী, ক্যান্টিন পরিচালনা, মাষ্টার রোলে কর্মচারী নিয়োগ বা মালামাল ক্রয়ে দাপট দেখানো চক্রটির প্রপাগান্ডা ২১ জুন পেরিয়ে এবার ২১ জুলাইয়ে গিয়ে ঠেকেছে। নব উদ্যমে তাদের কন্ঠে আওয়াজ সেদিনই আয়ু শেষ হবে সেনা কর্মকর্তা নাছির উদ্দিনের। দাঁড়ি টানতে হবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের আলোকিত অধ্যায়ের।
এক পেশাজীবী সংগঠনের নেতা ও তাঁর ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন গুটিকয়েক সদস্য বিশিষ্ট এই চক্রেরা হোতারা খিস্তিখেউর করছেন ‘কারো না কী সাধ্য নেই ওই সময়ের চেয়ে একদিন বেশি পরিচালককে স্বপদে বহাল রাখতে!’
এরপরই কথা ওঠেছে আর কত সহ্য করবেন ‘রোগী ও চিকিৎসক বান্ধব’ এই পরিচালক? হাসপাতালের স্বার্থ বিরোধী চক্রকে চপেটাঘাত না করে শান্ত ও সংযত হয়েই ২১ জুলাইয়ের ডেটলাইন নিয়ে মুখ খুলেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন আহমেদ। সোমবার (২৫ জুন) রাতে নিজের ফেসবুক ওয়ালে এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন- ‘আর কত ডেটলাইন দেয়া হবে? আমি বদলি হচ্ছি বলে একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে।
তাদের কথা অনুযায়ী সর্বশেষ ২১শে জুলাই আমাকে চলে যেতে হবে।’ এই স্ট্যাটাসে হয়তো ঈর্ষার আগুন ধিকিধিকি জ্বলে ওঠেছে পেশাজীবী চক্রটির মনে। সুবিবেচক পরিচালক স্ট্যাটাসের শেষ প্যারায় ষড়যন্ত্রকারীদের সনাক্ত করতে স্থানীয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপও প্রত্যাশা করেছেন।
তবে চিকিৎসা সেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপনের বদৌলতে চিকিৎসক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এবং ঐক্যবদ্ধ ময়মনসিংহবাসী ষড়যন্ত্রকারীদের দাঁতভাঙা জবাব দিতে পাশে রয়েছেন বিশাল হৃদয়ের এই পরিচালকের। বজ্রকন্ঠে তর্জনী উঁচিয়ে পেশাজীবী চক্রের ওইসব ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়ে রাজপথে নামারও প্রস্তুতি নিয়েছেন তাঁরা।
হাসপাতাল পরিচালকের স্ট্যাটাসে সেই ইঙ্গিত দিয়েই রুবেল আকন্দের উচ্চারণ-‘এটা সাধারণ জনগণ মেনে নেবেনা। প্রয়োজনে আমরা রাজপথে নামব কিন্তু এ অন্যায় মেনে নেব না।’
ফুরাদ সরকার নামের একজন স্পষ্টতই বলেছেন- ‘ভাল এবং সৎ মানুষকে খুব কষ্ট করে চাকরি করতে হয়। ময়মনসিংহ মেডিকেলে যে পরিবর্তন আপনি করে দিয়ে গেলেন তা সাধারন রোগিরা খুব মিস করবে। আপনি চলে যাবার সাথে সাথে দালাল লোকগুলো আবার হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট করে দিবে। সাধারণ রোগীরা আবার অসহায় হয়ে পরবে।’
সংক্ষুব্ধ দুলাল তালুকদার লিখেছেন- ‘আজ কোথায় জাতির বিবেক? আজ কোথায় সুশিল সমাজ, আজ কোথায় মানবাধিকার? আজ কোথায় প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব? আজ কোথায় প্রশাসন? একজন সৎ আদর্শ ন্যায় পরায়ণ ব্যক্তি, উনার সম্মান অবমাননা করার জন্য একটি কুচক্রী মহল উঠে পড়ে লেগেছে, আমি এর প্রতিবাদ জানাই।’
মন্তব্যের শেষ অংশে তিনি সচেতন করতে চেয়েছেন ময়মনসিংহবাসীকে। লিখেছেন-‘আমি বৃহত্তর ময়মনসিংহের জনসাধারণকে উদ্দেশ্য করে বলছি, নাসির উদ্দিন আহমদ স্যার, উনি যদি চলে যান, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার নাম করে আবার কসাইখানা হবে।
চিকিৎসা তো দুরের কথা শুধু ওরা জনসাধারণের রক্ত চুষে খাবে। আমরা আবার মাঠে নেমে প্রমাণ করে দিবো, নাছির উদ্দিন আহমদ স্যার বৃহত্তর ময়মনসিংহের জনসাধারণের হৃদয়ের স্পন্দন, আমাদের গর্ব ও জনগণের চিকিৎসার প্রাণ।’
সূত্র মতে, দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিনকে বদলী করে হাসপাতালকে আবারো দুই বছর সাত মাস আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে মরিয়া পেশাজীবী চক্রটি কয়েক কোটি টাকার ফান্ড নিয়েও সক্রিয় রয়েছে। মাস কয়েক ধরেই তাঁরা এই সংক্রান্ত প্রচার প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন।
এ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার (৩১ মে) রাতে এক স্ট্যাটাসে দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচালকদের মধ্যে অনুকরণীয় নাছির উদ্দিন আহমেদ লিখেছিলেন- ‘একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে আমি সহসা বদলী হয়ে যাব। এটা মিথ্যা, ভিত্তিহীন, গুজব। সরকার যতদিন চাইবে আমি ততদিন আমার দায়িত্ব পালন করব।’
সূত্র মতে, চিহ্নিত পেশাজীবী চক্রের ‘তল্পিবাহক’ হিসেবে পরিচিত গুটিকয়েক চিকিৎসক মাসখানেক আগে এক বৈঠকে পরিচালককে নিয়ে নিজের ভ্রান্ত মতবাদ উত্থাপন করেন। ওই বৈঠকে এক চিকিৎসক নেতা অভিযোগ করেন, পরিচালক হাসপাতালের উন্নয়নে সরকারকে কৃতিত্ব না দিয়ে নিজের কৃতিত্ব দাবি করছেন।
এই বিষয়ে হাসপাতালেরই চিকিৎসক কালের আলোকে বলেন, অতীতেও অনেকেই পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তাদের বেশিরভাগই নিজের রুটিন ওয়ার্কের বাইরে কেউ পথ চলেননি। তাদের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীদের বাইরের ক্লিনিক-ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে ছুটতে হতো। যাচ্ছেতাই ছিল খাবারের মান।
রোগী ভাগানোর ঘটনাও ছিলো ওপেন সিক্রেট। এই পরিচালক এসব বন্ধ করেছেন। এক ছাদের নিচে তিনি রোগীদের সব ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন নামমাত্র টাকায়। স্বভাবতই একজন ক্লিনিক মালিক হিসেবে ওই চিকিৎসক নেতার স্বার্থে আঘাত লাগারই কথা। তাঁর ক্লিনিকের ব্যবসা লাটে ওঠেছে। সুবিধার ভাগ লুটেপুটে না খেতে পেরে তিনি কত কথাই বলবেন!
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের এক কর্মচারী নেতা বলেন, হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন আহমেদ স্বাস্থ্য বিভাগের এক সম্রাটকে কার্যত ‘জিরো’ বানিয়ে ছেড়েছেন। ক্ষমতাধর ওই সম্রাটের কাছে তিনি আত্নসমর্পণ না করে নিয়মের মধ্যে থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাহুমুক্ত করেছেন। হাসপাতালের রাজস্ব আয়ে রেকর্ড গড়েছেন।’
হাসপাতালের এক অফিস সহায়ক বলেন, হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন কখনোই বলেননি তিনি এই করেছেন, সেই করেছেন। প্রতিটি কাজের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধী দলীয় নেতা, স্বাস্থ্য মন্ত্রীসহ সবার প্রতি বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
হাসপাতালে সেবার মান নিশ্চিত করে তিনি এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে এখানকার ভোটারদের জনমত অনুকূলে রাখতে নিবিষ্টমনে কাজ করছেন। সরকারি দলের পেশাজীবী সংগঠনের নেতা হয়েও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন হৃদয়বান মানুষকে কী উদ্দেশ্যে তারা বিতর্কিত করতে চাইছেন, কলঙ্ক লেপন করতে চাইছেন তা ময়মনসিংহবাসীর কাছে দিবালোকের মতো পরিস্কার। একেই বলে সর্ষের মধ্যে ভূত।’
কালের আলো/ওএইচ/এএ
** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে কালের আলো’র ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: KalerAlo/Facebook