বিহাইন্ড দ্যা সিন; বুক চিতিয়েই লড়ছে আনসার ও ভিডিপি

প্রকাশিতঃ 8:38 am | June 07, 2020

রাইসুল ইসলাম, নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

অদৃশ্য ভাইরাস করোনার তান্ডবে দিশেহারা ও অস্থির সময়ে ‘লকডাউন’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিতি হয়েছে দেশ। ক্রমশ এক অদ্ভুত আঁধার নিজের মাতৃভূমিকে যখন গ্রাস করছে তখন সবারই তো আর ‘ঘরবন্দি’ হওয়ার সুযোগ নেই!

ফলশ্রুতিতে হালের ভয়াবহ এক মহামারীর বিরুদ্ধেই যুদ্ধে নিজেদের শামিল করেছেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী।

জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েই দেশজুড়ে বুক চিতিয়েই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য দিতে হচ্ছে কঠিন দামও। সংক্রমিত হচ্ছেন বাহিনীটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ সদস্য। মৃত্যুবরণও করেছেন একজন।

কিন্তু প্রাণঘাতী এই ভাইরাস ঠেকাতে রাজধানী থেকে মফস্বলের সাধারণ মানুষের সেবা নিশ্চিত করতেই নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

রাজধানীর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সঙ্গে যুক্ত হওয়া, জেলা-উপজেলায় ত্রাণ বিতরণে প্রশাসনকে সহায়তা ও ভ্রাম্যামাণ আদালতের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, কোয়ারেন্টাইনে থাকা সদস্যদের বাড়িতে লাল পতাকা দিয়ে চিহ্নিতকরণ, গ্রামে গ্রামে মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ, সামাজিক সচেতনতা- সবই কাজই সমানভাবেই তারা করেছেন।

করোনা পরিস্থিতির শুরুতেই বিমানবন্দরে প্রবাসীদের আগমন দিয়ে শুরু হওয়া কর্মকান্ড এখন গিয়ে ঠেকেছে ‘সুপার সাইক্লোন’ আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হতভাগ্য মানুষজনের ঘরদোর মেরামতসহ নানামাত্রিক কাজে।

আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ কালের আলো’র সঙ্গে আলাপে নিজের বাহিনীর চলমান কর্মযজ্ঞ এক কথায় উপস্থাপনে চমৎকার এক ‘শব্দগুচ্ছ’ প্রয়োগ করেছেন।

দক্ষতা ও প্রজ্ঞার যুগপৎ সম্মিলনে নেতৃত্ব দেওয়া বাহিনীটির এ কাপ্তানের মুখে উচ্চারিত শব্দ ‘বিহাইন্ড দ্যা সিন’ শব্দটি। আর এ শব্দটিই যেন বলে দিচ্ছে অনেক না বলা কথাই।

বলছিলেন, ‘একজন করোনা রোগীর টোকেন সংগ্রহ, টিকিট দেওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছা আবার কেউ মারা গেলে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে, করোনায় কেউ মারা গেলে দাফনের ব্যবস্থা করে দেওয়া পর্যন্ত যাবতীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে তাঁর বাহিনীর জীবনবাজি রাখা সদস্যদেরই।’

সম্মুখ সমরের পাশাপাশি পর্দার অন্তরালেও সমানতালেই কাজ করতে হচ্ছে দেশের অন্যতম বিশাল এ বাহিনীকে। করোনাকালে শ্রমিক সঙ্কটে হাওরের কৃষকের মলিন বদন মুছে দিতেও কাস্তে হাতে নামতে হয়েছে তাদের।

চলমান এই দু:সময়ে আরও দায়িত্বশীল এবং মানবিক হয়েছে আনসার বাহিনী। তাদের ভেতর জেগে উঠেছে মানবতাবোধেরই শাশ্বত রূপ। ক্ষুধার্ত মানুষের ঘরে খাবার জুটিয়েছেন নিজেদের ইফতারের টাকায়।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মহাঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিকভাবেও দেওয়া হচ্ছে সহায়তা। এ বাহিনীর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজার পরিবারের এক সপ্তাহের খাবারের জোগান দেওয়া হয়েছে। প্রতি পরিবারে ৪ জন হিসাব করলে এ সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭ লক্ষ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী হালের দুর্যাগে পীড়িত মানুষের স্বার্থকে হৃদয়ের ভালোবাসায় ধারণ করে মানবকল্যাণে নিবেদন করেছেন। দেশজুড়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বাহিনীটির প্রায় ৮০ হাজার সদস্য।

অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মতোই নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত বাহিনীর দু’জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে মোট ৩৮৬ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মোট সুস্থ হয়েছেন ২০১ জন। সুস্থতার হার ৫৩%।

৫৮ হাসপাতাল ও কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে দায়িত্ব
রাজধানী উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ৫৮ টি হাসপাতাল ও কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলোতে প্রবেশসহ নানা ধরণের সহযোগিতা করে যাচ্ছে আনসার সদস্যরা।

মাস্ক, পিপিই বা হ্যান্ড গ্লাভসের সমন্বয়ে দায়িত্বের শুরুতে এবং শেষে জীবাণুনাশক প্রতিরোধ চেম্বারে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেই নিবিষ্ট মনে দায়িত্ব পালন করছেন একেকজন আনসার ও ভিডিপি সদস্য।

দায়িত্বের রকমফের নিয়ে কথা হয় আশ্রাব আলী খান নামে একজন সদস্যের সঙ্গে। রাজধানী ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেছেন।

করোনা আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি তিনি সুস্থ হয়েছেন। অঙ্গীভূত এ আনসার সদস্য কালের আলোকে বলেন, ‘কোন ব্যক্তি করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে এলে সিরিয়াল, নমুনা এবং ডাক্তারের রুম সব কাজেই তাদের সহায়তা করতে হয়।

চিকিৎসকরা ঝুঁকি এড়াতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখলেও আমাদের সেই সুযোগ হয় না। হাসিমুখেই আমরা সেবা দিয়ে গেছি।’

ডিএমপি’র সঙ্গে সেবা দিচ্ছেন ২ হাজার সদস্য
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সঙ্গে সেবা দিচ্ছেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রায় দুই হাজার সদস্য।

আর হাসপাতালগুলোতে নিরাপত্তার পাশাপাশি শৃঙ্খলার বিষয় দেখভাল করতে সক্রিয় রয়েছেন আরও ২ হাজার ৪০০ জন সদস্য।

আনসার বাহিনীর একাধিক সদস্য কালের আলোকে বলেন, ‘শুরু থেকেই বাহিনীর মহাপরিচালক আমাদের সব রকমের নিরাপত্তা সামগ্রী সরবরাহ করেছেন। নিজেদের সুরক্ষার বিষয়টিকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন।

আবার কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতেও তাঁর কার্যকর পদক্ষেপ বাহিনীর সদস্যদের মনোবল আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এ কারণেই অন্যান্য সবার চেয়ে আমাদের বাহিনীতে সুস্থতার হার বেশি।’

নিজেদের ইফতারের টাকায় দুস্থদের ঈদ উপহার
করোনা সঙ্কটে মানবিকতার অনন্য নজির স্থাপন করেছে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। এসব কাজের মাধ্যমেই নিজেদের ভিন্ন এক উচ্চতায় তুলে ধরেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট সদর দপ্তর এবং জেলা কার্যালয় থেকে বাহিনীর সদস্যদের গত রমজানে নিজেদের জন্য ইফতার বাবদ বরাদ্দকৃত টাকা খরচা না করে তারা গরিব ও অসহায় মানুষজনের জন্য কিনেছেন ঈদের কাপড়। উপহার হিসেবে তুলে দিয়ে হাসি ফুটিয়েছেন তাদের মুখে।

চট্টগ্রামের পটিয়ায় অবস্থানরত ১৫ আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যরা স্থানীয় দরিদ্র কৃষক ও গরিব জনসাধারণের মাঝে চাল, ডাল, তেল, মসলা, সেমাই, ছোলা ও খেজুর বিতরণ করেছেন।

নেত্রকোনার জারিয়া পূর্বধলায় ৬ আনসার ব্যাটালিয়ন ঈদে শতাধিক অসহায় দুস্থ গরীব নারী-পুরুষের মাঝে নিজেদের উদ্যোগে ইফতার ও ঈদ উপহার সমাগ্রী প্রদান করেছেন। ঈদের দিনেও দুস্থদের মাঝে তারা উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করেন। চকলেট ও ঈদ সালামি দিয়েছেন দু’শতাধিক শিশুকে।

ঢাকার নবাবগঞ্জের কলাকোপার ১৭ আনসার ব্যাটালিয়ন, লক্ষিপুর রামগঞ্জে ১৩ আনসার ব্যাটালিয়ন, রাজশাহীর পবা নওহাটার ৪ আনসার ব্যাটালিয়ন, শেরপুর নালিতাবাড়ীতে ১২ আনসার ব্যাটালিয়ন, ৩৮ আনসার ব্যাটালিয়ন, ১৬ আনসার ব্যাটালিয়ন-সহ সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য ব্যাটালিয়নগুলো ইফতার ও ঈদ সামগ্রী বিতরণ করেছেন।

আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশেও মানবিক আনসার
আম্পান কেড়ে নিয়েছে অনেক স্বপ্ন। গৃহহীন করেছে অনেক মানুষকে। অনেকের স্থান হয়েছে খোলা আকাশের নিচে।

এমন প্রেক্ষাপটে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতোই আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ত্রাতারূপে আবির্ভূত হয়েছেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা।

যে কোনো সমস্যায় তারা যেমন মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন তেমনি ঘরদোর, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-সাঁকো মেরামত করে দিচ্ছেন। যশোরের মনিরামপুর ও শার্শা উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি মেরামত, রাস্তার উপর উপড়ে পড়া গাছ সরিয়ে সড়ক চলাচলের উপযোগী করেছেন আনসার সদস্যরা।

একই রকম কার্যক্রম তারা চালিয়েছেন বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুর, নড়াইল, বরগুনা, ঝালকাঠিসহ ক্ষতির মুখে পড়া জেলাসমূহে।

আবার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই মাইকিং থেকে শুরু করে বয়স্ক নারী-পুরুষ, প্রতিবন্ধীদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের পটিয়ায় ১৫ আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ পরিবারের ঘরের চালা মেরামত করে দিয়েছেন। স্থানীয় ১৫ আনসার ব্যাটালিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত শতাধিক পরিবারকে দিয়েছে খাদ্য সহায়তা।

রাজশাহীর নওহাটায় ৪ আনসার ব্যাটালিয়নের পরিচালক ফজলে রাব্বি নিজেদের ইফতারের জন্য বরাদ্দৃকত ৬০ হাজার টাকাসহ মোট ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে আর্থিক সহায়তা বাবদ পৌঁছে দিয়েছেন।

মানুষকে সুরক্ষার প্রত্যয়দীপ্ত অঙ্গীকার মহাপরিচালকের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে করোনাকালে দেশের সাধারণ মানুষকে সুরক্ষায় বহুমাত্রিক কাজ করে যাচ্ছে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা।

এ বিষয়ে বাহিনীটির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ কথা বলেন কালের আলোর সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ও আকাঙ্খার করোনামুক্ত বাংলাদেশ উপহার এবং দেশের মানুষকে সুরক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে উত্তীর্ণ করার প্রত্যয়দীপ্ত অঙ্গীকারে উদ্বেলিত আমার বাহিনীর প্রতিটি সদস্য।’

দুর্যোগে হতবিহ্বল মানুষের স্বার্থের, স্বপ্নের সঙ্গে নিজেদের একাত্ন করেছেন উল্লেখ করে মহাপরিচালক বলেন, ‘দেশের প্রতিটি দুর্যোগে এবং সঙ্কটে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য আনসার বাহিনীর অন্তর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।’

দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসায় সাম্য ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের সহজ ও আন্তরিক উচ্চারণও যেন তাদের অন্তরে গাঁথা।

ফলশ্রুতিতে মহাপরিচালকের কন্ঠে উচ্চারিত কবির সেই অমর কবিতাখানি ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে