খুলনার পর গাজীপুরও নৌকার

প্রকাশিতঃ 11:15 am | June 27, 2018

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো:

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো গাজীপুরেও জয় পেল আওয়ামী লীগ। খুলনার তুলনায় গাজীপুরে জয় হলো আরও বড়।

২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই মহানগরেই জিতেছিলেন বিএনপি সমর্থিত দুই প্রার্থী। এবার দলীয় প্রতীকে প্রথম নির্বাচনে পাঁচ বছর আগে যত ভোটে পরাজয় হয়েছিল, এবার তার চেয়ে বেশি ভোটে জিতল ক্ষমতাসীন দল।

২০১৩ সালে খুলনায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেদ ৬১ হাজারেরও বেশি ভোটে হেরেছিলেন বিএনপির মনিরুজ্জামান মনির কাছে। আর এবার খালেক জিতেছেন প্রায় ৬৮ হাজার ভোটে।

আর পাঁচ বছর আগে গাজীপুরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্ল্যা খানকে এক লাখ ৫৩ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন বিএনপির এম এ মান্নান। আর এবার আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলম বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকারকে হারিয়েছেন দুই লাখ ভোটেরও বেশি ব্যবধানে।

বুধবার সকাল সাতটায় গাজীপুর বঙ্গতাজ অডিটোরিয়ামে স্থাপিত অস্থায়ী কার্যালয়ে রিটার্নিং অফিসার ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা (ঢাকা অফিস) রকিব উদ্দিন মন্ডল জানান, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মোট ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪১৬টিতে জাহাঙ্গীর আলম পেয়েছেন ৪ লাখ ১০ ভোট। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকার পেয়েছেন ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬১১ ভোট। এসব কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর চেয়ে দুই লাখ দুই হাজার ৩৯৯ ভোট বেশি পেয়েছেন জাহাঙ্গীর।

গাজীপুর শহরে বঙ্গতাজ মিলনায়তনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ভোটের ফলাফল ঘোষণা শুরু করেন। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের বাসভবনেও তার মিডিয়া সেল আলাদাভাবে কেন্দ্র থেকে ফলাফল সংগ্রহ করে তা গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়ে দিতে থাকেন।

শুরু থেকেই দ্বিগুণেরও বেশি ভোটে এগিয়ে থাকা জাহাঙ্গীর আলম শেষ অবধি এই ব্যবধান বজায় রাখেন। আর হাতে গোনা এক দুইটি কেন্দ্রেই জিততে পেরেছেন বিএনপির প্রার্থী।

বেলা চারটায় ভোট শেষে সাড়ে চারটার দিকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে ভোট নেয়া হয়েছে এমন দুটি কেন্দ্রের ফল আসে। এতে আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলম এক হাজার ২৬৭ ভোট পান। আর বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকার পান ৫১১ ভোট।

এরপর থেকে যত সময় গড়াতে থাকে, দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান ক্রমেই বাড়তে থাকে। ১০০ কেন্দ্রেই জাহাঙ্গীর আলম ৬০ হাজার ভোটে, ১৬২ কেন্দ্রে এক লাখ ভোটে, ২৩২ কেন্দ্রে দেড় লাখ ভোটে এগিয়ে থাকে নৌকা।

রাত ১১টার দিকে জাহাঙ্গীর আলম যান রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে। সেখানে তিনি বলেন, ৪১৬টি কেন্দ্র থেকেই তার এজেন্টরা তাকে ফল জানিয়েছেন। আর তাদের দেয়া ফল অনুযায়ী তিনি কয়েক লক্ষ ভোটে জিতেছেন। এখানে তিনি এসেছেন আনুষ্ঠানিকভাবে ফল কখন ঘোষণা হয় তা জানতে।

জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমি মানুষকে বলেছি, পরিকল্পিত শহর দিতে চাই। আমি সেই কাজ করতে চাই।’

মেয়র হিসেব প্রথম কাজ কী হবে- এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘আমি যখন দায়িত্ব বুঝে পাব, আমার চেষ্টা থাকবে কীভাবে মানুষকে স্বস্তি দেয়া যায়।’

‘প্রথম কাজ হচ্ছে সবার সাথে আলোচনার ভিত্তিতে একটি পরিকল্পিত নগর করার জন্য কী কী করা যায়, সে ব্যাপার সবার সাথে আলোচনা করা।’

দিনভর বিএনপির কর্মীদেরকে নির্বাচনী এলাকায় সেভাবে দেখা যায়নি। আর সন্ধ্যার পর টঙ্গীতে বিএনপির প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী ক্যাম্পে নেমে আসে সুনশান নীরবতা।

রাতে বিভিন্ন কেন্দ্রের ভোটের ফল আসতে থাকার পরপরই আওয়ামী লীগ নিশ্চিত হয়ে যায় বড় ব্যবধানে জয় পাচ্ছে তারা।

আর সন্ধ্যায় এক প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, গাজীপুরের মতো আগামী জাতীয় নির্বাচনেও বড় জয় পাবেন তারা।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনও মনে করেন এই জয় আগামী জাতীয় নির্বাচনে জয়ের ভীত গড়ে দিয়েছে। আর আগামী ৩০ জুলাই তিন সিটি করপোরেশন রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেটেও জয় দেখছেন তিনি।

ইভিএমের ছয় কেন্দ্রেও নৌকায় ভোট দ্বিগুণের বেশি

সাধারণ কেন্দ্রে ব্যালটে ভোটের তুলনায় ইভিএমে ভোট নেয়া হয়েছে এমন ছয়টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ভোটের ব্যাপক ব্যবধান লক্ষ্য করা গেছে।

এই ছয়টি কেন্দ্রেও ধানের শীষের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি ভোট পড়েছে নৌকা প্রতীকে। হাসান সরকার যেখানে পেয়েছেন দুই হাজার ২৯৭টি ভোট, সেখানে জাহাঙ্গীর আলম পেয়েছেন চার হাজার ৮১০টি ভোট।

ভোটারদের সারি বিকাল চারটার পরও

সকাল আটকায় ভোট শুরুর পর পরই প্রায় সব কেন্দ্রেই ভোটারের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। দুপুরের দিকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভিড় কিছুটা কমে আসলেও বিকালেও বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারি লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি নির্ধারিত সময় বিকাল চারটার পরেও কেন্দ্রে উপস্থিতি থাকায় ভোট চলেছে কোথাও কোথাও।

ভোট শেষে রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিবউদ্দিন মণ্ডল জানান ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট পড়তে পারে।

ইভিএমের ছয় কেন্দ্রের দুই প্রধান প্রার্থীর পক্ষে ৫০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। অন্য পাঁচ জন মেয়র প্রার্থীর পক্ষেও কিছু ভোট পড়েছে। তবে তাদের ভোট সংখ্যা কত, সেটি তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। ফলে ইভিএমের ছয় কেন্দ্রে ভোট পড়ার হার কত সেটা জানা যায়নি।

৯ কেন্দ্রে সিল-জালভোট, বাকিগুলোতে ‘সুষ্ঠু’

মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত একটানা ভোট হয় ৪২৫টি কেন্দ্রে। এর মধ্যে কারচুপি, জালভোট ও সিল মারার অভিযোগে নয়টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। বাকি ৪১৬টি কেন্দ্রে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেছেন নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ।

তবে বিএনপির অভিযোগ, ভোট সুষ্ঠু হয়নি। শতাধিক কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারার অভিযোগ করেছে দলটি।

তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন এটা প্রমাণ করার জন্য।

আ.লীগের ব্যাচ পরে বিএনপি নেতার ‘নাশকতার’ পরিকল্পনা

আবার বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভোটের আগের রাতে আটক হয়েছেন যুবদলের এক নেতার সঙ্গে ভোটে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে।

বিএনপি নেতার সঙ্গে যুবদল নেতার কথোপকথনের দুটি ক্লিপ ফাঁস হয়েছে ফেসবুক এবং ইউটিউবে যেখানে শোনা যায়, মিজানুর ওই যুবদল নেতাকে কয়েকজন ছেলে যোগাড় করতে বলেছিলেন।

ওই কথোপকথন অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে পরিচিত আর অন্তরে বিএনপি এমন কিছু কর্মী যোগাড়ের নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি নেতা। আর ওই কর্মীদেরকে ‘যন্ত্রপাতি’ ও ‘প্রশিক্ষণ’ দেয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

তবে অল্প কিছু কেন্দ্র ছাড়া বাকিগুলোতে ভোট নিয়ে তেমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। সকাল থেকেই ভোটাররা দীর্ঘ লাইন ধরে কেন্দ্রে এসেছেন তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে।

একজন মেয়র ছাড়াও ৫৭টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে একজন করে সাধারণ কাউন্সিলর এবং ১৯ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর নির্বাচনে এই নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১১ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি।

আলোচিত এই নির্বাচনে ভোট হওয়ার কথা ছিল গত ১৫ মে। তবে সীমানা জটিলতার কথা বলে আশুলিয়ার শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ বি এম আজহারুল ইসলাম সুরুজের রিট আবেদনের পর ভোট স্থগিত হয়। পরে স্থগিতাদেশ উঠে গেলে নির্বাচন কমিশন ২৬ জুন ভোটের তারিখ ঠিক করে।

কালের আলো/ওএইচ